শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অর্জন এক বিসর্জন অনেক

প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফজাল বারী : উপজেলা, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর এবার ইউপি নির্বাচনের হিসাব কষছে বিএনপি। পর্বতসম বাধার মধ্যে কেন এই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ? অর্জন কী? প্রতিপক্ষকে হারানোর প্রত্যাশায় নিজেদের হারানোর মাত্রাই বা কতোটুকু। এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে। ছয়ধাপের ইউপি ভোটের দুই ধাপ পেরোতেই বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি
এ প্রসঙ্গে তৃণমূল বিএনপিসহ কেন্দ্রীয় নেতারা চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নীতি-নির্ধারকদের প্রতি। ‘সরকার নিরপেক্ষ নয়’-এটি প্রতিষ্ঠিত করতে বিসর্জন দিতে হচ্ছে অনেক। বিসর্জনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। এদিকে আন্তর্জাতিক জরিপে বিএনপির জনপ্রিয়তার সূচক তলানীতে। শতকরা প্রায় ৩৩ থেকে ১১-তে।
নেতা-কর্মীদের মতে, নির্বাচনের পরিণতি জানতো হাইকমা-। জেনে শুনে পাতানো নির্বাচনের ফাঁদে পা দেয়ার ছিলো ভুল সিদ্ধান্ত। নীতিনির্ধারকদের এই ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আগে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর টার্গেট ছিলো কেন্দ্রীয় নেতারা। জেল-জুলুম ছিলো ওই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো। এখন সিডর বইছে গ্রাম/মহল্লা পর্যায়ের নেতাদের উপর দিয়ে। রক্তপাত, হানাহানি এবং হামলা-মামলার ফলে স্থায়ীভাবে ফেরারিতে পরিণত হয়েছেন বিএনপি নেতারা।
দীর্ঘ আট বছর নির্যাতনের শিকার নেতাদের মন্তব্য-এভাবে চলতে থাকলে এক সময় বিএনপি প্রার্থী দেয়ার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই আগামীর আন্দোলন মাথায় রেখে এখনই সঠিক পথে হাটার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। নির্বাচন ছেড়ে সংগঠন গুছিয়ে আন্দোলনের চিন্তা মাশায় আনার দাবি তাদের।
অপরদিকে রাজনীতি ও নির্বাচন বিশ্লেষকরাও বলেছেন, সরকারের একনায়কত্ব বা কারচুপির আখ্যায়িত করার জন্য বিএনপি যে পথ বেছে নিয়েছে তাতে লাভের চেয়ে লোকসানের পাল্লাই ভারী হচ্ছে। দেশবাসীর চোখে রাষ্ট্র পরিচালনায় আওয়ামী লীগ মন্দ হলেও আন্তর্জাতিক পরিম-লে বা জরিপে বিএনপির জনপ্রিয়তায় ধস চিত্র ফুটে উঠেছে। গত নবম জাতীয় সংসদের জরিপ মতে, বিএনপির জনপ্রিয়তা ছিলো শতকরা প্রায় ৩৩। এখন তা ১১ শতাংশে নেমেছে। উইপ ভোটের প্রথম ধাপে ১৭ভাগ ভোট পেলেও দ্বিতীয় ধাপে পেয়েছে ১১ ভাগ। শেষ পর্যন্ত জনপ্রিয়তার পারদ আরো তলানীতে নামবে। সরকারের তরফ থেকে এ চিত্রই উল্লেখ করা হয়েছে। গতকাল আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ মন্তব্য করেছেন ভরাডুবির লজ্জায় বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পথে হাঁটছে।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, শেষ পর্যন্ত সব ধরনের স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিল বিএনপির। সঙ্গত কারণে গত ২৫ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এখন থেকে সব নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। আর এসব নির্বাচনে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল তা প্রমাণ করা ও তৃণমূল বিএনপি চাঙ্গা করার মাধ্যমে সংগঠনকে শক্তিশালী করা। প্রথম উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সফলতা এলেও দ্বিতীয় উদ্দেশ্য সফল তো হয়নি বরং উল্টো অবস্থার মধ্যে নিমজ্জিত হতে হয়েছে। লাভের চেয়ে ক্ষতির পাল্লা ভারী হওয়ায় দলের মধ্যে নতুন করে দাবী উঠেছে, পরবর্তী নির্বাচনগুলো থেকে সরে আসার।
দলের প্রভাবশালী মধ্য সারির একাধিক নেতা ইনকিলাবকে জানান, স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া ছিল বিএনপির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তা প্রমাণিত হয়েছে। আন্দোলন ব্যর্থতায় যতটা না ক্ষতি হয়েছে এর চেয়ে অনেক বেশী ক্ষতি হয়েছে স্থানীয় নির্বাচনে। এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে তৃণমূলেও বিএনপি ধ্বংসের উপক্রম হয়েছে। নির্বাচনে কারচুপির বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে জানান দিতে গিয়ে দলের সাংগঠনিক ভঙ্গুর চিত্র জানান দেওয়া হয়ে গেছে। এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণেই একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে যাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা পর্যন্ত ছিলনা তারা এখন ফেরারী হয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। বিএনপির মতো বড় দলে সব ইউপিতে প্রার্থী দিতে না পেরে দলের সাংগঠনিক ভঙ্গুর অবস্থা প্রমাণিত হয়েছে। তাই তৃণমূলের ব্যাপক চাপে কারনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে বিএনপি। তবে সিনিয়র কিছু নেতা নিজেদের স্বার্থে এখনও নির্বাচনে থাকার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
দলের সিনিয়র এক নেতা জানান, পৌরসভার পাশাপাশি দুই দফা নির্বাচন শেষে নির্বাচনে অংশ গ্রহণে লাভ ক্ষতি নিয়ে বিএনপি বিভিন্ন ভাবে আলোচনা ও পর্যালোচনা করছে। তাতে দেখা গেছে, ক্ষতির পাল্লাই ভারী। লাভের মধ্যে এতটুকুও লাভ হয়েছে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে বিষযটি প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে দলীয় ভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। যেমন, অর্থ, শ্রম বিফলে গেছে পাশাপাশি দলের স্বার্থান্বেষী একটি মহল লাভবান হয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে তৃণমূলে ক্ষোভ আরো বেড়েছে, বেড়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও। এই নেতা আরো বলেন, পৌরসভার নির্বাচনের পরে ইউপি নির্বাচনের শুরু দিকেও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ, উৎসাহ ও প্রতিযোগিতা ছিল। দলের মনোনয়ন পেতে এত বেশী প্রতিযোগিতা ছিল যে, দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেক নেতার বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগও উঠে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একবারেই ভিন্ন। এখন আগ্রহী প্রার্থীই পাওয়া যাচ্ছে না।
একই বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, বিএনপি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তন চায়। সহিংসতা, হত্যা, গুম, নির্যাতন ও রক্তের নির্বাচন বিএনপি চায় না। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে আসার চিন্তা করছে।
বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছেন, নির্বাচনে যে ধরনের দখল, ভোট ডাকাতি, বাড়ি বাড়ি হামলা হচ্ছে তাতে অংশ নিয়ে ধানের শীষ প্রতীকের অপমান হচ্ছে। আর কতো দেখতে হবে যে হাসিনা সরকার নিরপেক্ষ নয়। দেশ-বিদেশের মানুষ অনেক আগেই জেনে গেছে। এখন আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিএনপির সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু ইনকিলাবকে বলেন, এই নির্বাচনে কোন অর্জন নেই। গত চারটি নির্বাচনেই প্রমাণিত হয়েছে শেখ হাসিনার অধীনে কোন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। হাসিনার অধীনে যে কোন নির্বাচন এখনই ‘নো’ বলা উচিৎ।
তিনি বলেন, আমরা মাঠের নির্বাচনে আছি। দেখতে পাচ্ছি বিএনপির প্রার্থী তো নয়ই দলীয় কর্মী বা সাধারণ ভোটারও এলাকায় থাকতে পারছে না। এই অবস্থা নেতা-কর্মীদের শুধু মামলায় জড়ানো আর তাদের জেলেপুরে দেয়া ছাড়া কোন অর্জন দেখছি না। একমাত্র অর্জনের আশায় আমরা শতাধিক বিষয়ে বিসর্জন দিয়েছি। জানমালের নিরাপত্তাসহ পরিবারের নিরাপত্তাও নেই। এক গভীর সমুদ্রে নিপতিত হয়েছি। যা হবার হয়েছে এখন নির্বাচন ছেড়ে আন্দোলনের সূচনা করা উচিৎ বলে মনে করে এই নেতা। তার আগে কমিটি ঘোষণা দেয়ার পরামর্শও রেখেছেন হাইকমা-ের প্রতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এটা গত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় ইসি প্রমাণ করেছে যে তারা ব্যর্থ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, বর্তমান সরকার ও ইসির অধীনে দেশের যে নির্বাচন চলছে, তাতে বিএনপির থাকা আর না থাকা সমান। রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপির এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে কোন লাভ নেই। তবে তারা (বিএনপি) এটা প্রমাণ করতে পেরেছে, যে এদের (সরকার ও ইসি) অধীনে কোন সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসি ব্যর্থ। সহিংসতার দায় অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ইসির ব্যর্থতা আরও স্পষ্ট হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের দায়িত্ব ইসির। সেই দায়িত্ব পালন করতে না পারলে অবশ্যই তাদের সরে যেতে হবে। তা না হলে দেশের মানুষ নির্বাচনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এমন চলতে থাকলে কোন দল নির্বাচনে অংশ নিতে চাইবে না।
বিভিন্ন সূত্রমতে, ইউপি নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৩২ জনের প্রাণহানি ও আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে বেশীর ভাগই বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থক। সারা দেশের ৪ হাজার ২৭৫টি ইউপিতে মোট ছয় ধাপে ভোট গ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন। ইতিমধ্যে দুই ধাপে ১ হাজার ৩৫৬ টি ইউপির নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ৯৮টিতে জিতেছে। ২০০ ইউপিতে তারা প্রার্থীই দিতে পারেনি। ২৩ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় তৃতীয় পর্বে ৬৮৩টি ইউপির ৪৭টিতে বিএনপি প্রার্থী দিতে পারেনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন