সায়ীদ আবদুল মালিক : যে দিকে চোখ যায় শুধু ময়লা-আবর্জনার স্তূপ আর পঁচা পানি। কোথাও কচুরিপানা ও আগাছা আবার কোথাও বিভিন্ন লাতাপাতায় ঘেরা এঁকে বেঁকে যাওয়া পরিত্যাক্ত কোন পথের মত। দখল আর দূষণে অস্তিত্ব এখন প্রায় বিলিন পর্যায়। এটি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খালের বর্তমান চিত্র। কাঁটাসুর থেকে কল্যাণপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। সদরঘাট-গাবতলী সড়কের পাশ দিয়ে খালটি বুড়িগঙ্গায় মিশেছে। যার দু’টি মুখের একমাথা মোহম্মদপপুর তিনরাস্তা বেড়িবাঁধে, অপরটি আদাবর ¯øুইচগেটের সাথে সংযুক্ত। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতাধিন মোহাম্মদপুর ও এর আশেপাশের বিশাল এলাকার বৃষ্টির পানি ও স্যুয়ারেজের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ এই খালটি এখন এলাকাবাসীর নানা দুর্ভোগের কারণ। এ খালটির বড় অংশজুড়ে রয়েছে ডিএনসিসি’র ৩৩ নং ওয়ার্ড়ের বিভিন্ন এলাকা। এ খালের ময়লা-আবর্জনা, কচুরিপানা আর পঁচা পানিতে জন্ম নেয়া মশায় অতিষ্ঠ মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং, মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটিসহ পুরা এলাকাবাসী।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মোহাম্মদ জাকির হাসান ইনকিলাবকে বলেন, রাউজক, গণপুর্ত অধিদপ্তর, সিভিল এভিয়েশন, রেলওয়েসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকার খাল, লেক, ঝিল ও জলাশয়গুলোর মালিক। এছাড়া ব্যক্তি মালিকানয়ও রয়েছে কিছু জলাশয়। এসব জলাশয় পরিষ্কারের জন্য কর্পোরেশনের আলাদা বাজেট নেই, তাছাড়া এগুলো পরিষ্কারের দায়িত্বও সিটি কর্পোরেশনের নয়। তিনি বলেন, খাল ও জলাশয়গুলো পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে আমাদেরকে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এ কাজে রয়েছে নানা আইনি জটিলতাও। যে কারণে খুব সহজেই আমরা রাজধানীল জলাশয়গুলো থেকে ময়লা আবর্জনা ও কচুরিপানা পরিষ্কারের কাজে হাত দিতে পারি না।
গতকাল সরেজমিন মোহাম্মদপুর নভদয় হাউজিং, মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটি, শ্যামলী ও আদাবর পর্যন্ত খালটির দুই পাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দুই পাশ দিয়ে দখল হতে হতে এক সময়ের দেড়শ থেকে ২০০ ফুটের এ খালটি এখন মাত্র ১৫ থেকে ২০ ফুটের একটি সুরুড্রেন হয়ে গেছে। খালটির বেশির ভাগ অংশই ময়লা-আবর্জনায় ভরা। এ ময়লা-আবর্জনায় এখন মশা-মাছির নিরাপদ প্রজনন ক্ষেত্রে পারিণত হয়েছে। মশা-মাছির যন্ত্রণায় সারা মোহাম্মদপুর এলাকাবাসী অতিষ্ঠ।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যে এখালটি পরিষ্কার করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ময়লা-আবর্জনার উপর দিয়ে মানুষ, গরু-ছাগল আনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। আবার দুরন্ত ছেলে মেয়েরদল আবর্জনার উপর দিয়ে দৌড়া দৌড়ি করে থাকে। বিভিন্ন সময় ময়লার ফাঁক দিয়ে পঁচা পানিতে ডুবে প্রাণহানির মত দুর্ঘটনা ঘটছে। এ আবর্জনার জন্মানো মশা আর মাছির যন্ত্রণায়তো আমরা অস্থির অবস্থার মধ্যে আছি। এ যেন ‘রাতে মশা দিনে মাছি এনিয়ে মোহাম্মদপুরে আছি’।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজিব গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, এটি ওয়াসার খাল। এর দেখভালে দায়িত্বও তাদের। খালের ময়লা-আবজনা পরিষ্কারের জন্য সিটি কর্পোরেশনের কোন বাজেট নেই। তাই আমাদের এ ব্যপারে কিছুই করার নেই। এই কাজের জন্য সিটি কর্পোরেশন প্রতিবছর বাজেট রাখে। এবছরও এ কাজের জন্য এক কোটি টাকা বজেট রয়েছে বলে স্থানীয় এই কাউন্সিলরের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বালেন, সামান্য এ বাজেটে আর কি হয়। এ টাকায়তো একটি খালও পরিষ্কারের কাজ করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আমরা এর দখলদার উচ্ছেদের ব্যাপারে তৎপর আছি। ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে দ্রæত এ থেকে মশার বিচরণ ক্ষেত্রও ধ্বংশ করে দেয়ার পদক্ষেপ নিব।
সরেজমিন দেখা গেছে, মোহাম্মদপুরের যেসব এলাকার মধ্য দিয়ে খালটি বয়ে গেছে তার মধ্যে নবোদয় হাউজিংয়ের শেষ প্রান্তে লোহার গেট এলাকার (তিন খালের মোড়) অবস্থা সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ অবস্থায় আছে। বারোয়ারি বর্জ্যে পানিপ্রবাহ একদমই বন্ধ। মাটি জমে সেখানে গাছপালা গজিয়ে উঠেছে। এতে এলাকার স্যুয়ারেজের ময়লা পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। খালের আবর্জনায় পরিষ্কার না করায় মশা জন্মাচ্ছে। পঁচা পানির দুর্গন্ধে খালের আশেপাশে এক মিনিট দাঁড়ানোর উপায় নেই। বর্ষা মৌসুমে পানিবদ্ধতার আতঙ্কে রয়েছে এলাকাবাসী।
নবোদয় হাউজিংয়ের বাসিন্দা মঞ্জুর রহমান পাভেল বলেন, একসময়ে খালটি ৭০ ফিট চওড়া ছিল যা বর্তমানে ১৫ ফিটে পৌঁছেছে। আবার কোথাও খালের পাড় দখল করে ১০ ফিট বানিয়েছে দখলদাররা। এসব দখলদার ও ময়লা আবর্জনা দূর করতে না পারলে আগামী বর্ষা মৌসুমে মোহাম্মদপুর বাসিকে ময়লা পানিতে ভাসতে হবে। মোহাম্মদপুর হাউজিং লিমিটেডের বাসিন্দা আখতার হোসেন বলেন, গত দুই বছরে খালটি পরিষ্কার করা হয়নি। তবে এখন ওয়াসা নামে মাত্র খাল পরিষ্কার করছে। রাস্তার পরিধি ছোট হওয়ায় খাল পরিষ্কারে ওয়াসার গাড়ি সবখানে পৌঁছেতে পারে না। সেজন্য খাল পরিষ্কারের পরও ৬০ ভাগ ময়লা-আবর্জনা খালে পড়ে থাকে।
মোহাম্মদপুর হাউজিং লিমিটেডের ১ ও ২ নাম্বার সড়ক পার হয়ে ৩ সড়কে যেতেই চোখে পড়ে ওয়াসার একটি সাইনবোর্ড লেখা রয়েছে- ‘খালের নাম: রামচন্দ্রপুর খাল। খালের ভিতর অবৈধভাবে কোন স্থাপনা নির্মাণ করবেন না। খালের মধ্যে বাসাবাড়ীর ময়লা-আবর্জনা ফেলবেন না। খালের মধ্যে সাঁকো, পানির লাইন, মাঁচা, ঘরবাড়ী, টয়লেট, দোকান, রিক্সা গ্যারেজ ইত্যাদি নির্মাণ করা দÐনীয় অপরাধ। খালের ভিতরে পাইলিং এর কাঁদা ফেলবেন না।
এতেই যেন ওয়াসার দায়িত্ব শেষ। এলাকা ঘুরে তার উল্টো চিত্রই দেখা যায়। ওই সাইনবোর্ডের সামনেই দখল আর দুষণে একাকার। খালের দুই পাশেই অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা। খালের পানিতে ময়লা-আবর্জনা আর কচুরিপানাতে বুঝার উপায় নেই এখানে কোন খাল আছে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, প্রাকৃতিক খালগুলো সংরক্ষণ করতে না পারলে ঢাকায় বিপর্যয় নেমে আসবে। এ কারণে আমরা বারবার বলছি খালগুলো রক্ষা করতে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীও আন্তরিক। কিন্তু কেন যেন দখলদারদের ঠেকানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমিও দেখেছি। খুব খারাপ অবস্থায় আছে এ খালটি। এখনোই এটাকে সংরক্ষণ করা না হলে অন্যান্য খালের মতো এর অস্তিতও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন