[-রাজধানীর ফুটপাত ভাড়া দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা, সহযোগিতা করছে পুলিশ ও রাজউকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী -দখল মুক্ত করতে হুট করে চালানো উচ্ছেদ অভিযানগুলো একেবারেই মূল্যহীন। এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। বরং এগুলো দুর্নীতির আরো ক্ষেত্র তৈরি করে -নগরবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব]
রাজধানীতে অবৈধ দখলের মহোৎসব চলছে। সেই সাথে দখল মুক্ত অভিযানের নামে চলছে ইদুঁর বিড়াল খেলা। একদিকে উচ্ছেদ অভিযান,অন্যদিকে উচ্ছেদের কয়েক ঘন্টা পরই আবার দখল। শুধু ফুটপাত, খেলার মাঠ, লেক কিংবা খালই নয় এখন ফুটওভারব্রীজের ওপর এবং ফ্লাইওভারগুলোর নীচে চলছে অবৈধ দখলের মহোৎসব। মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় ২০১৭ সালের জানুয়ারী মাস থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত রাজউক, সিটি করপোরেশন এবং জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কমপক্ষে ১১৮ উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। তবে এসব অভিযানে কোন সুফল নেই। নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবিদরা বলছেন ,এগুলো লোক দেখানো অভিযান। সরকার চাইলে একমাসেই অবৈধ দখলদার মুক্ত মহানগরী রাজধানীবাসিকে উপহার দিতে পারে। এ জন্য দরকার রাজনৈতিক কঠোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা।
ঢাকার বাংলামটর থেকে ইস্কাটন যাওয়ার সড়কটির অধিকাংশ জায়গাতেই অটোমোবাইলের দোকান। এসব দোকানের দশ গজের মধ্যেই মূল সড়কের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে একটি পুলিশ ফাঁড়ি। ফুটপাতের ওপরে আছে শত শত ভাসমান দোকানপাঠ। ওই এলাকায় গত দুই বছরে কমপক্ষে ৭ বার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। তবে এসব অভিযানের পর পরই ঢাকার বাংলামটরের ওই ফুটপাত আবার দখল করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্যে দিয়ে ব্যবসায়ীরা দখল করে রাখেন। শুধু বাংলামোটরই নয় ,তেজাগাঁও, কারওয়ান বাজার গুলিস্থান,বায়তুল মোকাররম, মতিঝিল নিউমার্কেটসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় এ চিত্র দেখা যায়। উচ্ছেদের পর পরই আবার দখল হয়।
তাহলে এ ধরনের অভিযান চালিয়ে লাভ কি জানতে চাইলে ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মশিউর রহমান বলেন,সবাই মিলে মনিটরিং করতে হবে এবং শুধু আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বলেন, রাজধানীর ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে প্রথমে প্রয়োজন যারা দখল করেন তাদের পেছনে কারা শক্তি যোগায় তাদের সনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে । ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় ওইসব অপশক্তির বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। অভিযানে দখলমুক্ত করার পর এগুলো রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বে যারা নিয়োজিত আছেন তাদের আরো কঠোর হতে হবে।
নগর ও পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনকারীদের অন্যতম স্থপতি ইকবাল হাবিব । এ ব্যপারে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দখল মুক্ত করতে হুট করে চালানো উচ্ছেদ অভিযানগুলো একেবারেই মূল্যহীন। এটা কোন স্থায়ী সমাধান নয়। বরং এগুলো দুর্নীতির আরও ক্ষেত্র তৈরি করে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না হলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক গোষ্ঠীর আন্তরিক কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সঠিকভাবে মনিটরিং করা। শুধু রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোকে সম্পৃক্ত করে রাস্তাঘাট ফুটপাত দখল মুক্ত করে তা রক্ষা করা যে সম্ভব তার প্রমাণ হলো ঢাকার তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড এবং গাবতলী বাস টার্মিনাল।
শুধু পুলিশ দিয়ে অভিযান চালিয়ে কিংবা লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে তা দখল মুক্ত রাখা সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, নগরীর সব সড়ক ও ফুটপাত কবে সম্পূর্ণ দখল মুক্ত হবে কিংবা আদৌ হবে কি-না সেটি বলা সত্যিই কঠিন।
রাজধানীর উত্তরা সোনারগাঁ জনপথ সড়কের উভয় মাসে কয়েক মাস আগে রাজউক অভিযান চালিয়ে অবৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে দিয়েছিল। ফুটপাতগুলোও দখল মুক্ত হয়েছিল। তবে উচ্ছেদের কয়েক সপ্তাহ যেতে না যেতেই আবার ওইসব ফুটপাতসহ প্রধানসড়কের উভয়পাশে আবার অবৈধ স্থাপনা ও দোকানপাটে ভরে গেছে। শুধু তাই নয় উত্তরা মডেল টাউনের ৭,৩, ৫, ১১,১২,১৩ ও ১৪ নং সেক্টরের যেসব ব্যস্ততম রোডের ফুটপাত নতুন করে স্থাপন করা হয়েছে সেগুলোও এখন দোকানীদের দখলে। এ দৃশ্য শুধু উত্তরা নয়, রাজধানীর আবাসিক এলাকা ধানমন্ডি,শ্যামলী, মিরপুর, থেকে শুরু করে সর্বত্রই। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য দেখা গেছে গুলিস্থানে। মহানগরীর যেসব এলাকায় রাস্তা খোঁড়াখুড়ি চলছে এবং কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন করে ফুটপাত নির্মান করেছে বা যেগুলোর সৌন্দর্য্য বর্ধন করা হয়েছে, সেখানেও দোকানীরা দোকান পাট বসিয়েছে। ফুটপাতের কাজ শেষ হতে না হতেই সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা ভাসমান দোকীদের কাছে অলিখিত ভাড়া দিয়েছে। এদৃশ্য পুরো নগরীতেই দেখা গেছে।
সরেজমিনে পরিদর্শনকালে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি, রাজউকের উত্তরা জোনের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ রাজউকের কিছু অসাধূ কর্মকর্তা কর্মচারী এবং স্থানীয় সরকারদলীয় কিছু নেতা কর্মীরাই এলাকর রাস্তা-ঘাট ,ফুটপাত দোকানীদের কাছে ভাড়া দিয়েছে। তাদের সহয়োগিতাই চলছে অবৈধ দখল এবং দখলের পর তা ভাড়া দেয়া হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে।
এ ব্যপারে জানতে চাইলে ওসি আলী হোসেন বলেন, পুলিশের কাজ হলো রাজউক , সিটি করপরেশনের উচ্ছেদ অভিযানে সহযোগিতা করা। রাজউক যতবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে পুলিশ তাদের সহযোগিতা করেছে।
সোনারগাঁও জনপদ সড়কের ফুটপাতসহ ১৩,১১, ১২, ১৪,৩, ৯ ও ৭, নং সেক্টরের ফুটপাতের দোকানীদের সহযোগিতা করা ও দোকানীদের কাছ থেকে দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদা আদায় করা প্রসঙ্গে তিনি অস্বীকার করেন। থানা পুলিশ কোন টাকা বা চাঁদা আদায় করেনি বলে ওসি জানান।
তবে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ওসি আলী হোসেনের গান ম্যাননুর আলম প্রতিদিন দোকাননীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন। কোন ধরণের প্রমাণ আছে কিনা জানতে চাইলে, একাধিক ব্যবসায়ী এ সংক্রান্ত বয়েজ রের্কড শুনান। নাম প্রকাশে না করার শর্তে ১১ ও ১৩ নং স্কেটরের ফুটপাতের ৫ জন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন,কয়েক মাস পর পর পথানা পুলিশ চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। তাদের দাবীকৃত চাঁদা না দিলেই ফুটপাতে দোকান নিয়ে বসতে দেন না ওসির বডি গার্ড নুর আলম।
স্থানীয় যুবলীগের এক কর্মী জানান, ওসি আলী হোসেন গত ৫ বছর ধরে এ থানায় আছেন। তারদাপটে এলাকার নেতা কর্মীরাও আতঙ্কে থাকেন। ওসি নাকি বর্তমান পুলিশ কমিশনারের খুবই ঘনিষ্ট তাই তাকে এ থানা থেকে বদলি করা হচেছ না।
জানা যায়, স¤প্রতি রাজউকের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসেই উত্তরায় কয়েক শত কোটি টাকার জমি দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা।
অভিযোগকারীরা বলছেন, উত্তরায় রাজউকের জমি দখরের মহোৎসব চলছে। এসব জমিতে অস্থায়ী দোকানপাঠ, কাঁচাবাজার এবং বিভিন্ন মার্কেট তৈরী করে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিছে। উত্তরা সোনারগাঁও জনপদ রোডর উভয়পাশে ১৩ , ১২ ,১১ ও ১০ নং সেক্টরে প্রায় হাজার কোটি টাকার রাজউকের জমি দখল করেছে প্রভাবশালী মহল। এছাড়া ওই রোডের ফুটপাতগুলোও অস্থায়ী ব্যবসায়ীদের দখলে। ফলে এলাকাবাসীর চলাচল করতে নানা সমস্যা ও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আর এ দখল চলছে রাজউকের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর উত্তরার সোনারগাঁ জনপথ রোড়ের ১১ ও ১৩ নং সেক্টরের চৌরাস্তা থেকে ময়লার মোড় পর্যন্ত প্রধান সড়কের উভয়পাশে বাঁশপট্টি, খাবার হোটেল, গাড়ীর গ্যারেজ, ভাঙ্গারির দোকান, ফার্নিচার মার্কেট, কাঁচাবাজার ও বিভিন্ন নামে অফিস খুলে বসেছে দখলদারেরা। আর এদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা আদায় করছেন রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উত্তরা জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী শাজাহান বলেন, রাজনৈতিক প্রভাব কাঠিয়ে যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক ও আওয়ামী লীগ নেতা মাজেদ এসব জমি দখল করেছে। তিনি বলেন, আমরা শীঘ্রই অবৈধ দখল মুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করব। অবৈধ দলদারদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি কারো কাছ থেকে কোন টাকা নেয়নি । আমি কিছুদিন আগে যোগদান করেছি। আমি আসার আগেই এসব মার্কেট স্থাপিত হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন