শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

মার খাচ্ছেন সবজি চাষিরা

সিন্ডিকেটের দাপট সংরক্ষণ ও বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা

প্রকাশের সময় : ৪ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মিজানুর রহমান তোতা : কোন মৌসুমে মূল্য কিছুটা ভালো, আবার কোন মৌসুমে দারুণ খারাপ। গড়পড়তা লোকসানের অংক বেশি। এর মূল কারণ সিন্ডিকেটদের দাপট এবং সংরক্ষণ ও বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। এতে সবজি চাষিরা মার খাচ্ছেন। বছরের পর বছর ধরে উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি করেও ‘ভেজিটেবল জোন’ হিসেবে পরিচিত যশোরসহ বিভিন্ন এলাকার সবজি চাষীরা সুফল পাচ্ছেন না বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। একজন মার্কেটিং অফিসার মনোয়ার হোসেন দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের এক আদেশ মোতাবেক পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ক্রয়কৃত সবজি ২০/২৫ পারসেন্ট বেশি মূল্যে খুচরা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করবেন। যাতে ভোক্তাদের বাড়তি মূল্য গুণতে না হয়। এটি কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় চাষিদের স্বার্থে পাইকারীদের লাগাম টেনে ধরা কিংবা মাঠের মূল্যের চেয়ে সর্বোচ্চ কত পারসেন্ট বেশি মূল্যে সবজি বিক্রি করতে পারবেন সেই নির্দেশনা নেই। যার কারণে মাঠের ৯/১০ টাকা কেজি মূল্যের পটল বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০টাকা। একইভাবে বেগুনসহ প্রায় সব ধরণের সবজির মাঠের মূল্য আর বাজার মূল্যেও বিস্তর ফারাক থেকেই যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদক চাষি ও ভোক্তা উভয়েই।
দেশে মোট সবজি চাহিদার সিংহভাগই যোগান হয় যশোর থেকে। এখানকার পাইকারী বাজারের দিকে দৃষ্টি দিলে সারাদেশের একটা বড় অংশের ভোক্তা তুলনামুলকভাবে কম মূল্যে সবজি ক্রয় করতে পারতেন। উপযুক্ত মূল্য পেতেন সবজি চাষিরাও। কিন্তু বরাবরই এই বিষয়টি অনুপস্থিত রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলেছে, দেশে শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন দু’টি মৌসুমে সরকারিভাবে সবজি আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৬ লাখ৭৮ হাজার হেক্টর জমিতে। সুত্রমতে, যার একটা বড় অংশ আবাদ ও উৎপাদন হয় যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। তবে শীতকালের চেয়ে তুলনামূলক গ্রীস্মকালীন সবজি উৎপাদন কম হলেও চলতি মৌসুমে মাঠ ভরে গেছে রকমারী সবজিতে। পটল, বেগুন, পেপে, উচ্ছে, মিষ্টি, লাউ, কুমড়া, বরবটি ও টমেটোসহ সব ধরণের সবজি উৎপাদনে এবারো রেকর্ড সৃষ্টি করেছে বলে মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তা জানিয়েছেন। কয়েকজন সবজি চাষি জানান, বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি মাঠে একদাম, আর বাজারে আরেকদাম। রাজধানী ঢাকার বাজারে মাঠের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে পটল ও বেগুনসহ বিভিন্ন সবজি বিক্রি হচ্ছে। সবজির বাজারের দিকে সরকারের কোন বিভাগের নজর নেই। নজর থাকলে সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীরা অন্তত কম মুনাফা লুটলে উৎপাদক চাষী ও ভোক্তা উভয়েই লাভবান হতে পারতেন। যশোরের সবজি ভা-ার বারীনগর ও খাজুরার পাইকারী বাজারে সরেজমিন খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। চাষিদের অভিযোগ বরাবরই সরকারি পৃষ্টপোষকতা অনুপস্থিত রয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং কঠোর নজরদারির অভাবে ফল ভোগ করছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।
সবজি অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বিরাট ভুমিকা রাখছে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সেজন্য দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেই। মাঠ থেকে বাজারে তুললেই উৎপাদক চাষি ও ভোক্তার মুখটা মলিন হয়ে যায়। ্চাষি ও ভোক্তা উভয়ের আর্থিক ক্ষতি করছে মধ্যস্বত্বভোগী পাইকারী ব্যবসায়ীরা। অভিজ্ঞ মহলের মতে, চাষীদের অর্থনৈতিক সংকট নিরসন, বাজারজাতকরনের সমস্যার সমাধান, উৎপাদিত সবজির উপযুক্ত মূল্য পাবার নিশ্চয়তা ও পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থা করে সবজি সংরক্ষণ এবং সম্ভাবনাময় কৃষির এই খাতটি উজ্জল স্বাক্ষর রাখতে পারবে। সবজি উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টির এলাকায় কৃষিভিত্তিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার দাবিটি আজো পুরণ হয়নি। বিশেষ করে এ অঞ্চলে টমেটোর জুস ও অন্যান্য বারোমাসি ‘ভেজিটেবল’ দিয়ে অত্যন্ত সস্তায় ফুড প্রোডাক্টস ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা সম্ভব। এক্ষেত্রে যথেষ্ট সুযোগও রয়েছে। যশোরে রয়েছে বড় এয়ারপোর্ট। এখানে কক্সবাজার থেকে খুলনা, যশোর, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের জন্য চিংড়ি পোনা কার্গো বিমানে আসে নিয়মিত। তার বিপরীতে যশোর থেকে দেশের বিভিন্নস্থানে যায় রেণু পোনা। বিদেশের সাথে কার্গো বিমানের লিংক করে দিলে খুব সহজেই যশোরের সবজি বিদেশে রফতানী করে কাড়ি কাড়ি টাকা আয় করা সম্ভব। অথচ সরকার বিষয়টির দিকে মোটেও নজর দেয়নি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, যশোরের সবজি বিপ্লব ও চাষিদের বিরাট সাফল্যের পেছনে সরকারের কোন কৃতিত্ব নেই। বরং আছে সবজিকে ঘিরে কৃষিভিত্তিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা। আরো ব্যর্থতা হচ্ছে চাষি পরিশ্রম করে সবজি উৎপাদন করেন কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না থাকায় তারা উপযুক্ত মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া তারা বরবারই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নানাভাবে। বাজারজাতকরণ এবং সংরক্ষণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে সবজি চাষিরা পিছিয়ে থাকছেন। পাইকারী ব্যবসায়ী, ফড়িয়া ও দালালরা ট্রাক ভিড়িয়ে নামমাত্র মূল্যে সবজি ক্রয় করে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্নস্থানে সবজি নিয়ে যাচ্ছে। বিক্রি করছে অতিরিক্ত মূল্যে। এ ব্যাপারে মাঠে নেমে কঠোরভাবে মনিটরিং করে সবজি চাষি ও ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে ধীরে ধীরে চাষিরা হতাশ হয়ে পড়বেন। আগ্রহ হারাবেন সবজি আবাদ ও উৎপাদনে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন