বাংলাদেশ-ভারত জনগণের পর্যায়ে বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করার ওপর জোর দিলেন সফররত ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখলে। রাজধানীতে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক বিষয়ক এক সেমিনারে দেয়া বক্তৃতার সূচনাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সচিব, বুদ্ধিজীবী, স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিটি ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে তার মতবিনিময়ের প্রসঙ্গ টেনে গোখলে বলেন, ‘আমরা যদি দীর্ঘমেয়াদি বন্ধুত্ব তৈরি করতে চাই তাহলে এমন মতবিনিময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুত্ব শুধু দুই সরকারের মধ্যে নয়, এটি জনগণের পর্যায়ে হতে হয়।’ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে এখন স্বর্ণ যুগ চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে এ পর্যন্ত শতাধিক চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও যৌথ সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাতে উভয় দেশ সমানভাবে লাভবান হচ্ছে। ইনস্টিটিউট অব পলিসি, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড গভর্নেন্স (আইপিএজি) গতকাল ওই সেমিনারের আয়োজন করে। এতে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন।
সেমিনারের আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনের ওই বৈঠকে সিভিল নিউক্লিয়ার, গণমাধ্যম এবং অন্যান্য বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে ৬টি সমঝোতা স্মারক সই হয়।
সেখানে দেয়া যৌথ বিবৃতিতে পররাষ্ট্র সচিব গোখলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে কথা বলেন। সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রেক্ষাপটে দুই দেশের জনগণের পর্যায়ে সম্পর্কের ভিত মজবুত করার তাগিদ দেন তিনি। বলেন, আমরা দুই দেশ সন্ত্রাস দমনে একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছি। ভারত দুই দেশের মানুষে মানুষে যোগাযোগকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়। দুই দেশের সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ উচ্চতায়।
তিস্তা বা পানি বণ্টন চুক্তির কথা সরাসরি উল্লেখ না করে গোখলে বলেন, ‘আমাদের দুই দেশের সম্পর্কে অনেক অগ্রগতি হলেও কিছু কিছু বিষয় এখনো সমাধান হয়নি। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আমরা অভ্যন্তরীণভাবে যত দ্রুত সম্ভব এগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি।’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। এরমধ্যে রোহিঙ্গা এবং তিস্তা ইস্যুটি ছিল। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা ভারতীয় বন্ধুর অবস্থানে খুশি।’ যৌথ বিবৃতি এবং সেমিনারে দেয়া বক্তৃতা- উভয় স্থানেই রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। বলেন, প্রত্যাবাসন চুক্তি মতে মিয়ানমার দ্রুত তাদের বাস্তুচ্যুত বাসিন্দাদের ফিরিয়ে নেবে বলে আমরা আশা করি। ফিরে যাওয়া রাখাইনের বাসিন্দাদের বাসস্থান নির্মাণে ভারত সহায়তা করছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। সচিব এ-ও জানান, বর্ষা মৌসুমের বিষয়টি বিবেচনায় মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত এই জনগণের সহায়তায় দ্বিতীয় দফায় ত্রাণসামগ্রী পাঠাচ্ছে ভারত। এ ছাড়া কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া ওই সব নারী ও শিশুদের জন্য মাঠ পর্যায়ে হাসপাতাল চালু করতে যাচ্ছে দেশটি। ভারতকে বাংলাদেশের ‘বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী’ উল্লেখ করে গোখলে বলেন, গত সাত বছরে বাংলাদেশকে দেয়া ঋণের পরিমাণ ৮০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু উন্নয়নকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে, ফলে এই ঋণ খুবই কার্যকর হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও ভারতীয় হাইকমিশনার যা বললেন- বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিষয়ক গতকালের সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী দু’দেশের অমীমাংসিত বিষয়গুলো দ্রুত সমাধানের তাগিদ দেন। তিনি সরাসরি কোনো বিষয় বা ইস্যুর উল্লেখ না করেই বলেন, আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ঐতিহাসিক সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে। এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় সেনারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এটি রক্তের বন্ধন। নিশ্চিতভাবে আমাদের সম্পর্ক দিনে দিনে অত্যন্ত গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। এখন শুধু এগিয়ে চলা। তবে এই এগিয়ে চলা আরো বেগবান হওয়া চাই। আমাদের সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ায় কীভাবে আরো বিস্তার করা যায় তা নিয়ে কাজ করতে হবে।
সেমিনারে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বলেন, পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে কেশব গোখলের এটিই প্রথম বাংলাদেশ সফর। দুই দেশেই নির্বাচন অত্যাসন্ন। সেই প্রেক্ষাপটেও সফরটি তাৎপর্যপূর্ণ। সফরটি এমন সময় হচ্ছে যখন গত কয়েক বছরে আমাদের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা ঝালাই করার সময়। একই সঙ্গে আমাদের চলার পথের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার সময়। সফরটি সময়ের দাবি পূরণ করবে বলেও আশা করেন হাইকমিশনার।
গত ২৯শে জানুয়ারি ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব নেয়ার পর রোববার বাংলাদেশে আসেন বিজয় গোখলে। সন্ধ্যায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। আজ সকালে তার ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা রয়েছে।
সম্পর্কের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে: সেমিনারে দেয়া দীর্ঘ বক্তৃতায় সম্পর্কের ধারাবাহিকতা রক্ষার তাগিদ দিয়ে বিজয় গোখলে বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় নেয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আমরা সৌভাগ্যবান যে, দুই দেশের জনগণের উন্নয়ন এবং এই অঞ্চলের কল্যাণের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার বিষয়টি অনুধাবন করেন। তিনি বলেন, গত এক দশকে দুই দেশের সম্পর্কে অসামান্য অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলেই ৬৮টি চুক্তি হয়েছে। উচ্চ প্রযুক্তি, বেসামরিক পরমাণু জ্বালানি, সাইবার নিরাপত্তা, ব্লু ইকোনমি’র মধ্যে নতুন নতুন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে এসব চুক্তি হয়েছে। স্থল সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন হয়েছে। সীমান্তের মানুষেরা এখন নাগরিকত্ব পেয়েছে। যেটা কয়েক বছর আগেও ভাবা যায়নি। সমুদ্র সীমার বিরোধও নিষ্পত্তি হয়েছে। এখনো দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, কিছু অমীমাংসিত ইস্যু রয়েছে। নিরাপত্তা ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে গত কয়েক বছর ধরে চমৎকার সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সীমান্তে প্রাণহানি শূন্যে নামিয়ে আনতে চাই। গত কয়েক বছরে সীমান্তে প্রাণহানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। বাণিজ্য দুই দেশের সম্পর্কের অন্যতম ক্ষেত্র উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক ভারতীয় প্রতিষ্ঠান যেমন বিনিয়োগ করছে তেমনি কিছু বাংলাদেশি কোম্পানিও ভারতে বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশ সম্প্রতিকালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। আমরা মনে করি, এই অঞ্চলে বাংলাদেশ ‘ইকোনমিক পাওয়ার হাউসে’ পরিণত হবে। এই অঞ্চলের অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। খুব শিগগিরই ভারত থেকে আরো ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে রামপালে যৌথভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। দুই দেশ এর মাধ্যমে সমানভাবে লাভবান হবে। মানুষে-মানুষে যোগাযোগ জোরালো করার পদক্ষেপের অংশ হিসাবে তিনি জানান- ইতিমধ্যে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে দুই দেশই লাভবান হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা ‘উইন উইন ফর্মুলা’। দুই দেশকে সম্পর্ক ধরে রাখতে হবে এবং সামনে এগিয়ে নিতে কাজ করতে হবে। সহযোগিতার এই ধারা অব্যাহত রাখতে নতুন নতুন উপায় খুঁজতে হবে। সম্পর্কের ধারাবাহিকতা না থাকলে দুই দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে মন্তব্য করে সচিব গোখলে বলেন, বাংলাদেশ ভারতের সম-মর্যাদা সম্পন্ন অংশীদার। আমরা আমাদের দু’দেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়গুলোসহ বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সমস্যা দুর করা ও উন্নয়ন সহযোগিতা নিয়ে কাজ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন