পহেলা বৈশাখ। বাংলা সনের প্রথম দিন। স্বাভাবিক কারণেই আমরা বাংলাদেশী হওয়ার কারণে এটি আমাদের আবেগে মিশে আছে। যে সব বৈশিষ্ট্য বাঙালি জাতিকে পৃথক করে রেখেছে তারমধ্যে অন্যতম বৈশাখ উৎসব তথা বাঙলা বর্ষবরণ। প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি থাকতে পারে। কিন্তু বাঙালিদের মত নিজেদের স্বতন্ত্র সন সবার নেই। সুতরাং এ দিক থেকে বাঙালিদের স্বাতন্ত্র্যই আলাদা। বলাবাহুল্য, এটি এ জাতির জন্য গর্বের, আনন্দের। উল্লেখ্য যে, বাংলা সন হিজরী সনেরই বাংলা সংস্করন। হিজরী সন চলে চাঁদের হিসাবে, বাংলা সন চলে সূর্যের হিসাবে। দুটি সনেরই প্রথম বছর মদীনার হিজরত। নবী করিম সা. এর স্মৃতি বিজড়িত এ সনের প্রবক্তা বাদশাহ আকবর। গবেষণা করে তৈরি করেছেন তার অন্যতম মন্ত্রী ইসলামী চিন্তাবিদ ও সৌরবিজ্ঞানী আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী।
এই গর্ব ও আনন্দের দিনটি শুরু হয় পয়লা বৈশাখ দিয়ে। তাই তার উচ্ছাসটা অন্যরকম হবে স্বাভাবিক। তবে নিঃসন্দেহে তা হতে হবে জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যের নিরিখে। অন্যথায় নিজের স্বকীয়তাটাই হারিয়ে যাবে। ধর্মীয় চেতনা বাদ দিলেও বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা ও উৎসব এখন বেশ প্রশ্নবিদ্ধ। ঐতিহ্য সংরক্ষণে যেমন অনেকে উৎসবের দিকে ধাবিত হয়ে পড়ছে, আবার এই উৎসবকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে অনেকে ঐতিহ্যের প্রেমে। কারো প্রশ্ন উৎসবের আয়োজন নিয়ে। কারো প্রশ্ন উৎসবের পদ্ধতি নিয়ে। যার মধ্যে পয়লা বৈশাখ অন্যতম গুরুত¦পূর্ণ প্রসঙ্গ।
বাঙলা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে বৈশাখের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাই বঙ্গাব্দের প্রথম দিন তথা পয়লা বৈশাখে বর্ষবরণ একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। সেই সুযোগে উৎসবের লেবাসে বাংলা সংস্কৃতিতে এমন কিছু আচার অণুপ্রবেশ করেছে, যেগুলোর সাথে বাংলা সংস্কৃতির কোন দূরতম সম্পর্কও নেই। অথচ নতুন প্রজন্ম সেগুলোকে মনে করছে বাংলা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একশ্রেণীর অসৎ বুদ্ধিজীবী ও সংকির্ণ কর্পোরেট অফিস এ উৎসবকে চরম সাম্রদায়িক রূপ দিচ্ছে। অন্য ধর্মের ধর্মীয় শতশত অনুসঙ্গ এতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আর সংস্কৃতির এমন কিছু উপাদানকে ভুলতে বসেছে যেগুলো ছাড়া বাংলা সংস্কৃতি দাঁড়াতেই পারে না। উদাহরণ স্বরূপ দেখুন, বৈশাখ উদযাপনে বিভিন্ন প্রাণী যেমন কুমির, হাতি ইত্যাদির প্রতিকৃতি নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন হয়। এসব তো কোনভাবেই বাংলা সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত কিছু নয় বরং এই শোভাযাত্রায় কালির লোহিতকরণ জিহŸা, গণেশের মস্তক এবং মনসার সর্পমূর্তির উল্কি ইত্যাদি নেয়া হয় যা সম্পূর্ণই হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতি; বাংলা সংস্কৃতি নয়। এবং বৈশাখী সম্পর্কিত কোন কিছু বোঝাতে এগুলোকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। শুধু তাই নয়, এই মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথেও বৈশাখের কোন সম্পর্ক নাই। এটা আশির দশকে দুর্গতদের সাহায্য করতে এমন একটি আয়োজন করা হয়েছিল। ১৬ এপ্রিল‘১৬ দৈনিক নয়াদিগন্তের জয়নাল আবেদীনের কলমে দেখুন, মঙ্গল শোভাযাত্রাকে মনে করা হয় বৈশাখী উৎসবের অন্যতম অঙ্গ। বাংলার লোকজ সংস্বৃতিতে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ শব্দের অস্তিত্ব নেই। যতদূর জানা যায়, চারুকলা ইনস্টিটিউট ১৯৮৮ সালের ২৯ডিসেম্বর জয়নুল জন্মোৎসব শোভাযাত্রা পালন করে। উদ্দেশ্য, বিভিন্ন বাসা থেকে কাপড়-চোপড়, টাকা-পয়সা ও খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ। শোভাযাত্রা চড়াই-উৎরাই পার পয়ে পহেলা বৈশাখে ঠাঁই করে নিয়েছে। পান্থা ইলিশের সাথেও বাঙালি সংস্কৃতির কোন আত্মীয়তা নেই। মঙ্গল শোভাযাত্রা আর পান্থা ইলিশ কোনোভাবেই আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয়।
বাংলা একাডেমি প্রণীত ব্যবহারিক বাংলা অভিধান সপ্তদশ পূণর্মদ্রণ: কোথাও ‘পান্তা-ইলিশ’ ও ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ শব্দ দু’টি নেই। বাংলা একাডেমির বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানে প্রাচীন সাহিত্য চর্যাপদ থেকে শুরু করে আধুনিক সাহিত্য পর্যন্ত বিখ্যাত লেখকদের উদ্ধৃতিসহ রয়েছে শব্দের ব্যুৎপত্তি, সেখানেও নেই ‘পান্তা-ইলিশ আর মঙ্গল শোভাযাত্রা’ শব্দদয়।”
বৈশাখী উৎসব পূঁজিবাদের একটি খেলা বৈ কিছু নয়। এ হল উন্মাদ পূঁজিবাদ তার উন্মাদনা নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ারই একটি প্রয়াস। এই পান্থা-ইলিশ উৎসবের রেওয়াজ চালু করেছে সেই পূঁজিবাদের হোতারাই। বটমূল এবং মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রচুর লোক সমাগম দেখে বসতে শুরু করে ইতালিয়ান(ইট-খুটি ও ত্রিপলযোগে বানানো) হোটেল। মাটির সানকিতে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার রেওয়াজ মূলত ইতালিয়ান হোটেলওয়ালাদের আবিষ্কার।
পুঁজিবাদের চাকা হল বস্তু। সংস্কৃতির উপর ভর করলে পুঁজিবাদ টিকতে পারবে না। আর একেকটি উৎসব মানে পুঁজিবাদের আখড়া। সুতরাং তার বাঁকা চোখ বোশেখ উদযাপনকে এড়িয়ে যাবে এমন ভাবনার কোন অবকাশ নেই। সেই পুঁজিবাদের খপ্পরে এখন আমাদের বৈশাখবাদ। সেই খপ্পরে পড়েই বৈশাখ এখন উন্মাদ-মেলাসর্বস্ব হয়ে পড়েছে। বৈশাখে সংস্কৃতিবোধের ধোঁয়া তোলে পান্থা-ইলিশ উৎসব। বৈশাখ মানেই নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা। অথচ বৈশাখের দিন এমন উৎসব বাংলার আবহমান কাল ধরে কখনোই ছিল না। ষাটের দশক থেকেই পয়লা বৈশাখের এই উৎসবের রেওয়াজ চালু হয়। ১৯৬৬ সালে প্রথম রমনার বটমূলে একটি উৎসব হয়। সেই উৎসবটিই ধীরে ধীরে আজ পুঁজিবাদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। নববর্ষ ছিল বাঙালিদের হালখাতার দিন। পুরাতন সব ঘুচিয়ে নতুন করে শুরু করা হতো। হিন্দু-মুসলিমদের ঘরে ভিন্নভিন্নভাবে এ সব হতো। মুসলমানরা মৌলভী আনিয়ে দোয়া, মাহফিল, মিলাদ করতো, ঘরের মেঝেতে গোলাপজল ছিটাতো। আর হিন্দু বাড়িতে গোবর লেপন,ধূপ জ্বালানো বা শংখধ্বনী বাজানো ইত্যাদি করা হতো। এ ছাড়া বৈশাখের দিনে এমন উৎসব বাঙালির ইতিহাসে পাওয়া যায় না।৩৭২ বঙ্গাব্দে(১৯৬৫) প্রথম এ উৎসব শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলার প্রভাতী অনুষ্ঠানেও নববর্ষকে সম্ভাষণ জানানো হয়।
বাংলা সনে যা উৎসব পাওয়া যায় তা চৈত্র মাসে। বর্ষের শেষ বলে রাজার খাজনা আদায়কে কেন্দ্র করে চৈসংক্রান্তিক উৎসব হতো। পহেলা বৈশাখ বা বঙ্গাব্দে মানুষ ‘হালখাতা’ করাসহ অন্যান্য সবকিছু নতুন করে শুরু করার প্রস্তুতি নিতো। আজ সংস্কৃৃতির কথা বলে বঙ্গাব্দে মেলা জমিয়ে পাঁচ টাকার পান্থা রমনীর হাতে হাজার টাকায় খাওয়ানো আর দারিদ্রের বদনে দাঁড়িয়ে উল্লাস করে ইলিশ বক্ষণ নামে যা করা হচ্ছে সবগুলোই পুঁজিবাদের খেলা। দরিদ্রের চোখে ধুলো দিয়ে লাখলাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কর্পোরেট সমাজ। হলুদ মিডিয়ার কল্যাণে পহেলা বৈশাখকে যেভাবে খাই খাই করে তোলা হচ্ছে প্রকৃত বৈশাখবাদের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং একজন বাঙালি হিসেবেই এর প্রতিবাদে সোচ্চার হোন। সতর্ক করুন আজকের প্রজন্মকে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে আপন আপন বলয় থেকে প্রতিরোধ করুন।
লেখক: কবি ও প্রবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন