নূরুল ইসলাম : দ্বিতীয় দফায় ভারত থেকে এলো আরও ২০টি নতুন কোচ। এ নিয়ে রেলওয়ের ব্রডগেজের জন্য নতুন কোচের সংখ্যা দাঁড়ালো ৪০-এ। এভাবে পর্যায়ক্রমে ভারত থেকে মোট ১২০টি বিলাসবহুল কোচ আসবে। অন্যদিকে, ইন্দোনেশিয়া থেকে মিটার গেজের জন্য ১৫টি কোচ নদীপথে আসছে এ মাসের মধ্যেই। ইতোমধ্যে সেগুলোর শিপমেন্ট হয়ে গেছে। নতুন লাল-সবুজ কোচগুলো রেলের বহরে কবে যোগ হবে সে ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এর আগে রেলমন্ত্রী আভাস দিয়েছিলেন চলতি বছরের জুন মাসেই নতুন কোচ দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু করবে। তবে একাধিক সূত্র দাবি করেছে, জুনের আগেই নতুন কোচগুলো রেল বহরে যোগ হতে পারে। লাল-সবুজ স্টিলের কোচগুলো নিয়ে ইতোমধ্যে রেল কর্তৃপক্ষসহ যাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে।
গত ২২ মার্চ ভারত থেকে লাল-সবুজ কোচের প্রথম চালান দর্শনা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আজ মঙ্গলবার সেগুলোকে সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে নিয়ে যাওয়া হবে ডি-প্রসেসিংয়ের জন্য। সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপ ম্যানেজার কুদরত-ই-খোদা গতকাল ইনকিলাবকে জানান, প্রথম দফায় আগত ২০টি কোচকে ডি-প্রসেসিংয়ের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ভারত থেকে ১০ জনের একটি প্রতিনিধি দল আজ আসছেন। তারাই প্রসেসিংয়ের কাজটি করবেন। ডি-প্রসেসিং শেষ হলে কোচগুলোকে পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হবে। লোড টেস্ট করা হবে। লোড টেস্টের জন্য প্রতিটি আসনে ইট বা বালুর বস্তা বসানো হবে। একজন যাত্রীর গড় ওজন ৭০ কেজি এবং তার মালামাল বাবদ আরও ২০ কেজি ওজনের বস্তা বসানো হবে প্রতিটি আসনে। এরপর ট্রেন চালানোর মাধ্যমে লোড টেস্ট করা হবে বলে ওই কর্মকর্তা জানান। পুরো লোড নেওয়ার পর কোচটি দোলে কিনা, কোনো শব্দ করে কিনা বা চাকায় ঘর্ষণ লাগে কিনা এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।
রেল সূত্র জানায়, গতকাল সোমবার বেলা ১২টা ১০ মিনিটে ভারতের রানাঘাট থেকে রওনা করে দর্শনা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে নতুন ২০টি কোচ। ভারতের একটি ইঞ্জিন দিয়ে কোচগুলোকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন সে দেশের ট্রেনচালক। দর্শনায় রেলওয়ের কর্মকর্তারা কোচগুলো রিসিভ করেন। এরপর প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সেগুলোকে দর্শনা ইয়ার্ডে রাখা হয়। আজ মঙ্গলবার ভোরে সেগুলো সৈয়দপুরের উদ্দেশ্যে রওনা করবে। রেল সূত্র জানায়, গতকাল রাতে কোচগুলো সৈয়দপুরের উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়নি নিরাপত্তার কথা ভেবে। রাতের অন্ধকারে কেউ ঢিল ছুঁড়ে কোচগুলোর ক্ষতি করতে পারে। দ্বিতীয় দফায় আগত ২০টি কোচের মধ্যে রয়েছে এসি স্লিপিং কোচ, এসি চেয়ার, শোভন চেয়ার, শোভন চেয়ার কাম ডাইনিং এবং পাওয়ার কার কাম শোভন চেয়ার কোচ। অত্যাধুনিক ও বিলাসবহুল কোচগুলো রেলওয়ের ব্রডগেজের জন্য তৈরি।
সূত্র জানায়, ভারতের পাঞ্জাবের কাপুরথালা কারখানায় তৈরি হচ্ছে কোচগুলো। অস্ট্রিয়ান টেকনোলজিতে তৈরি বিলাসবহুল এই কোচগুলো লিঙ্ক হোপম্যান বুশ (এলএইচবি) ব্রান্ডের। ভারতের বিলাসবহুল ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’ ও ‘শতাব্দী এক্সপ্রেস’ ট্রেনে এই কোচগুলো ব্যবহার করা হয়। এলএইচবি কোচের চেয়ার ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরা অত্যন্ত বিলাসবহুল। এছাড়া এবারই প্রথম শোভন চেয়ার শ্রেণিতে থাকছে খাবার মজুদের (প্যানট্রিকার) স্থান এবং নামাজের জায়গা। এতে করে যাত্রীরা খাবারের অর্ডার দেওয়ার সাথে সাথে খাবার সরবরাহ করা সম্ভব হবে। খাবারের কোচের (বুফে কার) জন্য দূরে যেতে হবে না। থাকছে নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থান এবং সার্বক্ষণিক বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা।
সূত্র জানায়, ব্রডগেজের জন্য তৈরি ১২০টি কোচের মধ্যে শোভন চেয়ার শ্রেণির মোট ৩৪টি কোচ আসবে। এর মধ্যে ১৭টি কোচে খাবার মজুদের স্থান (প্যানট্রিকার) থাকবে। বাকী ১৭টিতে থাকবে নামাজের জায়গা। অর্থাৎ যে কোচে খাবার মজুদের ব্যবস্থা থাকবে সেখানে নামাজের জায়গা থাকবে না। যাত্রীদের সুবিধার্থে এই দুই ধরনের কোচ পর পর সংযোজন করা হবে। যাতে দুই ধরনেরই সুবিধা পায় যাত্রীরা। সূত্র জানায়, যাত্রীদের বিলাসবহুল সেবা প্রদানের জন্য ট্রেনে বিদ্যুৎ সরবরাহ নির্বিঘœ করা জরুরি। বিষয়টা মাথায় রেখে লাল-সবুজ স্টিল কোচের বহর সাজানো হয়েছে। তাতে প্রতিটি ট্রেনের সামনে এবং পেছনে দুটি করে পাওয়ার কার থাকবে। বর্তমানে আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে একটাই পাওয়ার কার ট্রেনের মাঝখানের অংশে থাকে। অন্যদিকে, এসি বার্থ এবং এসি চেয়ার শ্রেণিগুলো হবে অত্যন্ত বিলাসবহুল আরামদায়ক। বার্থগুলোর সেবার মান হবে অনেকটা তিন তারকা হোটেলের মতো। খাবারের পাশাপাশি বইপড়া, মোবাইল চার্জারসহ বিনোদনের ব্যবস্থাও থাকবে। এসির পাশাপাশি ননএসি বার্থ এবং প্রথম শ্রেণির কামরাও থাকবে। এসি-ননএসি চেয়ারেও যাত্রীরা আরাম করে ঘুমাতে পারবেন।
অন্যদিকে, ইন্দোনেশিয়া থেকে মিটার গেজেরে জন্য প্রথম দফায় আসছে ১৫টি কোচ। লাল-সবুজের স্টিলের বিলাসবহুল কোচগুলো রেলওয়ের ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ট্রেনসহ বিভিন্ন আন্তঃনগর ট্রেনের সাথে যুক্ত হবে। পর্যায়ক্রমে আসবে আরও ১৩৫টি। এর মধ্যে ৫০টি কোচ ব্রডগেজের। রেল সূত্র জানায়, গত ২৩ মার্চ এমজি কোচগুলো ইন্দোনেশিয়ার বিখ্যাত ইনকা রেল ফ্যাক্টরি থেকে তানজুং বোরাক বন্দরে নেওয়ার পর সেগুলো জাহাজে তুলে দেওয়া হয়। সমুদ্রপথে এখন সেগুলো বাংলাদেশের পথে। জাহাজে করে কোচগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে আসবে। আগামী ২০ থেকে ২৫ এপ্রিলের মধ্যে এগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছার কথা। প্রথম চালানে ১৫টি কোচের মধ্যে রয়েছে ১১টি শোভন চেয়ার, ২টি চেয়ার কোচ, খাবারের গাড়ি ও গার্ডব্রেক, ১টি পাওয়ার কার এবং ১টি প্রথম শ্রেণির কোচ। ইন্দোনেশিয়ার ইনকা কোম্পানির ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, মিটার গেজের জন্য মোট একশ’টি কোচের মধ্যে ১৩টি এসি স্লিপার, ২৪টি এসি চেয়ার, ৩৬টি শোভন চেয়ার, ১৩টি ডাইনিং, গার্ডব্রেক ও প্রেয়ার স্পেস কার, ৮টি পাওয়ার কার এবং ৬টি প্রথম শ্রেণি ননএসি স্লিপার কোচ রয়েছে। রেল সূত্র জানায়, বিলাসবহুল এসব কোচ দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বিরতিহীন একটি বিলাসবহুল ট্রেন সার্ভিস চালু করার পরিকল্পনাও আছে। বিরতিহীন যে ট্রেন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবে সাড়ে চার ঘণ্টায়। ট্রেনটি পুরোপুরি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা যায় কি না তা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা চলছে। আগামী জুন মাস থেকে ট্রেনটি চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে চলছে মহানগর প্রভাতী, মহানগর গোধুলী, সুবর্ণ এক্সপ্রেস ও তুর্ণা নিশিথা। এগুলো প্রতিদিন আটবার আসা-যাওয়া করে। রেলওয়ের ম্যাকানিক্যাল বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী জানান, বর্তমানে আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে যেসব কোচ যুক্ত আছে সেগুলো থেকে স্টিলের লাল-সবুজ কোচগুলো অনেক উন্নত। এগুলোর সিট, দরজা, জানালা ও টয়লেট তুলনামূলক চওড়া। জানালার গ্লাসগুলো আধুনিক মানের। কোচগুলোতে খাবার সংরক্ষণ করার ব্যবস্থাসহ সার্বক্ষণিক ঠা-া ও গরম পানি সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। আছে নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থান, যা প্রতিটি ট্রেনের এক কোচ পর পর যুক্ত থাকবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন