আসন্ন একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে শুরু হয়েছে আসন নিয়ে দর কষাকষি। প্রার্থীদের তালিকা নিয়ে বর্তমান সংসদের ‘বন্ধুপ্রতীম’ বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চলছে আসন ভাগাভাগী নিয়ে দর কষাকষি। দেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি নির্বাচনে আসলে এ দর কষাকষি অন্যরকম হতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন। আর বিএনপি আগের মতো নির্বাচনের বাইরে থাকলে শরিকরা দর কষাকষিতে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বিগত নির্বাচনে ১৪ দলের শরিকদের এবার দেয়া হতে পারে ১৫টি আসন। বিএনপি নির্বাচনে এলে এবং জাতীয় পার্টি মহাজোটে ফিরে এলে তাদেরও বিগত নির্বাচনের চেয়ে এবার কিছুটা আসন বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে আলাপে এ বিষয়ে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, এবছরের ডিসেম্বরেই অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ভোট চাইছেন দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় নৌকায় ভোট দিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার আহŸান জানিয়ে আসছেন। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মহাজোটের অন্যতম শরিক জাপার মনোনয়ন প্রত্যাশীরাও মাঠ চয়ে বেড়াচ্ছেন। বসে নেই ১৪ দলীয় জোটের শরিকরাও। জানা গেছে, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসায় এবার জনগণের দুয়ারে-দুয়ারে ভোট চাইছেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ও ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা। আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে জোটবদ্ধ লড়াইয়ে এরইমধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। নিজ নিজ এলাকায় ওঠান বৈঠক, সভা-সমাবেশ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আগ্রহী প্রার্থীরা তৃণমূলের মনজয়ের চেষ্টা করছেন সর্বশক্তি দিয়ে। এরইমধ্যে মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পাটির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৭০টি আসন ও পরবর্তি সরকারে ১০/১২টি মন্ত্রণালয় দাবি করেছেন। তিনি বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে শরিক হয়ে থাকতে চাই। তাই রংপুর অঞ্চলের ২২টি আসনসহ মোট ৭০টি আসন চাই। আসন ও চাহিদা মত মন্ত্রণালয় না দিলে এককভাবে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়ার হুমকী দেন এরশাদ।
তবে, সংসদে বিরোধীদল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের হুমকির বিষয়ে গত সোমবার সকালে কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। মানিক মিয়া এভিনিউয়ে মোবাইল কোর্ট পরিদর্শনে গিয়ে তিনি আগামী নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি এবং মন্ত্রীত্ব নিয়ে এরশাদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আপনি কত সিট চান, এটা তো আমরা জানি। আমাদের কাছে অলরেডি আপনাদের তালিকা আছে। এটা পত্রিকায় দেয়ার দরকার নেই। প্রকাশ্যে বলার কি আছে?
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এরশাদের ১০-১২টি মন্ত্রণালয় দাবি বিষয়ে কাদের বলেন, মন্ত্রীত্ব এই মুহুর্তে দাবি করার বিষয় নয়। মন্ত্রীত্ব তখনই ঠিক হবে, যখন আমরা এলায়েন্স হয়ে সরকার গঠন করবো। তখন মন্ত্রীত্বের বিষয় আসবে, কে কতটা মন্ত্রণালয় পাবে। আর সরকার গঠনের সময় মন্ত্রী দেয়া না দেয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত দেবেন।
যেসব আসন দাবি জাপা ও ১৪ দল শরিকদের: একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে স¤প্রতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে ১০০ আসন চেয়ে একটি তালিকা পাঠিয়েছে জাতীয় পার্টি। সংসদের বিরোধীদলের পক্ষ থেকে চাওয়া আসনগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বহু আসন রয়েছে। যা শুধু আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টি নয় আগামীতে ক্ষমতায় আসতে মূর্খ্য নিয়ামকের ভূমিকা পালন করতে পারে। জাপার দেয়া তালিকায় বর্তমান সংসদের ৩৪ সংসদ সদস্যের নাম রয়েছে। জাতীয় পার্টির চাওয়া আসনগুলো মধ্যে যেমন বিভাগীয় জেলার সদরের আসন রয়েছে, তেমনি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ আসনও দাবি করা হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব গুরুত্বপূর্ণ তারমধ্যে রয়েছে: ঢাকা-১ আসনে সালমা ইসলাম, ডেমরা-যাত্রাবাড়ী-কদমতলী মিলিয়ে ঢাকা-৫ আসনে মীর আব্দুস সবুর আসুদ, ঢাকা-৬ আসনে সাবেক মন্ত্রী কাজী ফিরোজ রশীদ, ময়মনসিংহ-৪ এ রওশন এরশাদ। রংপুর-১ মশিউর রহমান রাঙা, তাজুল ইসলাম চৌধুরী কুড়িগ্রাম-২, এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার পটুয়াখালী-১, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মজিবুল হক চুন্নু কিশোরগঞ্জ-৩, ঢাকা-৪ আসনে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে নাসিম ওসমান, সিলেট-৫ আসনে সেলিম উদ্দিন, চট্টগ্রাম-৫ আসনে পানি সম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, চট্টগ্রাম-৯ আসনে জিয়াউদ্দিন বাবলুসহ অনেকের নাম তালিকায় রয়েছে।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, গত দশম সংসদ নির্বাচনের সময় জাপার পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের কাছে জমা দেয়া ৭০ প্রার্থীর নাম এবারও বহাল আছে। বাকি ৩০ জনের নাম জাপার জোটের শরিক নেতাদের থেকে নেয়া হয়েছে। জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, তারা এককভাবে ৩০০ আসনের প্রার্থী তালিকা ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করেছেন। এরমধ্যে সম্ভাবনাময় প্রার্থী হিসেবে ৭০ জনের নাম প্রথম তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে ১৪ দল ও জাতীয় পার্টির মধ্যে সমঝোতায় আসন ভাগাভাগি হবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে সরকার গঠন করবে এরশাদের জাপা। যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয় তাহলে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে ১৪ দলের সঙ্গে লড়বে দলটি। শক্তিশালী বিরোধীদলের জায়গায় নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে চায় জাতীয় পার্টি।
এ বিষয়ে জাতীয় পাটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আবদুস সবুর আসুদ জানান, যেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বদনাম রয়েছে সেখানে জাপার পক্ষ থেকে ক্লিন ইমেজের প্রার্থী দেয়া হতে পারে। অর্থাৎ নিশ্চিত বিজয় হবে এমন পরিকল্পনা থেকেই প্রার্থী চূড়ান্ত করবে জাতীয় পার্টি। তিনি জানান, জোটগতভাবে এবার ঢাকা-৬ আসন জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে আমি দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ করে যাচ্ছি।
সুত্রমতে, গত দশম জাতীয় সংসদ (২০১৪ সাল) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলো ৬০ আসনে প্রার্থীতা চাইলেও শেষ পর্যন্ত পেয়েছে ১৮টি। এবার তাদের দাবি একশ আসন। দশম সংসদ নির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টি ৫টি আসন চেয়ে পেয়েছিল ৩টি। আগামী নির্বাচনে দলটি ১৫ আসন দাবি করছে। অন্যদিকে গত নির্বাচনে ৭টি আসনে নৌকা প্রতীকে লড়াই করা জাসদ এবার দ্বিগুণ আসন দাবি করছে। নির্বাচনের আগেই ১৪ দলীয় জোটের শরীকরা আসন নিয়ে এখন থেকেই দরকষাকষি শুরু করেছে।
এদিকে শরিক সব দলই আগামী নির্বাচনের জন্য তাদের দলীয় প্রার্থীর তালিকাও ইতোমধ্যে তৈরি করে ফেলেছে। বেশিরভাগ দলই নিজস্ব প্রার্থীর তালিকার পাশাপাশি দরকষাকষির জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাও করে রেখেছে। জয়লাভের সম্ভাবনা বিবেচনায় এনেই এসব তালিকা করা হচ্ছে বলে দাবি শরিক দলগুলোর নেতাদের। সব মিলিয়ে ১৪ দলের শরিকরা আগামী নির্বাচনে ৭০ থেকে ৮০টি আসনের নিশ্চয়তা চাইছে আওয়ামী লীগের কাছে।
শরীক নেতারা জানান, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি আগামী নির্বাচনে অন্তত ১৫টি আসনে জোটের মনোনয়নের নিশ্চয়তা চাইছে। তবে দলের পক্ষে ৩০টি আসনের দলীয় প্রার্থী তালিকা তৈরি করে রাখা হয়েছে। দলের সভাপতি সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের ঢাকা-৮ ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশার রাজশাহী-২ আসনসহ বর্তমান সংসদের নির্বাচিত দলীয় ৬ এমপির আসন তাদের প্রত্যাশায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে। একইভাবে জাসদ সভাপতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর কুষ্টিয়া-২ ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারের ফেনী-১ আসনসহ ১৫টি আসন চাইছে দলটি। জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পিরোজপুর-২ ও সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলামের মাদারীপুর-৩ অথবা অন্য যে কোনো আসন এবং তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর চট্টগ্রাম-২ ও সদ্য অপসারিত মহাসচিব এমএ আউয়ালের লক্ষীপুর-১ আসনসহ ১৫টি আসনের দাবি তুলেছে এ দুই দল। জোটের আরেক শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়ার চট্টগ্রাম-১ আসনসহ অন্তত ৬টি আসন চায়। গণতন্ত্রী পার্টি সভাপতি ব্যারিস্টার আরশ আলীর সিলেট-১ আসনসহ ১০টির বেশি আসনে মনোনয়নের নিশ্চয়তা চায়। কমিউনিস্ট কেন্দ্র চাইছে দলের আহŸায়ক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান ও যুগ্ম আহŸায়ক ডা. অসীত বরণ রায়ের জন্য দুইটি আসন। এছাড়া ন্যাপ, গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি এবং বাসদসহ শরিক অন্য দলগুলো মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে ‘যথাযথ মূল্যায়ন’ আশা করছে আওয়ামী লীগের কাছে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১৪দলীয় জোটের শরিক একজন নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ একটু সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলে তখন শরিক দলের নেতাদের ভুলে যায়। আর যখন বিপদে পড়ে তখন তাদের কথা মনে পড়ে। আগামী নির্বাচনে তাদের কৌশল কি হবে তা নিয়ে শরিকদলগুলো শঙ্কায় রয়েছে বলেও জানান তিনি। আরেকজন নেতা বলেন, শরিক নেতাদের মধ্যে কয়েকজন সুবিধা পেয়ে নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন। এতে করে অন্য দলের নেতারা খুবই ক্ষুব্ধ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন