হাসান সোহেল : সুশাসনের অভাবে ব্যাংক খাতে নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদায়ী গভর্নর এ খাতের উন্নয়নে গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা নির্ধারণের বদলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন। তিনি পুরস্কার, পদক আর সংবর্ধনার প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকে গত ৭ বছরে মূল কাজের অগ্রগতি হয়নি। এ সময়ে অন্যান্য সেক্টরের অগ্রগতি হলেও ব্যাংক ব্যবস্থাপনা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরে রয়েছে। তিনি ব্যাংকিং সেক্টরে নজরদারির বদলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় গবেষণা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, হিমাগার ও পরীক্ষামূলক বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। আর যে কারণে এই সময়ে হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, ডেসটিনি, যুবক, থার্মেক্স, বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ আর্থিক খাতে অনেক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এসব কেলেঙ্কারিতে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি চুরি বা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে প্রায় ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে। এই অর্থ ফিরিয়ে আনা বা তদন্ত কোনো কিছুই আজও হয়নি। এসব ঘটনার সর্বশেষ সংযোজন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা। গত ৫ ফেব্রুয়ারি চুরি করা হয় ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।
এমন পরিস্থিতিতে আর্থিক খাত নিয়ে সরকারকে আরও বেশি চিন্তা-ভাবনার পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। অবশ্য সরকারের নীতি-নির্ধারকরাও বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত, এই খাতে শৃঙ্খলা ধরে রাখা। এছাড়া আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা রক্ষায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য অনেক অর্থনীতিবিদ শক্তিশালী কমিশন গঠনের জন্য মত দিয়েছেন। আবার অনেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান আইনের মাধ্যমেই শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্ভব বলে মনে করছেন। একই সঙ্গে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সাথে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে। এজন্য ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক দৃঢ়তা। ব্যাংকিং খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখারও পরামর্শ তাদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান দুজনেই মনে করেন, মূলত সুশাসনের অভাব থেকেই একের পর আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। আর ব্যবস্থা না নেওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, হলমার্ক থেকে শুরু করে বেসিক ব্যাংক বা বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারির ঘটনায় সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত লোকজন জড়িত ছিলেন বলেই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অবশ্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ব্যাংকিং কমিশন আপাতত গঠন করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, ব্যাংকিং কমিশন করার এখন কোনো ইচ্ছা নেই আমার। কারণ ব্যাংকিং খাতে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। সেখানে যেসব ইনকোয়ারি হচ্ছে, সেগুলো লিমিটেড ইনকোয়ারি। এটার ফল-টল দেখা দরকার। তারপর ঠিক করা যাবেÑ ব্যাংকিং কমিশন করার প্রয়োজন কী আছে, বা থাকলে কীভাবে সেটাকে কাস্ট করা যায়। যদিও সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার ও উন্নয়নে চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কথা বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিওইএফ) কিছু দিন পূর্বে বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদন ফান্ড শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনের জরিপে বাংলাদেশের নির্বাহীরা বলেছেন, ব্যবসা করার জন্য এ মুহূর্তে তাদের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো সুশাসনের অভাব। সুশাসনের অভাব বলতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা ও অচলাবস্থা এবং সর্বগ্রাসী দুর্নীতিকে বুঝিয়েছেন। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ঝুঁঁকির বিষয়টিও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
সূত্রমতে, হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংকের মাধ্যমেই ব্যাংকিং খাত থেকে আত্মসাৎ করা হয় ৯ হাজার কোটি টাকা। বিসমিল্লাহ গ্রুপের ১২০০ কোটি টাকা, থার্মেক্সের ৮০০ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়। এরপর ডেসটিনি গ্রুপ ও যুবক। সর্বশেষ রিজার্ভ চুরির ঘটনা। সবগুলোই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সাথে জড়িত। এতদিন দেশের ভেতরে আলোচনা-সমালোচনার পর, এবার রিজার্ভ চুরির ইস্যু নিয়ে সরগরম আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও। তাই ব্যবসায়ীরা বলছেন, আস্থা ফেরাতে সরকারকে এখন মনোযোগী হতে হবে।
গত ৭ বছরে আরও কিছু কেলেঙ্কারি ঘটলেও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কম। যেমন, বেনিটেক্স লিমিটেড, মাদার টেক্সটাইল মিলস ও মাদারীপুর স্পিনিং মিলস নামে তিনটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে গেছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। আবার বহুতল ভবন নির্মাণে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ৩শ কোটি টাকা ঋণ নেয় মুন গ্রুপ। আর দেশের সর্বশেষ লাইসেন্স পাওয়া ফারমার্স ব্যাংকও অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় ৪শ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে।
মুদ্রানীতি তৈরি করা মূল কাজ হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সে জায়গা থেকে সরে এসেছে কিনা জানতে চাইলে অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ হওয়া উচিত। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় আইটি খাতের দুর্বলতা ছিল স্বীকার করে তিনি বলেন, ব্যক্তি হিসেবে কে কে জড়িত ছিলেন, সেটি তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বেরিয়ে আসা উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক প্রভাব ও চাপ থেকে মুক্ত না হলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সংস্কার কোনো সুফল বয়ে আনবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ও জবাবদিহিতা আরও বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দৃঢ়তা দরকার। রাজনীতিবিদদের মনে রাখতে হবে, ব্যাংকের মতো একটি প্রযুক্তিনির্ভর খাতকে সবসময় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা উচিত। এটা না হলে সুফল আসবে না। ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্ব দিয়ে আসা এই অর্থনীতিবিদ নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, বিভিন্ন চাপ সামলে বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি শক্ত অবস্থান নিতে হবে। নইলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো সমাধান করা যাবে না।
দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো ব্যাংকিং খাত। ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে অনেকদিন থেকে। ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। সুশাসনের চর্চার বদলে অনিয়ম ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে নৈরাজ্য চেপে বসেছে। যে কারণে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং বেসরকারি ব্যাংকে ঋণদানের ক্ষেত্রেও অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, অসততার নতুন নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াতে গিয়ে দেশের ব্যাংকগুলোকে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
গত ৭ বছরের বড় এসব আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে সর্বস্বান্ত করেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের একটি অংশ ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাতে সহযোগিতা করেছে, নিজেরাও লাভবান হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছাড় দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একটি কেলেঙ্কারিরও বিচার হয়নি। সাজা পাননি অভিযুক্তদের কেউ। প্রাথমিক তদন্ত হয়েছে। বছরের পর বছর মামলা চলছে। অভিযুক্তদের কেউ জেলে আছেন, কেউ চিকিৎসার নামে হাসপাতালে আরাম-আয়েশে আছেন। অনেকে জামিন পেয়েছেন।
যদিও রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর দেশের আর্থিক খাতকে নতুন করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। যার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরে পদত্যাগ, দুই ডেপুটি গভর্নরের অব্যাহতি, সচিবকে ওএসডি করাসহ বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়ন করা হচ্ছে। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবার এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান ও ইআরডির বর্তমান সচিব মেজবাহ উদ্দিন আহমেদকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছেন। অবশ্য কয়েকদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে খোদ অর্থমন্ত্রীই এমন আভাস দিয়েছিলেন। তারপর থেকেই এই দুই পদে নতুন কাউকে দেখা যাচ্ছে না বলে গুঞ্জন চলছিল। এছাড়া খুব শিগগিরই আর্থিক খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদেও পরিবর্তন আসছে বলে জানা গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, বেশকিছু দিন ধরেই অর্থ মন্ত্রণালয় এবং এর বিভিন্ন বিভাগে কিছু পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। এখন তার আলামতও দেখা যাচ্ছে।
রিজার্ভ চুরির পর প্রায় এক মাস অর্থমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি লুকিয়ে রাখার কারণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন উঠে সব মহলে। এরপরই অর্থ মন্ত্রণালয় এই খাতকে ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যারা টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, তাদের সঙ্গে ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের যোগসাজশ রয়েছে। আবার ওই পরিষদের সদস্যরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কিংবা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। তাই অনিয়মের বিষয়টি জানা সত্ত্বেও সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। তিনি মনে করেন, এভাবেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি জেঁকে বসেছে। এ সংস্কৃতি দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষা দেয়, আবার অন্যকে দুর্নীতি করতে উৎসাহ জোগায়। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এ দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আর্থিক এসব জালিয়াতি কমাতে তিনটি পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, যারা অপরাধী, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শুধু বিভাগীয় শাস্তি হিসেবে বরখাস্ত, বদলি নয়; অপরাধের দায়ের শাস্তি দিতে হবে। এ ছাড়া সৎ, দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের সঠিক জায়গায় বসাতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন, সন্দেহ রয়েছে। আর সবশেষ হচ্ছে, ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত অবস্থান নিতে হবে, এ প্রতিষ্ঠানটিকে মূল ব্যাংকিংয়ের দিকে নজর দিতে হবে। তিনি মনে করেন, ব্যাংক খাত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। ব্যাংকিং খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ দেওয়া উচিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন