সায়ীদ আবদুল মালিক
ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশনের ছোটবড় সাত শতাধিক সড়কে একযোগে চলছে নিরন্তর খোঁড়াখুঁড়ি। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে নেই কোন সঠিক তদারকি। ঠিকাদাররা যে যেমন খেয়ালখুশি মত কাজ করছে। একটু বৃষ্টিতেই কাদা-পানিতে একাকার হয়ে রাস্তায় চলাচলের উপায় থাকে না। রাস্তার মাঝখানে যখন তখন বিকল হয়ে যাচ্ছে গাড়ি। প্রতিনিয়তই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। অফিস-আদালতমুখী মানুষ ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা সকাল বেলায় ঘর থেকে বের হয়েই পড়ছে চরম ভোগান্তিতে। কোথায়ও অসহনীয় যানজটে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে আবার কোথায় যানবাহনের সঙ্কটে পড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ইচ্ছা থাকলেও ময়লা, কাদা-পানি ও পিচ্ছিল রাস্তায় পায়ে হাঁটাও সম্ভব হয় না। এতে সময়মতো পরীক্ষার হলে পৌঁছাতে পারছে না ছাত্র-ছাত্রীরা। যানজটের কারণে সময়মতো বিমান বন্দরে পৌঁছাতে না পারার কারণে অনেক যাত্রীকে বিমানের সিডিউল মিস করতে হচ্ছে। যে কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে রিকশা বা সিএনজি করে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
অন্যদিকে আবার রোদ উঠলে বাতাসে ধুলাবালি উড়ে চোখ-মুখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাসের সাথে এ ধুলাবালি নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট ও এজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের চর্ম ও যৌন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডা. আহম্মাদ আলী ইনকিলাবকে বলেন, বাতাসের সাথে মিশে থাকা ধুলাবালি শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে মানুষের ফুসফুসে গিয়ে পৌঁছায়। এতে করে মানুষ কাশি, যক্ষ¥া, শ্বাসকষ্ট ও এজমাসহ নানা জটিল কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। যে কারণে মানুষের ফুসফুস অস্তে আস্তে কর্মক্ষমহীন হয়ে পড়ে। যা মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার নানা শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন ও উত্তরের মেয়র আনিসুল হক নির্বাচনের আগে যেসব প্রতিশ্রুতি ও আশার বাণী নগরবাসীকে শুনিয়েছিলেন তার বিন্দুমাত্রও বাস্তবায়ন এখনও হয়নি। অনেকেই অভিযোগ করে বলেছেন, রাস্তায় নামলেই যানজটের কবলে পড়তে হচ্ছে। ফুটপাত দিয়েও হাঁটার উপায় নাই। দুই সিটিতেই চলছে হকার উচ্ছেদের নামে ইঁদুর বিড়াল খেলা। দীর্ঘ দিনধরে নেই মশা নিধন কার্যক্রম। মশার যন্ত্রণায় ঘরে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দুই মেয়র আছে শুধু টিভি ক্যামেরার সামনে চেহারা দেখানো আর এই করবো সেই করবো ধরেনের বড় বড় কথা নিয়ে। কাজের কাজ কিছুই দৃশ্যমান নাই।
গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীর অভিজাত এলাকা উত্তরা মডেল টাউনের বিভিন্ন রাস্তা, গুলশান, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, কুড়িল, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, খিলগাঁও, বাসাবো, মুগদাপাড়া, মানিকনগর, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকার বিভিন্ন রাস্তা, মতিঝিল, শাহজাহানপুর, শাহবাগ, এ্যালিফেন্ট রোড, হাতিরপুল, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের বিভিন্ন রাস্তাঘাট সরজমিনে পরিদর্শন করে এমনই চিত্র দেখা গেছে।
রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন সড়ক ও অলি-গলিতে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এছাড়ও ভাঙাচোরা রাস্তা মেরামতের কাজ করছে সিটি কর্পোরেশন। যে কারণে রাজধানীর প্রায় সব রাস্তাই এখন খোঁড়াখুঁড়ির কবলে পড়েছে। প্রতি বছর ৩১ মে’র মধ্যে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শেষ করার নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে থাকলেও এ বছর তা সম্ভব হবে না। কারণ এ বছর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন একসাথে সাত শতাধিক সড়ক মেরামত ও উত্তর সিটি কর্পোরেশন গুলশান-২ এর একটি সড়ক মেরামতের কাজসহ বড় বড় কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে। সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, এ কাজ শেষ হতে আরও ৮/৯ মাস সময় লেগে যেতে পারে। এদিকে অতিগুরুত্বপূর্ণ কোন কারণ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির অনুমোদন না দেয়ার জন্য ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে। এছাড়া সরকারী নিয়ম অনুযায়ী ২৮দিনের মধ্যে উন্নয়ন কাজ শেষ করে পুনরায় রাস্তা মেরামত করে দেয়ার কথা থাকলেও উন্নয়ন কাজ শেষে মাসের পর মাস রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা বেহাল অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা কর্মীরা এ সব উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি করে থাকেন। তাদের খেয়াল খুশি মতোই এ কাজগুলো শুরু ও শেষ হয়। সরকারী নিয়ম-নীতির ধার ধারেনা এরা। এ নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলেও তাকে আবার নাজেহাল হতে হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ইনকিলাবকে বলেন, নগরবাসীর নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেইতো সিটি কর্পোরেশনকে এ উন্নয়ন কাজ মূল কাজ করতে হচ্ছে। এধরনের কাজ করতে গেলে কিছু সমস্যাতো হতেই পারে। এ জন্য নগরবাসীকেও কিছুটা ভোগান্তি সহ্য করতে হবে। উন্নয়ন কাজ চলা সময়ের ভোগান্তির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে মেয়র নগরবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন।
সরজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর বাংলামোটর থেকে নিউ ইস্কাটন এলাকার দিলু রোড পর্যন্ত রাস্তা খুঁড়ে পানি সরবরাহ লাইন স্থাপন করছে ঢাকা ওয়াসা। দিলু রোডের মাঝ বরাবর খোঁড়ায় ও শ্যালোইঞ্জিন বসানোর কারণে ওই সড়কে কোনো ধরনের যানবাহন প্রবেশ করতে পারছে না। এতে কাদাযুক্ত পানি মাড়িয়ে সাবধানে যাতায়াত করতে হচ্ছে স্থানীয়দের। অন্যদিকে মগবাজার মোড় থেকে পরিবাগ পর্যন্ত এবং রামপুরার উলন রোড থেকে মালিবাগ পর্যন্ত রাস্তা খুঁড়ে বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপনের কাজ করছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। এ এলাকার বাসিন্দাদেরও ভোগান্তির অন্ত নেই।
শুধু এই কয়টি স্থানে নয়, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে গুলশান, নিকেতন ও মিরপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। দিনের বেলায় ব্যস্ততম সড়কগুলো খোঁড়াখুঁড়ি করে উন্নয়নকাজের কারণে অন্তহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে জনসাধারণকে। অন্যদিকে এসব খোঁড়াখুঁড়ির কারণে প্রধান সড়কসহ গলিপথে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। আর এ যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে মৌচাক-মগবাজার উড়াল সড়কের নির্মাণকাজ চলায় সড়কগুলো এমনিতেই সরু হয়ে আছে। এতে রাস্তায় যানজট লেগেই থাকে। তার ওপর নতুন করে ওয়াসা ও ডিপিডিসিসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ভূগর্ভস্থ লাইন স্থাপনের কাজ শুরু করায় মানুষের ভোগান্তি আরও বেড়েছে। তারা বলেন, সরকারি সংস্থাগুলো জনগণের ভোগান্তির বিষয়টি চিন্তা না করেই নিজেদের খেয়ালখুশিমতো খোঁড়াখুঁড়ি করছে, আবার নির্মাণকাজ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি সড়ক ও ফুটপাতের ওপর ফেলে রাখায় চলাচলের পথ সরু হয়ে আছে। এতে নির্মাণকাজ চলা কোনো কোনো এলাকার মানুষ যানবাহন ছেড়ে হেঁটেই কর্মস্থলে যাতায়াত করছেন।
সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানায়, বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সিটি কর্পোরেশন কিছু শর্তসাপেক্ষে সড়ক খোঁড়ার অনুমতি দিয়ে থাকে। শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলোÑ জনদুর্ভোগ হয়, এমন সময় সড়ক খোঁড়া যাবে না। প্রধান সড়কগুলোতে খোঁড়াখুঁড়ি করতে হবে রাতে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সড়ক খননকাজ শেষ করা। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৮ দিন পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু যেসব সংস্থা খোঁড়াখুঁড়ি করে সেগুলো বেশিরভাগ সময়ই এ নিয়মের তোয়াক্কা করে না।
দিলু রোডের বাসিন্দা জহির আহমেদ বলেন, বাংলামোটর থেকে দিলু রোড পর্যন্ত ওয়াসা ভূগর্ভস্থ পানির লাইন স্থাপনের জন্য সড়কের মাঝ বরাবর খুঁড়ে দুই পাশে মাটি স্তূূপ করে রেখেছে। আবার সড়কের মাঝখানে শ্যালোপাম্প বসিয়ে ড্রেন থেকে ময়লাযুক্ত পানি তুলে সড়কের এক পাশে ফেলছে। এতে সড়কের বেশিরভাগ থাকে কর্দমাক্ত। এমনিতেই এখন এলাকায় রিকশা, গাড়ি কিছুই ঢুকতে পারে না। তার ওপর যদি রাস্তা হয় কর্দমাক্ত, তাহলে হাঁটাচলাই দায় হয়ে পড়ে। তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, যারা এসব কাজ করছেন, তারা স্থানীয়দের বিষয়টি বিবেচনা করে কাজ করলে আমাদের ভোগান্তি কম হতো।
পূর্ব শ্যাওড়াপাড়ার বাসিন্দা মিয়া হোসেন বলেন, হাজি আশ্রাফ আলী স্কুল রোড থেকে শুরু হয়ে রানওয়ের উত্তর প্রান্ত থেকে উত্তর কাফরুল এবং ইব্রাহিমপুর পাকার মাথা পর্যন্ত খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। তিনি বলেন, এ এলাকার রাস্তাগুলো কিছুদিন আগেও খোঁড়া হয়েছিল। এখন আবার খোঁড়া হচ্ছে। একবার খোঁড়ে ওয়াসা, একবার খোঁড়ে ডিপিডিসি, একবার খোঁড়ে তিতাস। সরকারি একেক সংস্থা একেকবার খোঁড়াখুঁড়ি করায় সারা বছরই এসব রাস্তা ব্যবহারের উপায় থাকে না। আবার কোনো কোনো সময় রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ রেখে কাজ করা হয়। এসব রাস্তা দিয়ে যে মানুষ ও যানবাহন চলে, সে চিন্তাই যেন নেই সংস্থাগুলোর।
রামপুরার বাসিন্দা মহিউদ্দিন বলেন, মগবাজার-মৌচাক সড়কে ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ চলছে অনেক দিন ধরে। এ কারণে রামপুরা থেকে শান্তিনগর পর্যন্ত তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। অনেক সময় বাস থেকে নেমে হেঁটে অফিসে যেতে হয়। তিন বছর ধরে এই সড়কে চলাচল করতে গিয়ে নানা ঝক্কিঝামেলা পোহাচ্ছি। এখন শুরু হয়েছে সড়ক খুঁড়ে বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন। ব্যস্ততম সড়কে দিনের বেলায় খোঁড়াখুঁড়ি করা নিষেধ থাকলেও এসব কেউ মানছে না। এই খোঁড়াখুঁড়ি করে যেসব মাটি, ইট ও পাথর তোলা হয়, সেগুলো এবং খোঁড়াখুঁড়ির কাজে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, সেগুলো এলোমেলোভাবে ফেলে রাখা হয় ফুটপাতসহ সড়কের ওপর। ফলে রাস্তা বা ফুটপাতÑ কোথা দিয়েও হাঁটার পথ থাকে না।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান সৈয়দ কুদরাতুল্লাহ বলেন, বিশেষ প্রয়োজনে সড়ক খননের অনুমোদন দেয় ওয়ানস্টপ সেল থেকে। তবে সেল থেকে এই দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়, খননের কারণে যেন জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপিডিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিনে খনন করায় উত্তোলিত পিস ও মাটি রাস্তার ওপরই রাখে। এতে জনগণের ভোগান্তি হয়। দিনের বেলায় শহরে ট্রাক প্রবেশ করতে না দেওয়ায় মাটি ও পিসগুলো সঙ্গে-সঙ্গে সরানো যায় না। পরে রাতে এগুলো সরানো হয়। তিনি আরও বলেন, সড়ক খননের কারণে জনগণের যেন ভোগান্তি কম হয়, সেদিকে নজর দিতে ঠিকাদারকে চিঠি দিচ্ছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন