বিশেষ সংবাদদাতা, চট্টগ্রাম ব্যুরো : দেশে পুনরায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। গতকাল (মঙ্গলবার) দুপুরের পরই এ ভূকম্পন হয়েছে। এটি ছিল হালকা ধরনের। তবে মৃদু ও হালকা কিংবা মাঝারি ধরনের ভূকম্পন ঘন ঘন যদি সংঘটিত হয়, তাহলে তা অদূর ভবিষ্যতে শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কাকেই দিক-নির্দেশ করে এবং এটি বড় ভূমিকম্পের অশনি সঙ্কেত, এমনটি জানান ভূতাত্ত্বিকগণ।
আবহাওয়া অধিদপ্তর ও মার্কিন ভূতত্ত্ব সংস্থার (ইউএসজিএস) পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, বাংলাদেশ সময় গতকাল বেলা ১টা ৪২ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে এ ভূকম্পন রেকর্ড করা হয়েছে। এই ভূকম্পন স্থানভেদে ৫ থেকে ১৪ সেকেন্ড পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ সময় কর্মব্যস্ত দুপুর বেলায় রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে মানুষ ভূমিকম্পের আচমকা হালকা দুলুনি টের পেয়েছেন।
ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল (ইপি সেন্টার) ছিল ঢাকা আগারগাঁও ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে ২১২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে। এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ৬, অর্থাৎ হালকা ধরনের। গতকালের ভূমিকম্পে দেশের কোথাও কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
এদিকে ঘন ঘন মৃদু, হালকা ও মাঝারি ভূকম্পনের প্রেক্ষিতে আবহাওয়া ও ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশসহ সন্নিহিত এই অঞ্চলটিতে সহসা যে কোনো সময় শক্তিশালী ধরনের ভূমিকম্প দুর্যোগ ডেকে আনতে পারে, এমনটি আশংকা ব্যক্ত করছেন। এর আগে বর্তমান সময়ে এ ধরনের ঘন ঘন প্রি-শক সহসা কোনো জোরালো ভূমিকম্পের পদধ্বনি বলে তারা সতর্ক করেছেন। ইন্দো-বার্মা-হিমালয়ান, ইউরেশীয় একাধিক ভূ-ফাটল লাইনের বিস্তার ও অব্যাহত সঞ্চালনের কারণে বাংলাদেশ ও আশপাশ অঞ্চলটি বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূকম্পন বলয় হিসেবে চিহ্নিত।
বিশেষজ্ঞ সূত্র জানায়, সাম্প্রতিককালে উপর্যুপরি মৃদু, হালকা, মাঝারি মাত্রায় ভূকম্পনের কারণে এ অঞ্চলের ভূ-ফাটল লাইনগুলো নাজুক ও শিথিল হয়ে পড়ছে, যা অদূর ভবিষ্যতে আরও প্রবল মাত্রায় ভূমিকম্পের আলামত বহন করছে। বিগত এক-দেড়শ বছর অতীতে এ অঞ্চলে রিখটার স্কেলে ৭ থেকে ৮ Ñ এ তীব্রতাসম্পন্ন ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। অভিন্ন টেকটোনিক প্লেট ও ভূ-ফাটল (ফল্ট) লাইনের অন্তর্গত হওয়ার কারণে বাংলাদেশের বৃহত্তর ঢাকাসহ মধ্যাঞ্চল, ময়মনসিংহ, সিলেট, রংপুর, বগুড়া, বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা অঞ্চল ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত।
ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানীদের মতে, বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূকম্পন বলয়ের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে বেশ উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে। বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারত ও মিয়ানমারে ভূ-পাটাতন ও ভূ-ফাটল ঘন ঘন স্থানচ্যুত হচ্ছে। এর ফলে শক্তিশালী মাত্রায় ভূমিকম্প বলতে গেলে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ভূ-কম্পনমাত্রা অত্যধিক হলে এবং ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল (ইপি সেন্টার) যদি কাছাকাছি এলাকায় হয় সে ক্ষেত্রে জনবহুল নগরী রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিস্তীর্ণ ঘনবসতি এলাকায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে মারাত্মক। তাছাড়া অতীতের ভূমিকম্প দুর্যোগের অনুরূপ বাংলাদেশের এ অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদী, শাখা নদী ও উপনদী, অববাহিকা ও উপকূলে গতিপথ পরিবর্তনের আশংকাও রয়েছে প্রবল। ভূমিকম্পের আঘাতে নাজুক ধরনের ভূমিতে গড়ে ওঠা বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা মাটিতে দেবে যেতে পারে, কিংবা মারাত্মক ধস সৃষ্টি হতে পারে। এতে করে প্রাণহানির মাত্রা হতে পারে অকল্পনীয়। বিগত দু’বছরে বাংলাদেশের ভূখ-ে এবং এর সংলগ্ন ভারত-মিয়ানমার অঞ্চলজুড়ে প্রায় অর্ধশত মৃদু, হালকা, মাঝারি ও শক্তিশালী ভূকম্পন হয়েছে।
বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার ত্রিদেশীয় এ অঞ্চলের ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, ভূ-গঠন অনুসারে এর অবস্থান পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় ভূকম্পন বলয়ে। বিশ্বে সাধারণত একই ভূ-কম্পনপ্রবণ এলাকায় ৫০, ৭০, ১০০, ১৫০ বছর পরপর প্রবল বা শক্তিশালী মাত্রায় ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি ঘটে। বাংলাদেশ ও এর সন্নিকটে উত্তর-পূর্ব ভারতের ভূকম্পন-প্রবণ অঞ্চলটিতে বিগত ১৫০ বছরের মধ্যে রিখটার স্কেলে ৭ ও ৮ মাত্রায় কমপক্ষে ৭টি ভূমিকম্প এবং একাধিক ভয়াল সুনামি আঘাত হানে, এমন রেকর্ড রয়েছে। এর মধ্যে ২টির উৎপত্তিস্থল (ইপি সেন্টার) ছিল বর্তমান বাংলাদেশ ভূখ-ের অভ্যন্তরেই এবং অপর ৫টি ভূমিকম্পের উৎস ছিল রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ২৫০ কিমি দূরত্বে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন