শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

কারণ ভারতের পানি শোষণনীতি - শুকিয়ে যাচ্ছে উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী

প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রেজাউল করিম রাজু : আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে। বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি। দু’ধারে উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতাটা স্কুলজীবনে পা দিয়েই পড়েননি এমন মানুষ খুবই কম আছে। যদিও এখন প্লে প্রি ক্লাসে গিয়ে পড়তে হয় টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার কিংবা হামটি ডামটি.......। এ প্রজন্ম ভুলে যাচ্ছে নদীমাতৃক বাংলাদেশর কথা। মানচিত্রেও আর অনেক নদীর নাম দেখা যায় না।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈশাখে নাগর নদী দেখে কবিতাটি লিখেছিলেন। আর এখন ছোট নদী নয়, দেশের অন্যতম নদী প্রমত্তা পদ্মায় শীত মৌসুমেই পানি থাকে না। আগে ছোট ছোট নদীর পানি চৈত্র-বৈশাখের খরতাপ কমে গেলেও এখন প্রতিবেশী দেশের আঁটোসাঁটো পানি শোষণনীতি আর মরণবাঁধ ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে শীত মৌসুমে দেশের শ’খানেক নদ-নদীর পানি শুকিয়ে যায়। ক’দিন আগে মরা পদ্মার বালুচরে যাবার সময় তীর ঘেঁষে থাকা খালসদৃশ নদী পারের সময় নজরে পড়ে মহিষের গাড়ি পার হচ্ছে চরে ফলানো গম নিয়ে। বালুচরের একটু শক্ত স্থানে পিচ বানিয়ে দামাল ছেলেরা মেতে উঠেছে ক্রিকেট খেলায়। নৌকাগুলো আটকে আছে বালুচরের এখানে সেখানে। মাঝ চরে চলছে বালুর ট্রাক। খুবলে খুবলে তুলে নিচ্ছে বালু খেকোর দল। চরজমিদারদের ট্রাক্টর বীরদর্পে দাপিয়ে বেড়ায় চর।
প্রমত্তা পদ্মার অথৈ নাচন থেমে গেছে অনেক আগেই। ১৯৭৪ সালের ২১ এপ্রিল পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারাজ দিয়ে পানি প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে পদ্মাসহ শাখা নদ-নদীগুলোর মরণ যাত্রা শুরু। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছরেও এদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আজো শেষ হয়নি। বাংলাদেশের মানুষকে মাছে-ভাতে-পানিতে মারা আর বিশাল একটা অংশকে মরুকরণের দিকে ঠেলে দেয়ার চন্ডিনীতিতে সফল হয়েছে। কৃষি, মৎস্য, যোগাযোগ, জীববৈচিত্র আর সবুজতা সব হারিয়ে গেছে বিশাল বালুচরে। যতদিন যাচ্ছে ভারতও তার পানি শোষণ ব্যবস্থাকে আরো আঁটোসাঁটো করছে। গত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজশাহীতে পদ্মার পানির উচ্চতা রেকর্ড করা হয় সাত দশমিক চৌষট্টি মিটার। স্বাধীনতা-উত্তর পঁয়তাল্লিশ বছরের ইতিহাসে এটি ছিল সর্বনি¤œ উচ্চতা পদ্মার। এর আগে ২০০৬ সালে মধ্য এপ্রিলে ছিল সাত দশমিক বাহাত্তর মিটার। পদ্মায় সর্বনি¤œ প্রবাহের কারণে ভূউপরিস্থ পানি তো বটে নিচের পানির স্তরও নেমে গেছে মারাত্মকভাবে। প্রতি বছর নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। শুধু নদী নয়, খাল-বিল, পুকুর-দীঘির সর্বত্র পানির জন্য হাহাকার। নদী শুকিয়ে যাওয়ার বিরূপ প্রভাব ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে সাধারণ হস্তচালিত নলকূপ পরিত্যক্ত হয়েছে বহু আগেই। এখন হস্তচালিত নলকূপের স্থান নিয়েছে সেমিডিপকল। অগভীর নলকূপেও পানি ওঠে না। ভরসা গভীর নলকুপ। কৃষি শিল্প আর নিত্য ব্যবহার্য সর্বক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে গভীর নলকূপের পানি। এতে করে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে। নগরীর পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় পদ্মা নদীর পানি ব্যবহারের জন্য রাজশাহী ওয়াসা শত কোটি টাকার পানি শোধনাগার প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। শত বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে শ্যামপুরে পানি শোধনাগার করা হয়েছিল। ক’বছর ধরে সে স্থানও পানিশূন্য। ফলে পাম্পস্টেশনটি দাঁড়িয়ে আছে বালুচরের ওপর।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চলে খরাভাব বিরাজ করছে। শুষ্ক মৌসুমে গড়ে ৩৬ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যাচ্ছে তাপমাত্রা। ২০০৫ সালের ২ জুন রাজশাহীতে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪২ দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানকার প্রকৃতিও হয়ে উঠেছে রুক্ষ শুষ্ক। জীববৈচিত্র্য সজীবতা হারিয়েছে। নৌপথ বলে আর কিছু নেই। কমে গেছে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। সাম্প্রতিক সময়ে এখানে বৃষ্টিপাত হচ্ছে আট শ’ থেকে এক হাজার মিলিমিটার। একযুগ আগেও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল এক হাজার থেকে দুই হাজার মিলিমিটার পর্যন্ত। বৃষ্টিপাতের রেকর্ডে দেখা যায়, ২০০৪ সালে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে দেড় হাজার মিলিমিটারের বেশি। এর পরের বছরগুলোয় বৃষ্টিপাত হয় অনেক কম। দুই হাজার সাত সালে বৃষ্টিপাত দুই হাজার মিলিমিটারের বেশি। এরপর আবার কমে যায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ।
নগরায়ন ও অবৈধ দখলের কারণে বড় বড় দীঘি-পুকুর-খালের বিশাল অংশ ভরাট হয়ে গেছে। যার ফলে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জায়গা নেই। গড়িয়ে নদী হয়ে চলে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। একসময় বরেন্দ্র এলাকায় সাড়ে তিন হাজারের বেশি দীঘি-পুকুর আর জালের মতো ছড়িয়ে ছিল খাল। সেসব অস্তিত্ব হারিয়েছে। বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ এসব উদ্ধার ও সংস্কারের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলেও তা সফল হয়নি। বরেন্দ্রের নাচোল এলাকা গিয়ে দেখা যায় সুইস রেডক্রসের সহযোগিতায় বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে ঠেলে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। উদ্দেশ্য ভূগর্ভস্থ পানির পুনঃভরণ। ফারাক্কার ফাঁক গলিয়ে আসা পানি আর বৃষ্টির পানি জলাধারে সংরক্ষণ করে এ অঞ্চলের কৃষি সেচ পরিবেশ মৎস্য ও পানি সমস্যা সমাধানের জন্য বহুল প্রতীক্ষিত গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প শুরুর পর্যায়ে এলেও ভারত গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা অভিমত ব্যক্ত করে বলেছে, এতে করে নাকি ভারতে বন্যাসহ নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যা নিতান্ত হাস্যকর। বরং ভারত বছরভর পানি আটকে রেখে বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারে। আবার বর্ষা মওসুমে ওপারে বন্যার চাপ ঠেকাতে ফারাক্কার সব ক’টি পাষাণ গেট খুলে দিয়ে বিপুল পরিমাণ পানি একসাথে এপারে ঠেলে দেয়। নদীগুলো মরে যাওয়ার কারণে ধারণক্ষমতা হারিয়েছে সেই কবেই। ফলে একসাথে এত পানির চাপ সামলাতে না পেরে দু’কূল ছাপিয়ে চলে। জনপদ ফসলের ক্ষেত ডোবায়। ভাঙনে নিঃস্ব হয় নদীপাড়ের মানুষ। ফারাক্কা দিয়ে শুকিয়ে আর ডুবিয়ে মারার খেলা খেলছে প্রতি বছর। গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়ার জন্য ১৯৯৬ সালের ত্রিশ বছর মেয়াদি একটি পানিচুক্তি আছে, যা কাগজে কলমেই। চুক্তি অনুযায়ী কখনই বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পায়নি। গ্যারান্টিহীন এ চুক্তি দেখে এ অঞ্চলের মানুষ টিপ্পনি কাটে ‘চুক্তি আছে পানি নাই। তবুও ওদের লজ্জা নাই’। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যত চুক্তি থাক বাংলাদেশ কখনো তার ন্যায্য হিস্যা পাবে না। কারণ গঙ্গার পানি ফারাক্কা পয়েন্টে আসার আগেই অসংখ্য ড্যাম ব্যারাজ দিয়ে পানি সরিয়ে নিচ্ছে ভারত। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট এবনে গোলাম সামাদের মতে, যে চুক্তি হয়েছে তা দ্বিপাক্ষিক। আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে চুক্তি হয়ে পড়েছে ভারতের সদিচ্ছানির্ভর। তিনি বলেন, শুধু গঙ্গা নয়, ব্রহ্মপুত্রসহ অভিন্ন ৫৪টি নদী নিয়ে ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে চীন-নেপাল-ভারত-বাংলাদেশ নিয়ে যৌথ নদীগুলোর পানি বণ্টনের সমস্যার সমাধান বের করতে হবে। ১৯৬০ সালে সাবেক পাকিস্তান আমলে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু নদী পানি চুক্তি হয়, যা ইন্ডিয়ান ওয়াটার ট্রিটি নামে খ্যাত। এ চুক্তির ফলে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু নদী ও তার উপনদীগুলো পানি নিয়ে সৃষ্ট বিরোধের সমাধান হয়েছিল। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক পালন করেছিল প্রধান ভূমিকা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক তা করতে পারে। বিশিষ্ট নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী যিনি বিভিন্ন নদী আর পুকুর নিয়ে গবেষণা করেছেন। অস্তিত্ব হারানো নদীগুলো খুঁজে বের করেছেন। নদী মরে গেলেও রেত থাকে। সেই রেত ধরে ছুটেছেন নদীর উৎসমুখ থেকে শেষ পর্যন্ত। তুলে ধরেছেন কিভাবে আমাদের নদ-নদীগুলোর অস্তিত্ব হারিয়েছে। ভারতের পানি শোষণনীতি অভিন্ন ৫৪ নদী নয়। শতাধিক নদীতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির নেতা এবং নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের আহবায়ক অ্যাড. এনামুল হক বলেন, ভারত অভিন্ন সব নদীর পানিকে জিম্মি করে বাংলাদেশের সাথে নির্দয় আচরণ করে চলেছে। বিশেষ করে ফারাক্কা দিয়ে পানি আটকে আমাদের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে। উপমহাদেশের নিপীড়িত-নির্যাতিত মজলুম মানুষের নেতা মওলানা ভাসানী চল্লিশ বছর আগেই অনুধাবন করেছিলেন ভয়াবহতার কথা। ফারাক্কার কারণে পদ্মার বিস্তীর্ণ অববাহিকাজুড়ে কী ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে। ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ করে ভারতের পানি আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। নিযুত কণ্ঠের গগনবিদারী স্লোগানের মধ্যে ঘোষণা করেছিলেন মরণ বাঁধ ফারাক্কা গুঁড়িয়ে দাও। ভারতের পানি শোষণনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও বিশ্ববাসী। তার বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল। মওলানা ভাসানীর সেই দেখানো পথে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। এটাই সময়ের দাবি।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন