শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পুরনো পথেই এডিপির বাস্তবায়ন

প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আজিবুল হক পার্থ : প্রতিবছরের মতোই এ বছরেও গতি নেই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) বাস্তবায়নে। ৯ মাসে বাস্তবায়ন হয়েছে ৪১ ভাগ। বাস্তবায়ন সক্ষমতা না থাকার পরেও বরাদ্দ দেওয়ায় এই অবস্থা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এই অবস্থায় মোট উন্নয়ন বরাদ্দ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে এডিপির সংশোধন করা হয়েছে। সেই আগামীতে বাস্তবায়ন সক্ষমতা বাড়াতে একগুচ্ছ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বছরের শুরু এডিপির বরাদ্দ দেওয়া হলেও বছরের শেষ এসে দেখা যায় অনেক মন্ত্রণালয়-এর বরাদ্দ করতে পারেনি। ফলে সংশোধনীতে তাদের টাকা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বাস্তবায়ন না হওয়ার সঠিক কারণ উদঘাটন না হওয়া, অধিক পরিমাণে প্রকল্প সংযুক্ত, রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প গ্রহণ সর্বোপরি কর্মকর্তাদের দক্ষতার অভাবে বাস্তবায়নে ধীর গতি রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অর্থবছরের শুরু থেকেই প্রকল্পের কাজ সমান তালে করলে কাজের মান ভালো হয়। আর শেষ সময় এসে তড়িঘড়ি করে কাজ করলে কাজের মান যেমন খারাপ হয় তেমনি অর্থ লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিছু দিন পরই আবার এসব প্রকল্পের কাজে হাত দিতে হয়। এ কারণে অর্থবছরের শুরু থেকে প্রকল্পের কাজ ভালোভাবে সমানতালে করা দরকার। এদিকে, দেশের উন্নয়নে হাতে নেওয়া প্রকল্পগুলো যথা সময়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এতে করে একদিকে বরাদ্দ রেখেও ব্যয় হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা। অন্যদিকে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন না হওয়ায় পিছিয়ে যাচ্ছে দেশ।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, শুধু আর্থিক সক্ষমতা দিয়ে দেশের উন্নয়ন হয় না। এজন্য কারিগরি তথা প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা প্রয়োজন। যার অভাব আমাদের রয়েছে বলেই কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হচ্ছে না। এছাড়া বরাদ্দের কাঁড়িকাঁড়ি টাকা যেমন অপচয় হচ্ছে তেমনি প্রতি বছর প্রকল্প সংশোধন এবং বছর শেষে বরাদ্দের টাকা ফেরত দিচ্ছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো।
জানা গেছে, মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে চলতি অর্থবছরের মূল এডিপি ১ লাখ ৯৯৭ হাজার কোটি টাকা থেকে নামিয়ে আনা হয়েছে ৯৩ হাজার ৮৯৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকায়। ফলে কমে গেছে প্রায় ৭ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে পরিবহন খাত, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বিদ্যুৎ এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাচ্ছে শিক্ষা ও ধর্ম খাত। বাস্তবায়নে গতি না আসায় এত বড় অংক ছেঁটে ফেলা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে মূল এডিপির আকার ১ লাখ ৯৯৭ হাজার কোটি টাকা ছিল। সেখান থেকে ৯৩ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা ৬৮ লাখ টাকা করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৬৪ হাজার ৭৩৪ কোটি ৬৮ লাখ এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ২৯ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। যদিও অর্থ বিভাগ থেকে সংশোধিত এডিপির আকার দেওয়া হয়েছিল ৮৮ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে এবছরেও প্রথম ৯ মাসে এডিপির বাস্তবায়ন হয়েছে ৪১ ভাগ। প্রত্যেক প্রান্তিকে সমান হারে টাকা ব্যয়, প্রকল্পের তদারকি বাড়ানো, জমি অধিগ্রহণসহ আইনি বাধা সমূহ দ্রুত নিষ্পত্তি, অনিশ্চিত প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ না দেওয়াসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা দেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি দফায় দফায় পিডি ও সচিবদের ডেকে এডিপির বাস্তবায়ন বৃদ্ধির তাগিদ দেন। তবুও কোন কাজ হয়নি।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক-উল-ইসলাম বলেন, বাস্তবায়ন নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। এক্ষত্রে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) বাংলায় করা, পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদন ক্ষমতা ২৫ কোটি থেকে বাড়িয়ে ৫০ কোটি করা, ২৫ শতাংশ ব্যয় বাড়লে মন্ত্রীর মাধ্যমে সংশোধনী এবং জরিপ বা সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দুই কোটি টাকার স্থলে পাঁচ কোটি টাকা করা হচ্ছে। এছাড়া প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর পর তা ১০০ কার্যদিবসের স্থলে ৮৭ কার্যদিবসের মধ্যে অনুমোদন এবং কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের ক্ষেত্রে ৪৫ কর্মদিবসের পরিবর্তে ৩২ দিন করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, গত অর্থবছরে (২০১৪-১৫) ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। পরে এনইসি বৈঠকে ৭৫ হাজার কোটি টাকার সংশোধিত এডিপি অনুমোদন দেয়। এডিপি কাটছাঁটের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না সরকার। একই অব্যাহত রয়েছে আগ থেকেই। বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর আগের বছর ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এডিপির আকার ছিল ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। পরে সংশোধন করে তা ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ক্ষমতায় এসে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সাড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকার এডিপি নেয়া হয়। পরে তা কমিয়ে ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সংশোধিত এডিপি ঘোষণা করা হয়। ২০১০-১১ অর্থবছরে এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। মাঝ পথে বরাদ্দ কমিয়ে ৩৫ হাজার ৮৮০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। পরের বছর ৪৬ হাজার কোটি টাকার এডিপি ঘোষণা করে ৪১ হাজার ৮০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫৫ হাজার কোটি টাকার এডিপিতে বরাদ্দ কমানো হয় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এডিপিতে ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা হাতে নিয়ে ৬০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছরই সরকার একটি বিশাল এডিপি গ্রহণ করে। কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সরকারের গৃহীত এ এডিপি কখনও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হওয়াটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মতো হয়ে গেছে। অর্থবছরের শেষের দিকে সরকার তাড়াহুড়া করে এ বাস্তবায়নের হারকে ৯০ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে যায়।
প্রতি বছরে যে পরিমাণ প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ দেয়া হয়। সংশোধিত এডিপিতে তা বেড়ে যায়। এডিপি কাটছাঁট করার পক্ষে কখনও রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন অজুহাত দেখানো হয়। কিন্তু নতুন প্রকল্প সংযোজনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও অন্যান্য চাপের কথা স্বীকার করা হয় না। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা ছিল ৯০৪টি। সংশোধিত এডিপিতে তা বেড়ে ১ হাজার ৪০টিতে উঠে আসে। পরের বছর ৮৮৬টি প্রকল্পে অনুকূলে এডিপি ঘোষণা দেয়া হয়। বছরে সংশোধনীতে বেড়ে ১ হাজার ৯০টি করা হয়। ৯১৬টি প্রকল্পের অনুকূলে ২০১০-১১ অর্থবছরের এডিপি নেয়া হয়। সংশোধনীতে ১ হাজার ১৯৩টিতে উন্নীত হয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১০৫টি। তা সংশোধিত আকারে ১ হাজার ৩৪০টি করা হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ হাজার ১৪১টি প্রকল্প নেয়া হলেও সংশোধিততে বাড়িয়ে ১৩৪০টিতে উন্নীত করা হয়। এর পরের বছর ১ হাজার ১৬০টি প্রকল্প হাতে নেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হলেও মাঝ পথে তা বাড়িয়ে ১ হাজার ৩৬৩টিতে উন্নীত করা হয়। চলতি অর্থবছরে ১ হাজার ১৫৫ টি প্রকল্প নিয়ে শুরু হলেও এরই মধ্যে ৬০টি নতুন প্রকল্প যোগ হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন