চট্টগ্রাম বু্যুরো : চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার প্রত্যন্ত উপকূলীয় এলাকা গন্ডামারা এখন শোক, ক্ষোভ-বিক্ষোভ আর আতঙ্কের জনপদ। সেখানকার বাসিন্দাদের দিন কাটছে বিক্ষোভ আর নানা আতঙ্কে। নিহতদের ঘরে ঘরে চলছে শোকের মাতম। পরিবারের অভিভাবককে হারিয়ে ঘোর অন্ধকারে পড়েছে চারটি পরিবারের অসহায় সদস্যরা। আহতদের সুচিকিৎসা নিয়ে উদ্বিগ্ন তাদের স্বজনরা। পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে সরকারী হাসপাতালে যারা ভর্তি হয়েছেন তাদের গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত ২ জনের হাতে হাতকড়া। বুলেটের যন্ত্রণার সাথে যোগ হয়েছে হাতকড়ার যন্ত্রণা। পুলিশি হয়রানীর ভয়ে আহত হওয়ার পরও যারা হাসপাতালে যাননি, তাদের চিকিৎসা চলছে বাড়িতে।
সোমবার পুলিশের গুলিতে চার গ্রামবাসী নিহত এবং ত্রিশ জন আহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশ ৬ হাজার মানুষকে আসামি করে থানায় দুুটি মামলা করে। মামলার বেশিভাগ আসামি অজ্ঞাত হওয়ায় পুরো গ্রামবাসীর মধ্যে গ্রেফতার আতঙ্ক বিরাজ করছে।
পুলিশের গুলিতে হতাহতের প্রতিবাদে গতকাল বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো গ্রামবাসী বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। তারা জীবনের বিনিময়ে হলেও বাপ-দাদার ভিটে বাড়ি রক্ষার শপথ নিয়েছে। ক্ষোভ, বিক্ষোভে উত্তাল গন্ডামারা গ্রাম। মিছিলে শামিল হচ্ছে নারী ও শিশুরাও। তবে আতঙ্কও আছে, কখন ফের পুলিশ হানা দেয়। পুলিশি অভিযান ঠেকাতে রাত জেগে পাহারা বসিয়েছে গ্রামের মানুষ। নির্মম পুলিশি নির্যাতনের শিকার সুবিধা বঞ্চিত গ্রামবাসীর পাশে দাঁড়াচ্ছে নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সান্ত¡না জানাতে গন্ডারামা যান। তার নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল নিহতের নামাজে জানাযায়ও অংশ নেন। জানাযা পূর্ব সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠনের দাবি জানান।
গতকাল দুপুরে তেল গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি চট্টগ্রাম শাখার একটি প্রতিনিধি দল গন্ডামারার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তারা পুলিশের গুলিতে নিহতদের পরিবার সদস্যদের প্রতি সমবেদনা এবং আহতদের খোঁজ খবর নেন। এসময় গন্ডামারা হাদিরপাড়া স্কুলমাঠে এক সমাবেশে মিলিত হন। সমাবেশে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির চট্টগ্রামের সম্পাদক ম-লীর সদস্য অধ্যাপক আলোক শাহা ও কমরেড অমৃত বড়–য়া বলেন, পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে বাঁশখালীর গন্ডামারার মানুষ জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন, দেশ, পরিবেশ ও সমাজের স্বার্থে কোন আপোষ চলে না। তারা ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী করে নিহত এবং আহতদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার পাশাপাশি অবিলম্বে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের দাবি জানান। এসময় অন্যান্যদের মধ্যে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক বাসদ নেতা আল কাদেরী জয়, যুবনেতা আমানুল ইসলাম, ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রামের সভাপতি শিমূল বৈঞ্চব, পরিবহন শ্রমিক নেতা ছিদ্দিক আহমদ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের পার্থ প্রতীম নন্দি, গণসংহতি আন্দোলনের হাসান মারুফ, ছাত্র ফেডারেশন সভাপতি ফরহাদ জনি, গণ মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি নাছির উদ্দিন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। তারা গন্ডামারা ঘুরে বিকেলে বাঁশখালী ত্যাগ করেন। এসময় তারা উপজেলা সদরে সাংবাদিকদের সাথে মিলিত হন। আগামী ৮ এপ্রিল জাতীয় কমিটির নেতারা বাঁশখালী আসার কর্মসূচী রয়েছে বলেও জানান তারা।
এদিকে বাঁশখালীতে গতকাল সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয়েছে। কোন ধরণের পিকেটিং ছাড়াই শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়। যদিও কোন দায়িত্বশীল পক্ষ থেকে এই হরতাল আহবান করা হয়নি। ফেসবুক এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাত্রঐক্য পরিষদের নামে এই হরতাল আহবান করা হলেও তাদের কাউকে রাস্তায় পিকেটিংয়ে পাওয়া যায়নি। গন্ডামারা এলাকার দোকান-পাঠ ঘটনার পর থেকেই বন্ধ রয়েছে। প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে পালিত হয় এই হরতাল। এলাকার পরিস্থিতি এখনো থমথমে। থেমে থেমে চলছে মিছিল আর বিক্ষোভ। সোমবারের ঘটনায় কয়লা প্রকল্প বিরোধী আন্দোলনের নেতা লেয়াকত আলীকে প্রধান আসামি করে ৩টি মামলায় সাড়ে ৬ হাজার মানুষকে আসামি করায় এলাকার লোকজনের মাঝে আতংক বিরাজ করছে। পুলিশ ও র্যাবের যৌথ অভিযানের খবর প্রচার হওয়ায় লোকজন আছেন উৎকন্ঠায়। তবে সোমবার বিকেলে হতাহতের ঘটনার পর পরই পুলিশ এলাকা ত্যাগ করার পর আর গন্ডামারায় যায়নি। ক্ষোভে উত্তাল গন্ডামারায় পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে পুলিশ গন্ডামারায় যায়নি বলে জানিয়ে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, এখন গন্ডামারায় পুলিশ গেলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হতে পারে। সেখানকার মানুষ আরো ক্ষীপ্ত হয়ে উঠতে পারে। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল হিসেবে পুলিশ গন্ডামারায় যাচ্ছে না। পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনার পর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ কাজ শুরু হবে তাও নিশ্চিত নয়। তবে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান এস আলমের কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশের সাথে গ্রামবাসীর সংঘাতের সাথে তাদের কোন রকম সম্পর্ক নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন