মো. আব্দুল গনি, কেরানীগঞ্জ থেকে : কেরানীগঞ্জে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম অত্যাধুনিক কেন্দ্রীয় কারাগার আগামীকাল (রোববার) সকালে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের জন্য কারাগারটি এখন সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে বিভিন্নভাবে সাজানো হয়েছে কারাভবন ও এর আশপাশের রাস্তাগুলো। কারারক্ষীরাও প্রধানমন্ত্রীকে অভিবাদন জানানোর জন্য তারা সকাল বিকেল অনুশীলন করে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে কেউ একনজর কারাগারের দিকে তাকালে তার মন না জুড়িয়ে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে কারাগারের অভ্যন্তরে এবং বাহিরে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কারাগারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের লোকজন সবসময় কারাগারের অভ্যন্তরে ও বাইরে ঘুরে ঘুরে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। কারাভবনগুলাকে বিভিন্ন নদী ও ফুলের নামের সাথে তাল মিলিয়ে তাদের প্রত্যেকটির নামকরণ করা হয়েছে। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের পাশে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় ১৯৪ দশমিক ৪১ একর জমির উপর নির্মিত হয়েছে অত্যাধুনিক ও প্রযুক্তি সুবিধাসমৃদ্ধ এই নতুন কারাগার। ২০০৬ সালের ২৭ সেপ্টম্বর একনেকে অনুমোদন পাওয়ার পরে প্রকল্পটি জমি অধিগ্রহণ করা শুরু করে। ২০০৭ সালে মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১০ সালের জুন মাসে। তিন দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০৬ কোটি ৩৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা। কারাগারের চারিদিকে ২৫ ফুট উঁচু সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। সীমানা প্রাচীরের চারদিকে ৪টি ৪০ ফুট উঁচু পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। এই পর্যবেক্ষণ টাওয়ার দিয়ে পুরো কারাগারের চিত্র দেখা যাবে। এই টাওয়ারেও কারারক্ষী মোতায়েন করা হয়েছে। কারাগারটিতে ৩টি ডিভিশনের পুরুষ-১ এ ৪ হাজার পুরুষ-২ এ ৪ হাজার ও মহিলা কারাগারে ৩০০ বন্দীর থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। কারাগারটিতে ৮টি ছয়তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ভবনের প্রতি তালায় ৪০টি করে কক্ষ রয়েছে। প্রতি কক্ষে ১৩ জন করে কয়েদী রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। ২০ হাত দৈর্ঘ ও ১০ হাই প্রস্থের প্রতিটি কক্ষে ৪টি করে সিলিং ফ্যান রয়েছে। ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামি, শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গী ও দুর্ধর্ষ আসামিদের রাখার জন্য ৪টি ৪তলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ভবনের প্রতিকক্ষেই টয়লেট ও ফ্যানের ব্যবস্থা রয়েছে। এই ৪টি ভবনের নামকরণ করা হয়েছে বকুল, বনফুল, শাপলা ও সূর্যমুখী। ডেঞ্জার সেলের এই ৪টি ভবন কাছাকাছি নির্মাণ করা হয়েছে। ভবন ৪টি ১৮ ফুট উচ্চতার প্রাচীর দিয়ে ঘেরা রয়েছে। এই প্রাচের উপর আবার ২ ফুট বৈদ্যুতিক তারের সেন্সর রয়েছে। প্রতিটি ভবন আবার আলাদা প্রাচীর দ্বারা ঘেরা রয়েছে। কোন আসামি দেয়াল বা প্রাচীর টপকিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে না। এক ভবন থেকে অন্য ভবনে কোন আসামি যেতেও পারবে না। এর প্রতিটি ফ্লোরে ১০০ জন আসামিকে রাখা হবে। এগুলোকে ডেঞ্জার সেল বলা হয়। ৬০ জন ভিআইপি বন্দীকে রাখার জন্য ৬০টি বিশেষ কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। এই ৬০ কক্ষ বিশিষ্ট ভবনটির নামকরণ হয়েছে চম্পাকলি। এখানে শুধু ডিভিশন প্রাপ্ত ভিআপি আসামিদের রাখা হবে। যাদের বয়স ১৮-২২ বছরের মধ্যে এরকম ১০০ কিশোর অপরাধী বন্দীকে রাখার জন্য একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এই ভবনের নামকরণ করা হয়েছে সুরমা। ৩০ জন ভারসাম্যহীন বন্দীকে রাখার আলাদা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এই ভবনের নামকরণ করা হয়েছে জলসিঁড়ি। জলসিঁড়ি ভবনের পাশেই গ্রন্থাগার ভবন এবং বিশাল খালি জায়গা। এই জায়গাটিকে কেইস টেবিলশেড নাম দেয়া হয়েছে। কোন আসামিকে কোন ভবনে নেয়া হবে তা এখান থেকে নির্ধারন করা হবে। আবার কোন আসামি অপরাধ করলে এখানেই তার বিচার করার ব্যবস্থা করা হবে। হাজাতিদের রাখা হবে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্নফুলি, করতোয়া ও মনিহার ভবনে। কয়েদীরা থাকবে মধুমতি ও রূপসায়। কারাগারের দক্ষিণে সীমানা প্রাচীরের কাছে রয়েছে ফাঁসির মঞ্চটি। এখানে একই সঙ্গে ২ জনকে ফাঁসি দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কারাগারের প্রধান ফটকের পাশেই রিজার্ভ গার্ড হাউজ, বন্দীরে সঙ্গে সাক্ষাৎ ভবন রয়েছে। আর প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই ডান পাশে দৈনিক রসদ গ্রহণ ও বিতরণ কক্ষ, তারপর ভর্তি শাখা ও মুক্তি শাখা কক্ষ। ফটকের পাশেই রয়েছে জেলারের কক্ষ। ভিতরে ওয়ার্কশপ, লন্ড্রি, সেলুন ও গুদাম ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। সীমানা প্রাচীরের পাশেই বন্দীদের চিকিৎসার জন্য ২০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। কারাগারের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে কারারক্ষীদের দুর্জয় নামে একটি ব্যারাক নির্মাণ করা হয়েছে। এই ব্যারাকের ৯৬টি কক্ষে প্রায় ৪শ’ কারারক্ষী থাকতে পারবেন। কারাগারের পশ্চিমে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবারের জন্য আলাদা ভবন, অফিসার্স ক্লাব, স্টাফ ক্লাব, স্কুল, মসজিদ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ আলোচনা সভার জন্য মিলনায়তন নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯৮০ সালে পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোড থেকে কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হলেও প্রায় ৩৬ বছর পর বর্তমান সরকারের আমলে এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। এব্যাপারে কেরানীগঞ্জ উপজো চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক শাহীন আহমেদ বলেন, কেরানীগঞ্জে বিশ্বের মধ্যে একটি আধুনিক কারাগার নির্মাণ করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল এই কারাগার উদ্বোধন করবেন। যে সমস্ত আসামি ও কয়েদীরা এখানে আসবেন তারা এই আধুনিক কারাগারকে অনুভব করতে পারবেন যে এটি কত অত্যাধুনিক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই কেরানীগঞ্জে এই ধরনের একটি আধুনিক কারাগার উপহার দেয়ার জন্য। তেঘরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী মোঃ জজ মিয়া বলেন, জেলখানাটি চালু হলে এখানে অনেক লোকজনের আনাগোনা হবে। এলাকায় অনেক দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠবে। অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। বাসা বাড়ির ভাড়া বেড়ে যাবে। এক কথায় আমাদের এলাকায় আমুল পরিবর্তন ঘটবে। এই সরকার এখানে একটি ভিআইপি কারাগার নির্মাণ করায় এটিকে নিয়ে আমরা অনেক গর্বিত। সরকারের এটি একটি বিরাট সাফল্য। আমি সরকারকে এই জন্য ধন্যবাদ জানাই।
এদিকে গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর কারা অধিদফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন বলেন, আমাদের যতো বন্দি রয়েছে তাদেরকে একদিনে স্থানান্তর করতে যে সংখ্যক প্রিজন ভ্যানের প্রয়োজন, ততগুলো প্রিজন ভ্যান সারাদেশেও নেই। তাই তাদেরকে অন্য কোনভাবে নেওয়া যায় কি না, রাস্তায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টিও এখানে জড়িত। সকলের সাথে বিষয়টি আলোচনা করে কোনদিন স্থানান্তর করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমাদের যে জনবল রয়েছে তা দিয়ে একসাথে দুই কারাগারের নিরাপত্তা বিধান অসম্ভব। তাই যে কোন ছুটির একদিন সকল বন্দিকে স্থানান্তর করা হবে। কারাগারের অন্যান্য দাপ্তরিক কাগজপত্র ও আসবাব ধাপে ধাপে স্থানান্তর করা হবে।তিনি আরো বলেন, সাজাপ্রাপ্তদের জন্য কাশিমপুর কারাগার এবং মূলত বিচারাধীন আসামীদের জন্য কেরানীগঞ্জের এ কারাগারটি ব্যবহৃত হবে। কারা মহাপরিদর্শক বলেন, প্রথমে ৫শ’ জন স্টাফ সেখানে নেওয়া হলেও ৩০০ স্টাফের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে সেখানেই সবার আবাসিক ব্যবস্থা করা হবে। আমাদের দেশে কোনকিছুই পরিপূর্ণভাবে শুরু করতে পারি না। যে কোন শুরুরই যন্ত্রণা আছে। প্রাথমিক কষ্টটুকু মেনেই কাজ করতে হবে। ঢাকার বাইরে হওয়ায় স্টাফদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যপারেও কষ্ট হবে। খুব শীঘ্রই আমরা একটি স্কুল নির্মানের কাজ শুরু করব। কারারক্ষীরাও প্রাথমিকভাবে এ ত্যাগ স্বীকার করতে আগ্রহী। নতুন কারাগার নির্মাণে ফিনিশিং কাজে কিছু ত্রুটি আছে। এতে নিরাপত্তায় কোন সমস্যা হবে না। তারপর বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি বিষয়টি দেখবে। নতুন কারাগারে সাধারণ বন্দিদের জন্যে ছয়টি ভবনের মধ্যে একটির কাজ আংশিক বাকি আছে। বাকিগুলোর কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে।
নতুন কারাগারে বন্দিদের জন্যে আধূনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। ২০০ সজ্জাবিশিষ্ট হাসপাতাল থাকছে। এ হাসপাতালে বন্দীদের পাশপাশি সাধারণ রোগীরাও চিকিৎসা নিতে পারবে। আইজি নাজিম উদ্দিন রোড থেকে কারাগার চলে যাওয়ার পর সেখানে একটি অত্যাধুনিক কারা কমপ্লেক্্র নির্মাণ করা হবে। সেখানে থাকবে একাধিক স্মৃতি যাদুঘর। থাকবে পুরান ঢাকার মানুষদের জন্যে বিনোদনের ব্যবস্থা।
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় কারাগারটি পুরাতন হওয়ায় ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়নের বাঘৈর ও পশ্চিমদি মৌজায় ১৯৪ দশমিক ৪১ একর জমির ওপর নতুন এই কেন্দ্রীয় কারাগারটি নির্মাণ করা হয়েছে। ব্যয় হয়েছে ৪০৬ দশমিক ৩৪ কোটি টাকা। সেখানে চার হাজার ৫৯০ জন (পুরুষ) বন্দী থাকতে পারবেন। জেলকোড অনুযায়ী বন্দীদের যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার রয়েছে, এর সবই রয়েছে এই কারাগারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন