‘আমি মেজর জিয়া বলছি’, এই ঘোষণা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর ঘোষণা ছিল তার সৎ-সাহসের পরিচয়। প্রথমে নিজের নামে, পরে বঙ্গবন্ধুর নামে ঘোষণা দিয়ে তিনি রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। জিয়ার ঘোষণায় জাতি স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রের সন্ধান পায়। জিয়ার ঘোষণা ইন্ডিয়া কর্তৃক সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। জিয়ার ঘোষণায় বাঙালি সৈনিকদের ও জনগণের মনোবল বৃদ্ধি করে। জিয়া একটি সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিরোধের ক্ষেত্র তৈরি করলেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম হলো এই দিন থেকে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ছিল এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যা থেকে আর পেছনে ফেরা যায়নি।
কালুরঘাটে কয়েকবার যান জিয়া। সেখানকার বেতার ঘোষণা ২৭ ও ৩০ মার্চ তাঁকে ভীষণ ঝুঁকির মুখে ফেলেছিল। যে কোনো সময় বিমান থেকে তাঁকে বোমা মেরে হত্যা করা যেত। মেজর জিয়ার ঘোষণা প্রথম শুনতে পায় চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা একটি জাপানি জাহাজ। তারা তখনই তা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়। জিয়ার ঘোষণার সংবাদ প্রথম প্রচার করে রেডিও অস্ট্রেলিয়া। ২৮ মার্চ ইন্ডিয়ার খবরের কাগজগুলো খবর প্রচার করে যে, ‘জিয়া খান’ নামে এক মেজর ২৭ মার্চ একটি ঘোষণায় নিজেকে বাংলাদেশ মুক্তিসেনার প্রধান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। ২৯ মার্চ ’৭১ নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত স্টেটসম্যান পত্রিকা লেখেÑ
স্বাধীন বাংলা বেতারের এক সম্প্রচারে মুক্তিসেনার কমান্ডার ইন চিফ মেজর জিয়া খান বলেছেন, ‘আমি এতদ্বারা স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রাদেশিক প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করছি।’ ৩০ মার্চ বিকেলে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র পাক বিমানবাহিনী ধ্বংস করলে মেজর জিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া যান এবং ৩ এপ্রিল মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাঁর। এরপর তিনি মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ কর্নেল এম ত্র এ জি ওসমানীর অধীনে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন।
জিয়ার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক দর্শন একটি ‘মাস্টার স্ট্রোক’। এই নীতির বাস্তবায়নে দেশের সব ধরনের মানুষকে তারা সে যে কোনো নৃগোষ্ঠী বা ভাষা বা ধর্মের হোক, সবাইকে সার্বজনীনভাবে, একই প্লাটফরমে আনা হলো।
দেশের অধিকাংশ মানুষ বাঙালি, তা ঠিকই আছে। বাঙালি ও বাংলাদেশি মূলত একই। তবে বাংলাদেশি পরিচয়টা আরো ‘ইনক্লুসিভ’Ñ অন্তর্ভুক্তিমূলক। সবার ক্ষোভ মেটানো যায় এ পরিচয়ে। যাই হোক, পরবর্তী সাংবিধানিক পরিচয়ে এ জটিলতা মিটেছে।
প্রেসিডেন্ট জিয়া মিডিয়াবান্ধব ছিলেন। তিনি মিডিয়ার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। এ কারণে তিনি সাংবাদিকদের আবাসনের ব্যবস্থাও করেছিলেন। জিয়া প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং আরো নিম্নবর্ণিত কাজ করতে পেরেছিলেনÑ
শিশু ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়,
যুববিষয়ক মন্ত্রণালয়,
গ্রাম সরকার,
গ্রাম পুলিশ,
গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী,
শিশু একাডেমি,
সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণ
মৃতপ্রায় সরকারি উদ্যোগগুলোকে দুই শিফটে চালানোর ব্যবস্থা করা,
৪০ হাজার কিউসেক পানি আনয়নে গঙ্গা নদী নিয়ে ইন্ডিয়ার সঙ্গে চুক্তি, যাতে গ্যারান্টি ক্লজ ছিল,
খাল খনন কর্মসূচি,
দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে উৎসাহ প্রদান,
পোশাক শিল্পের প্রতিষ্ঠা,
বেসরকারি ব্যাংক-বীমা প্রবর্তন,
ইন্দো-সোভিয়েত কক্ষপথ থেকে বাংলাদেশের গতিপথ পরিবর্তন করে বিশ্বময় বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি,
মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ়করণ, ফলে মর্যাদাপূর্ণ আল-কুদস কমিটির সদস্য হয় বাংলাদেশ এ সময়,
তখনকার সউদী আরবের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক, যার অন্যতম প্রমাণ আরাফাত ময়দানে জিয়ার প্রেরিত নিমের সারি সারি গাছ,
ইরাক-ইরান যুদ্ধ বন্ধে জিয়ার ওপর দায়িত্ব অর্পণ, ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের প্রথম প্রবেশ, সার্ক জিয়ারই চিন্তার ফসল, উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
জিয়া ছিলেন একজন সৎ ব্যক্তি। দুর্নীতি তাঁকে কখনই স্পর্শ করেনি। তাঁর জীবনযাত্রা ছিল খুবই সাদাসিধে। তাঁর নেতৃত্বে ফিরে আসে জনগণের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার। মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
ড. এমাজউদ্দীন আহমদ লিখেছেন, একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সমস্যা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সুইডেনের নিরাপত্তা বিশারদ আর্লিং বিওল বলেছেনÑ ‘ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সমস্যা অনেকটা ছোট পাইলট মাছের সমস্যার মতো, হাঙরের কাছাকাছি থেকেও কিভাবে তার মুখে না পড়ার কৌশল।’ তিনি মন্তব্য করেন, ‘ভারতের মতো বিরাট শক্তিধরের কাছাকাছি থেকে পাইলট মাছের মতো ক্ষুদ্রাকৃতি অথচ নিরীহ বাংলাদেশ কিভাবে নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে বাংলাদেশের নিরাপত্তা সমস্যার প্রকৃতি এটিই। বাংলাদেশি প্রতীকে বলা যায়, বিপুলায়তন ভারতীয় বোয়াল মাছের কাছাকাছি ক্ষুদ্র পাবদা মাছের নিরাপত্তার কৌশল। খুব কাছেও যাওয়া যাবে না, কেননা তখন ক্ষুধার্ত বোয়ালের পেটে পড়তে হবে। অন্য দিকে, খুব দূরেও থাকা সম্ভব নয়, কেননা বোয়ালটি কখন কী করে, কোন দিকে বাঁক ফেরে তাও জানা দরকার। এ দুইয়ের সাম্যাবস্থাই বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতি। জিয়াউর রহমানের কৃতিত্ব এই যে, তিনি দুইয়ের মধ্যে সাম্যাবস্থা সৃষ্টির কৌশল পুরাপুরি আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন।
জিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহর লেখা বই ‘প্রেসিডেন্ট জিয়ার রাজনৈতিক জীবনী’ খুবই উপযোগী পরিশিষ্ট, গ্রন্থপঞ্জি নির্ঘণ্টসহ এটি ৫৮২ পৃষ্ঠার বই। প্রকাশক : অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ২২ সেগুনবাগিচা, ঢাকা-১০০০।
লেখক : ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন