শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

অবশেষে দক্ষিণাঞ্চলের দু’টি অতি গুরুত্বপূর্ণ সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হচ্ছে

ব্যয় হবে প্রায় দু’হাজার কোটি টাকা : আর্থিক সহায়তা দেবে কুয়েত-চীন

প্রকাশের সময় : ১০ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নাছিম উল আলম : আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর দীর্ঘ কালক্ষেপণের পরে কুয়েত ও চীনা আর্থিক সহায়তায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দু’টি প্রধান মহাসড়কে অতি জনগুরুত্বপূর্ণ ২টি বৃহৎ সেতুর নির্মাণ কাজ শুরুর চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেতু দু’টি নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের লেবুখালীর কাছে পায়রা নদীর ওপর সেতু নির্মিত হলে বরিশালসহ সারা দেশের সাথে পটুয়াখালী, কুয়াকাটা ও বরগুনার সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা নির্বিঘœ হবে। এমনকি প্রায় ১হাজার ৪৭০ মিটার দীর্ঘ ৪ লেনের লেবুখালী সেতুটি নির্মিত হলে সড়ক পথে পটুয়াখালী ও কুয়াকাটা পৌঁছতে আর কোন ফেরি পার হতে হবেনা। আগামী মঙ্গলবার এ সেতুটি নির্মাণে সর্বনিম্ন দরদাতা চীনা প্রতিষ্ঠান-‘ঝিয়াং জি’র সাথে ১হাজার ২২ কোটি টাকার চুক্তি স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে। অপরদিকে চট্টগ্রাম-বরিশাল-ঝালকাঠী-পিরোজপুর-বাগেরহাট- মোংলা-খুলনা মহাসড়কের কঁচা নদীর ওপর প্রায় ১ হাজার ৪৮০ মিটার দীর্ঘ ‘চীন-বাংলাদেশ ৮ম মৈত্রী সেত’ু নির্মাণে ৩শ’ মিলয়ন ইউয়ান-এর একটি অনুদান চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। বেকুটিয়া সেতুর প্রকল্প ব্যয় প্রথমে প্রায় ১হাজার কোটি টাকা ধরা হলেও চীন সরকার এখন এর ব্যয় সাড়ে ৬শ’ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে। যার মধ্যে মূল সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছে ৪শ’ কোটি টাকা। যার পুরোটাই চীনা অনুদান হিসেবে পাওয়া যাবে। সেতুর সংযোগ সড়কসহ অনুষঙ্গিক কাজে আরো প্রায় আড়াইশ’ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। যা বাংলাদেশ সরকারকে যোগান দিতে হবে।
সেতুটি নির্মাণে গত ফেব্রুয়ারীতে ‘লেটার অব এক্সচেঞ্জ’ স্বাক্ষরিত হয়। চীনা অনুদানে বেকুটিয়ার কাছে কঁচা নদীর ওপর এ সেতুটি নির্মিত হলে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের মধ্যে ১০৫ কিলোমিটার মহাসড়কে আর কোন ফেরি পারাপারের বিড়ম্বনা থাকবে না। এমনকি তা চট্টগ্রাম-পায়রা ও মোংলা বন্দরের সাথেও সড়ক যোগাযোগ সহজতর করবে।
তবে অপর একটি মহল বেকুঠিয়ার পরিবর্তে প্রায় ২২কিলোমিটার অতিরিক্ত দূরত্বের চরখালীতে কঁচা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের লক্ষ্যে পরোক্ষে বাধা প্রদান করে আসছিল। ঐ মহলটি ৩টি প্রশাসনিক বিভাগ ও তিনটি সমুদ্র বন্দরের চেয়ে কয়েকটি উপজেলার সাথে খুলনা ও মোংলার সড়ক পথের বিষয়টি অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করে আসছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। অথচ বেকুঠিয়াতে সেতু হলে ভান্ডারিয়া, মঠবাড়ীয়া ও পাথরঘাটার সাথেও খুলনা ও মোংলাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ সহজতর হবে। নানা কারসাজিতে বারবারই ৩টি প্রশাসনিক বিভাগ ও তিনটি সমুদ্র বন্দরের সড়ক পথের অতি জনগুরুত্বপূর্ণ এই সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া পেছাতে থাকে।
চীন সরকার ৮ম মৈত্রী সেতু নির্মাণে ১০ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ৮শ’ কোটি টাকা ঋণ প্রদানে প্রাথমিক সম্মতির প্রেক্ষিতে গত বছর ১১ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন এবং মহাসড়ক বিভাগের সচিব ও চীনা চার্য দ্যা এ্যাফেয়ার্স-এর মধ্যে একটি ‘মিনিটস অব মিটিং বা এমওএম’ স্বাক্ষরিত হয়। সড়ক অধিদপ্তর সেতুটি নির্মাণের লক্ষ্যে প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাইও সম্পন্ন করে। চীনা কারিগরি প্রতিনিধি দলও সেতু এলাকায় প্রাথমিক জরিপ সম্পন্ন করে তাদের সরকারের প্রাথমিক সম্মতির কথা জানায় ইতোপূর্বে।
কিন্তু এর পরেও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে একের পর এক বাধা প্রদান করে আসছিল। প্রায় ১৪ কিলেমিটার সংযোগ সড়কসহ বেকুঠিয়া সেতু নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১হাজার কোটি টাকা। যার ৮০ভাগ অর্থ চীন সরকার বহন করার কথা রয়েছে। এমনকি চীন সরকারের অর্থায়নে সে দেশের নির্মাণ ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সেতুটি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করারও কথা। প্রথম পর্যায়ে ৩শ’ মিলয়ন ইউয়ান বা ৪শ’ কোটি টাকার অনুদান চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে চীনা অর্থায়নে সড়ক ও জনপথের তত্ত্বাবধানেই বেকুঠিয়া সেতু নির্মাণের বিষটি নিশ্চিত হয়েছে। আগামী বছরের গোড়ার দিকে বেকুঠিয়াতেই চীন-বাংলাদেশ ৮ম মৈত্রী সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ২০১৯ সালের মধ্যভাগে তা শেষ হবার কথা রয়েছে।
২০০২ সালে ঝালকাঠীর গাবখানে ‘বাংলাদেশ-চীন ৫ম মৈত্রী সেত’ু উদ্বোধনকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বেকুঠিয়াতে সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সে সময় সড়ক অধিদফতর সেতু এলাকায় প্রাথমিক জরিপ ও সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও ঐ সেতুটি নির্র্মাণের প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরে সেতু বিভাগ নতুন করে সম্ভাব্যতা যাচাই ও জরিপ সম্পন্ন করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ করেছিল। কিন্তু বহিঃসম্পদ বিভাগের জোরালো পদক্ষেপের অভাবে দাতা না মেলায় বেকুঠিয়াতে সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়া ক্রমশ পিছিয়ে যায়।
তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও চীন সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপের ফলে এখন পুরো বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে বলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যেই চীন সরকার সেতুটি নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগসহ মূল নকশা প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। পরবর্তীতে অবকাঠামো নির্মাণে চীনা প্রাক-যোগ্যতা সম্পন্ন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছ থেকে দরপ্রস্তাব গ্রহণ করে করে চূড়ান্ত বাছাই করা হবে। সব মিলিয়ে আগামী বছরের গোড়ার দিকে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরুর করতে চায় চীন সরকার। তবে তার আগে চূড়ান্ত নকশা অনুযায়ী সেতু নির্মাণ এলাকাসহ সংযোগ সড়কের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে সড়ক অধিদপ্তরকে। এসব খাতে অর্থের যোগান দিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকেই।
এদিকে বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের লেবুখালীতে পায়রা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ২০০৬ সালে গ্রহণ করা হলেও কুয়েত উন্নয়ন তহবিলের সাথে খসড়া ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০১১ সালের প্রথম দিকে। আর ‘চূড়ান্ত চুক্তি’ও হয়েছে ২০১২-এর ১৩ মার্চ। প্রায় ১৪শ’ ৭০মিটার দীর্ঘ ৪ লেনের ঐ সেতুটি নির্মাণে ২০০৬ সালের সরকারী দর অনুযায়ী ৪৮০ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয়ের ৮০ ভাগ অর্থই প্রদান করার কথা ‘কুয়েত উন্নয়ন তহবিলÑকেএফআইডি’। ২০১২-এর ৮ মে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-(একনেক) চূড়ান্ত অনুমোদনও দেয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত এ সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি নানা জটিলতায় শুধু পেছাতে থাকে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নকশা প্রণয়ন ও দরপত্র দলিলসহ নির্মাণ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির ৬মাসের মধ্যে চূড়ান্ত নকশা জমাদানের কথা থাকলেও তাতে প্রায় দেড় বছর সময় পার হয় নানা জটিলতার কারণে।
গত বছর ৩০ সেপ্টেম্বর প্রাক-যোগ্যতা সম্পন্ন ৪টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যে দরপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, তাতে ৪৮০ কোটি টাকার প্রস্তাবিত ‘লেবুখালী সেতু’টির জন্য সর্বনিম্ন দর প্রস্তাব ছিল ১ হাজার ২৭ কোটি টাকা। মূলত ২০০৬ সালের দর অনুযায়ী ২০১৫ সালে দরপত্র আহবান করায়ই এবিপত্তি ঘটে। এমনকি ৪টি দরপত্রের মধ্যে সর্বোচ্চ দরপ্রস্তাব ছিল প্রাক্কলনের প্রায় ৪গুণ ১হাজার ৭শ’ কোটি টাকার ওপরে। কারিগরি ও অর্থনৈতিক মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়ন শেষে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে দর প্রস্তাবসমূহ দাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠানোর পরে সেখান থেকে সর্বনিম্ন দরদাতা চীনা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান-‘ঝিয়াং জি’র ১ হাজার ২৭ কোটি টাকার প্রস্তাবটি অনুমোদন করা হয়। প্রকল্প প্রস্তাবটি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রী পরিষদ কমিটির অনুমোদনসহ কুয়েতের বাড়তি ঋণের যোগান লাভ করার পর আগামী মঙ্গলবার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সাথে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষরের এক মাসের মধ্যেই কার্যাদেশও জারী করবে সড়ক অধিদফতর। ফলে আগামী জুনের মধ্যেই লেবুখালী সেতুর নির্মাণ কাজের প্রাথমিক পর্ব শুরুর হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। ২০১৮ সালের মধ্যেই সেতুটির নির্মাণ শেষ হবার কথা রয়েছে।
কুয়েত উন্নয়ন তহবিল লেবুখালী সেতু নির্মাণে প্রথম পর্যায়ে ১৪ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার ও পরবর্তী পর্যায়ে ২৯ মিলিয়ন দিনারের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তবে এ প্রকল্প খাতে আরো প্রায় ২শ’ কোটি বাংলাদেশী টাকার প্রয়োজন হবে। যা পরবর্তীতে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক বা ওপেক-এর কাছ থেকে ঋণ হিসেবে সংগ্রহের চেষ্টা করবে বহিঃসম্পদ বিভাগ। কুয়েত উন্নয়ন তহবিল সেতুটি নির্মাণে অবশিষ্ট অর্থের যোগানে সব ধরনের সহযোগিতার কথাও জানিয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রস্তাবিত লেবুখালী সেতুর দু’প্রান্তে ৮৯০ মিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণের লক্ষ্যে প্রায় ১২হেক্টর জমি হুকুম দখল প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে ইতোমধ্যে। প্রকল্পটির অওতায় পায়রা নদীর ওপর ১ হাজার ৪৭০ মিটার দীর্ঘ চার লেন বিশিষ্ট যে সেতু নির্মিত হবে, তার মধ্যে মূল নদীর ওপর সেতুর দৈর্ঘ ৬৩০ মিটার। নদীর দু’পাড়ে ‘সংযোগ সেতু বা ভায়াডাক্ট’ থাকছে ৮৪০ মিটার। যা ‘এক্সট্রা ডোজ প্রী-স্ট্রেসড কংকীট গার্ডার’ পদ্ধতিতে নির্মিত হবে। আর মূল নদীর অংশে ‘বক্স গার্ডার ক্যাবল স্ট্রেসড’ পদ্ধতিতে নির্মাণ করা হবে বলে নির্মাণ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন