নূরুল ইসলাম : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে শনিরআখড়া থেকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে উঠলেই গতিসীমার সাইনবোর্ড। সর্বোচ্চ গতিসীমা ৬০ কিলোমিটারের একশ গজ পরেই ‘থামুন’ লেখা লাল সাইনবোর্ড। বাস ও টেম্পো দাঁড়ায় এখানেই। এই দুই গণপরিবহন বাদে অন্যান্য সব ধরনের যানবাহন এখানে এসে হোঁচট খায়। কোনোটা আচমকা ব্রেক করে থামানো হয়, কোনোটা পাশ কাটিয়ে বিপজ্জনক গতিতে চলে যায়। গত শনিবার এ স্থানেই একটি মিনিবাসকে পেছন থেকে ধাক্কা মারে একটি মাইক্রোবাস। তাতে ৮/১০ জন আহত হয়। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপরে নিয়ম ভেঙে বাস স্টপেজ চালু করায় প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। চালু হওয়ার পর থেকে ফ্লাইওভারের ওপরে গত তিন বছরে দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার পৃথক দুর্ঘটনায় মারা গেছে দুজন। দিন দিন যেন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে হানিফ ফ্লাইওভার। এ নিয়ে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এবং ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ রহস্যজনকভাবে নীরব। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ফ্লাইওভার একটি দ্রুতগতির অবকাঠামো। এখানে গণপরিবহন দাঁড়ানো বা যাত্রী ওঠানামা করানোর জন্য বাস স্টপেজ বানানো হয়েছে বাণিজ্যিকীকরণের জন্য। এটা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান একা কখনোই করতে পারে না। আমার ধারণা, এতে পিএসসিসির অনুমোদন নেই। যা কিছু করা হয়েছে তা অবৈধভাবেই করা হয়েছে। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য এটা বন্ধ করা উচিত।
গত কয়েক দিন মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপরে ও নিচে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, আগে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে নির্বিঘেœ চলাচল করা গেলেও এখন আর তা সম্ভব হয় না। কারণ ফ্লাইওভারের ওঠা থেকে শুরু করে নামা পর্যন্ত দুই দিকে সাতটি স্থানে যাত্রীবাহী বাস ও টেম্পো দাঁড়ায়। এ কারণে পেছনের যানবাহনগুলো নির্বিঘেœ চলতে পারে না। আলাপকালে বেশ কয়েকজন চালক ও যাত্রী তাদের ক্ষোভের কথা জানান। তাদের মতে, এখন হানিফ ফ্লাইওভার পার হওয়া মানে টাকা দিয়ে যন্ত্রণা কেনা। গণপরিবহনকে ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে চলার সুযোগ করে দিতে কর্তৃপক্ষ যা খুশি তাই করছে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তার কথা একটুও ভাবছে না। ভাবলে যাত্রাবাড়ীর কেন্দ্রস্থলে এভাবে বাস দাঁড়ানোর জায়গা তৈরি করে দিত না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ীর চৌরাস্তার ঠিক উপরে ফ্লাইওভারের ওয়াল ভেঙে সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। এই সিঁড়ি দিয়ে যাত্রীরা উপরে উঠে যাতে বাস দাঁড়ানোর স্থান পর্যন্ত যেতে পারে সেজন্য আলাদা লেন করা হয়েছে। লেন ধরে গেলেই মিলছে বাস, মিনিবাস ও টেম্পো। গত কয়েক দিন যাবৎ এই স্টপেজ চালু হয়েছে। এই স্থানে বাস দাঁড়ানোর কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে শনিরআখড়া থেকে আসা যানবাহনগুলোকে হোঁচট খেতে দেখা গেছে। বাস স্টপেজ থেকে মাত্র একশ’ গজ দূরে গতিসীমা লেখা ৬০ কিলোমিটার। একশ’ গজের মধ্যে গতিসীমা হঠাৎ করে ৬০ থেকে শূন্য করা যেকোনো যানবাহনের চালকের জন্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কেউ ঝুঁকি নিয়ে ব্রেক করে থামে। কেউবা ঝুঁকি নিয়ে পাশ কেটে চলে যায়। গত শনিবার এই স্থানে একটি মাইক্রোবাস পেছন থেকে দাঁড়ানো একটি বাসকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে মাইক্রোবাসটির সামনের অংশ বাসটির পেছনের অংশে ঢুকে পড়ে। বাসের পেছনের সারির যাত্রী, মাইক্রোবাসের চালক ও যাত্রীসহ ৮/১০জন আহত হয়। প্রত্যক্ষদর্শী ফ্লাইওভারের একজন কর্মচারী বলেন, মাইক্রোবাসটি খুব বেশি গতিতে আসছিল তা নয়। কিন্তু এই স্থানে বাসটি যে দাঁড়াবে এটা মাইক্রো চালকের জানা ছিল না। যে কারণে বাসটি ব্রেক করার পর মাইক্রোবাসের চালক আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন নি। দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত যাত্রাবাড়ী থানার এক এএসআই বলেন, ফ্লাইওভারে বাস দাঁড়ায় বা দাঁড়াবে এটা অনেকেরই অজানা। গাড়িগুলো ফ্লাইওভারে ওঠে সময় বাঁচাতে। তারা দ্রুতবেগে চলবে এটাই স্বাভাবিক। এখানে মাইক্রোবাসের চালকের দোষ দেয়া যাবে না। বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, সর্বোচ্চ গতিসীমা যেখানে ৬০ কিলোমিটার লেখা সেখানে গাড়িগুলো ৮০ বা ৯০ কিলোমিটার গতিতে চলে। এর মাত্র একশ’ গজের মাথায় যদি কোনো গাড়ি দাঁড়ায় বা ব্রেক করে তাহলে তো দুর্ঘটনা ঘটবেই।তিনি বলেন, ফ্লাইওভার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজটি করে ভুল করেছে। এজন্য আরও অনেক প্রাণ ঝরবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, ডিসিসি বা সরকারও এর দায় এড়াতে পারে না।
শুধু এক স্থানে নয়, ফ্লাইওভারের উভয় দিকে মোট ৭টি স্থানে বাস ও টেম্পো দাঁড়ায়। এতে করে পথচারীদের এলোমেলো চলাচলে যানবাহন চলাচলে বিঘœ ঘটছে। এসব নিয়ে ভুক্তভোগীদের ক্ষোভের শেষ নেই। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তানের দিকে আসার পথে কুতুবখালীতে ফ্লাইওভারের প্রবেশ মুখেই যানজট লেগে থাকে দিন রাত। ওই স্থানে ছোট বড় সব ধরণের বাস ও টেম্পো দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে। এতে করে ফ্লাইওভারের প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। সকালে ব্যস্ত সময়ে ওই স্থানে আধা ঘন্টারও বেশি সময় ধরে গাড়িগুলোকে যানজটে আটকে থাকতে হয়। ঠিক একইভাবে গুলিস্তান অথবা ঢাকা মেডিকেলের দিকে নামতে গিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে গাড়িগুলোকে অপেক্ষা করতে হয়। গুলিস্তানে টোলকেন্দ্রে চারটি কাউন্টার থাকলেও তা গাড়ির তুলনায় অনেক কম। গাড়ির সারি ক্রমে লম্বা হয়ে কখনও কখনও টিকাটুলি ছাড়িয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেলের দিকে যেতে মাত্র দুটি কাউন্টার। এখানে রাত দিন ২৪ ঘন্টাই গাড়ির সারি দীর্ঘ থাকে। কাউন্টার অতিক্রম করার পর মেডিকেলের দিকে নামতে গিয়ে দীর্গক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। সরকারী কার্যদিবসে বেলা ১১টার পর গুলিস্তানের যানজটের প্রভাব পড়ে ফ্লাইওভারের উপরে। গুলিস্তানের দিকে গাড়ি নামতে না পারায় কোনো গাড়িই সামনের দিকে আসতে পারে না। অথচ ফ্লাইওবার থেকে নামার পর সোজা চলতে পারে না কোনো গাড়িই। পুলিশ সোজা রাস্তাটি বন্ধ করে রাস্তায় হকারদের বসার সুযোগ করে দিয়ে রাখে। গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ীর দিকে নামতে গিয়ে গাড়ির তুলনায় অপর্যাপ্ত কাউন্টারের কারণে গাড়ির সারি দীর্ঘ হয়। এসব নিয়ে যাত্রীরা অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করেন। নিয়মিত চলাচল করেন এরকম একজন যাত্রী বলেন, আমরা টাকা দিয়ে সময় বাঁচাতে এবং যানজট এড়াতে ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে যাতায়াত করি। কিন্তু ফ্লাইওভার কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারনে পিক আওয়ারে কোনোদিনই যানজট এড়ানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। বরং নিচ দিয়ে গেলে এর চেয়ে আগে যাওয়া যেতো এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় প্রতিনিয়ত। যানজট ছাড়াও ফ্লাইওভারের উপরে বাস স্টপেজ বাড়িয়ে দিয়েছে যাত্রীদের ভোগান্তি। ফ্লাইওভারে সাতটি স্পটে যাত্রীবাহী বাস ও টেম্পো নিয়মিত দাঁড়ায়। শনিরআখড়া থেকে গুলিস্তানের দিকে আসার পথে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার উপরে এবং গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ীর দিকে যেতে ডেমরার রাস্তার মুখে নতুন করে দুটি স্টপেজ তৈরি হয়েছে। গুলিস্তানের দিকে আসার সময় প্রথমে ফ্লাইওভারের প্রবেশপথে, কিছুদূর পর আরও একটি স্থানে নিয়মিত প্রায় সবগুলো যাত্রীবাহী বাস দাঁড়ায়। এরপর সেই বাসগুলো থামে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার ঠিক উপরে। সেখান থেকে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের উপরে আরেকবার দাঁড়ায়। এরপরের স্টপেজ টিকাটুলি রাজধানী মার্কেটের সামনে। আবার গুলিস্তান থেকে শনিরআখড়ার দিকে যাওয়ার সময় প্রথমে ডেমরা সড়কের মোড়ে এরপর যাত্রাবাড়ী পাইকারী বাজারের সোজাসুজি স্থানে বাস দাঁড়ায়। ওই স্থানে একটি পকেটগেট আছে বলে পরিবহন শ্রমিকরা ওই স্থানের নাম দিয়েছে পকেট গেইট। এভাবে কয়েকটি স্থানে বাস দাঁড়ানোর কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি যেমন বাড়ছে তেমনি ফ্লাইওভারের দু’পাশে যানজটের কবল পড়ে যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। একই সাথে ‘ডাইরেক্ট’ ফ্লাইওভার পারাপারের নামে বাসগুলোতে দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সাথে প্রতারণাও করা হচ্ছে।
২০১৩ সালের অক্টোবরে চালু হওয়া ১১ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে গুলিস্তান থেকে শনিরআখড়া ও ধোলাইপাড় পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। চার লেনের ফ্লাইওভারে উঠতে ছয়টি এবং বের হতে সাতটি পথ রয়েছে। ফ্লাইওভারের কয়েক জায়গায় সড়কের সমান্তরালে কংক্রিটের সংযোগস্থলগুলো মোড়ানো হয়েছে ইস্পাতের পাত দিয়ে, যাকে বলা হয় ‘এক্সপ্যানশন জয়েন্ট’। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জয়েন্টে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ফাঁক থাকায় তা দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুইজারল্যান্ডের ম্যাগেবা নামক একটি প্রতিষ্ঠানের ভারতীয় কারখানা থেকে এই এক্সপ্যানশন জয়েন্টগুলো তৈরি করা হয়।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক জানান, সড়ক বা সেতুতে ‘এক্সপ্যানশন জয়েন্ট’ কতটুকু ফাঁক থাকলে যানবাহনের সমস্যা হবে না, তা ঠিক করা আছে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের এক্সপ্যানশন জয়েন্টগুলোতে পৌনে এক থেকে এক ইঞ্চির মতো ফাঁক তৈরি হয়েছে। এটি নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি হতে পারে। তিনি বলেন, এগুলোর পরে আবার নতুন করে বাস দাঁড়ানোর জায়গা তৈরি এসব কোনোটাই ভালো লক্ষণ নয়। ফ্লাইওভারটি পিপিপি’র তৈরি। সুতরাং এটির পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন যা কিছু করা প্রয়োজন তা অবশ্যই নিয়ম মেনে করতে হবে। এজন্য অবশ্যই ডিসিসির অনুমোদন নিতে হবে। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন গতরাতে ইনকিলাবকে বলেন, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারটি একটি মালিকানা প্রকল্প। সব ধরণের স্বত্বাধিকার মালিকপক্ষের। সিটি কর্পোরেশনের কিছু অংশীদারিত্ব আছে মাত্র। এজন্য কি তারা মূল নকশার পরিবর্তন করতে পারে? এ প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, ফ্লাইওভারের উপরে বাস দাঁড়ানো বা নতুন করে সিঁড়ি তৈরি করার বিষয়টি আমার নলেজে নেই। কাল অফিসে গিয়ে জেনে তারপর বলতে পারবো।
***************
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন