স্টালিন সরকার : রাজধানীর পুরান ঢাকায় চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে দু’টি হত্যাকা- ঘটে। একটি ইসলামপুরের ঝব্বু খানম জামে মসজিদের মুয়াজ্জিম মাওলানা বেলাল হোসেন; অন্যটি সূত্রাপুরের একরামপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিম উদ্দিন সামাদ। দু’জনই খুন হন নৃশংসভাবে। নাজিম উদ্দিনকে নিয়ে তার পরিবারের যেমন স্বপ্ন ছিল; তেমনি বেলাল হোসেনকে নিয়ে স্বপ্ন ছিল পরিবারের। দু’টি মানুষের জীবনের মূল্য কারো চেয়ে কম নয়। দুই পরিবারের সদস্যরা স্বজনকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। খুন মানেই জঘন্য অপরাধ। কিন্তু পুরান ঢাকার দু’টি খুনের ঘটনায় পরবর্তী চালচিত্র যেন, ‘দু’জনার দুটি পথ দু’দিকে গেছে বেঁকে’ গানের মতো। নাজিম উদ্দিন হত্যাকা-ের প্রতিবাদে মিছিল সমাবেশ হচ্ছে; অবরোধ হচ্ছে; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছে। খুনের খবর নিয়ে দেশী-বিদেশী মিডিয়া বেশ গরম। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা থেকে শুরু করে দেশের মানবাধিকার সংস্থা ও সংস্কৃতি সেবীরা নাজিমের খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে সোচ্চার। খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে আল্টিমেটাম, একের পর এক কর্মসূচি দিচ্ছেন। অথচ বেলাল হোসেনের খুনের ব্যাপারে সবাই একেবারেই নিশ্চুপ। নিজাম মানুষ বেলাল মানুষ নয়? নিজামের জীবনের মূল্য ছিল; বেলালের জীবন মূলহীন? মসজিদের মুয়াজ্জিম বলেই কি তার প্রতি বিবেকবানদের এত অবহেলা? কেন এই দ্বিমুখী নীতি আমাদের? তাহলে কি আমজনতা ধরে নেবে মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, আলেম, মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রী বিশেষ করে যারা ইসলামের খেদমত ও ধর্মচর্চা করেন সমাজে তাদের জীবন মূল্যহীন? নাকি তারা খুন হলে জাতির কিছু আসে যায় না?
দেশে নিত্যদিন মানুষ খুনের ঘটনা ঘটছে। খুন-হত্যাকা- দেশে যা ঘটছে তার সামান্যই প্রকাশ পাচ্ছে মিডিয়ায়। দুই দফায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪১ জন। এতগুলো মানুষ খুনের পরও নির্বাচন কমিশন ‘খামোশ’ হয়ে আছে। আর সরকার ও বুদ্ধিজীবীরা এসব মৃত্যুর ঘটনাকে সহিংসতা হিসেবে চালিয়ে দিয়ে দায় এড়াচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হিসাব মতে, দেশে ২০১৫ সালে গড়ে প্রতিদিন ১৪ জন খুন হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের হিসাব হলো ২০১৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত খুন হয়েছে চার হাজার। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৩২৯ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৩০৯ জন, মার্চে ৩৩৭ জন, এপ্রিলে ৩২৭ জন, মে মাসে ৪২০ জন, জুনে ৩৫৮ জন, জুলাইয়ে ৩৮১ জন, আগস্টে ৩৩৭ জন, সেপ্টেম্বরে ৩৩৮ জন, অক্টোবরে ৩২১ জন ও নভেম্বরে ২৯৭ জন খুন হয়। ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ পর্যন্ত খুন হয়েছেন ২৪৬ জন। চলতি বছরেও খুনের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এই যে হত্যাকা- এবং ব্যক্তি খুন হলেন তারা কারো বাবা, কারো ভাই, কারো স্বামী, কারো ছেলে, কারো বোন। প্রাণ হারানো মানুষগুলোর জীবনের মূল্য পরিবারের সদস্যদের কাছে অনেক। অনেকেই ছিলেন পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি; কেউ ছিলেন পরিবারের সবচেয়ে আদরের ধন; কেউ ছিলেন মায়ের কলিজার টুকরা। প্রতিটি হত্যাকা-ে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু কয়টা খুনের তদন্ত হয়েছে; বিচার হয়েছে? কয়টা খুনের বিচারের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে? দেশের বিবেকবান সুশীল, বুদ্ধিজীবীরা খুন হওয়া কতজনের হত্যাকারীর বিচার চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন? কুমিল্লার নাট্টশিল্পী সোহাগী জাহান তনু হত্যার বিচারের দাবিতে রাজপথে সোচ্চার হয়েছে কিছু সংগঠন এবং এলাকার মানুষ। সারাদেশে তনু হত্যার বিচারের দাবিতে মিছিল, মানববন্ধন হচ্ছে। তার বন্ধু-বান্ধবী ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসছে। তনু হত্যার বিচারের দাবি যৌক্তিক। কিন্তু অন্য যারা খুন হচ্ছেন তাদের খুনের বিচারের দাবিতে বিবেকবানদের বিবেক কাঁদছে না কেন? কেন এই দ্বিমুখিতা?
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মুক্তমনা ব্লগের লেখক অভিজিৎ রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে খুন হন। ওই বছর ৩০ মার্চ ওয়াশিকুর রহমান রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার বেগুনবাড়িতে খুন হন। একই বছরের ১২ মে অনন্ত বিজয় দাস নামের একজন খুন হন। ৭ আগস্ট রাজধানীর খিলগাঁওয়ের দক্ষিণ গোড়ানে খুন হন নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়। দু’মাসের মাথায় ৩১ অক্টোবর রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপন খুন হন। তাদের খুনিদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে মিটিং-মিছিল হয়েছে। অপরাধীদের গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। যদিও এসব হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করেছে বিশেষ সংস্থা। মিডিয়াও তোলপাড় হয়েছে। দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠন ও ব্যক্তিরা এসবের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে খুনিদের গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছেন। এমনকি ইসলামবিদ্বেষী ব্লগাররা বাংলাদেশে নিরাপদ নয়, এমন প্রচারণা করে তাদের আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলো আশ্রয় দেয়ার প্রস্তাবনা নিয়ে গুঞ্জন চলছে।
অন্যদিকে এই সময়ের মধ্যে ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জে শিয়া মতাবলম্বী একটি মসজিদে নামাজরত অবস্থায় খুন হন মসজিদের মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেন। এছাড়াও রংপুরের কাউনিয়ার টেপামধুপুরের একটি মসজিদের ইমাম, ময়মনসিংহের ভালুকায় মসজিদের মুয়াজ্জিন, পঞ্জগড়ের গৌরী মঠের হিন্দু পুরোহিত, রাজধানী ঢাকার রমনায় মসজিদের ইমাম, বাড্ডার খানকায়ে পীরসহ কয়েকটি হত্যাকা- ঘটে। পাবনায় এক খ্রিষ্টান ধর্মযাজকের গলা কেটে ফেলা হয়। এসবের রেশ কাটতে না কাটতেই রাজধানীর পুরান ঢাকার ইসলামপুরে মসজিদের ভেতরেই মুয়াজ্জিন হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার দু’দিন পর একই এলাকায় নাজিমউদ্দিন খুন হন। ব্লগার (কবি, সাতিহ্যিক, সাংবাদিক, লেখক মানুষের পরিচিতি; কিন্তু ব্লগার কোনো পরিচিতি হতে পারে না) হত্যাকা-ের পর বিচারের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন সমাজের কিছু মানুষ। কিছু মিডিয়াও অনুসন্ধানী রিপোর্টের পাশাপাশি আন্দোলনের খবর প্রচার করায় সে আন্দোলন বেগবান হয়েছে। বিদেশী মিডিয়াগুলোও এসব হত্যাকা-ের খবর ফলাও করে প্রচার করছে। খুনিদের ধিক্কার জানাচ্ছেন। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা ওই সব হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা জানিয়ে সুস্থ তদন্তের মাধ্যমে বিচারের দাবি করছেন। হত্যাকা-ের বিচারের দাবি যৌক্তিক। কিন্তু মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, মঠের পুরোহিত খুনের পর ওই বিবেকবানরা দ্বিমুখী কৌশল গ্রহণ করে নীরব থাকছেন। ইসলামবিদ্বেষী ব্লগারদের জীবনের মূল্য আছে; মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, মঠের পুরোহিতের জীবনের মূল্য নেই? দ্বিমুখিতা কি বোধবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো বিবেকবান মানুষের সাজে?
রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে ‘আমরা’ শব্দটির ব্যবহার কমে এসেছে। তোমার আমার শব্দটি ব্যাপকভাবে চর্চা হচ্ছে। নিজের পক্ষের বিশেষ করে ব্লগার, ইসলামবিদ্বেষী, তথাকথিত প্রগতিশীল, বিজাতীয় সংস্কৃতি চর্চার ধারক-বাহক ও নিজ ঘরানার কেউ হত্যাকা-ের শিকার হলে তথাকথিত প্রগতিশীল ও মিডিয়াগুলো বুদ্ধিদীপ্ত হন; ঘটনা শুনতে পেয়ে বিবেকের তালা খুলে দিয়ে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন; বিবৃতি দেন। মিডিয়ায় কভারেজ দেন। কিন্তু ইসলামপন্থী, খোদাভীরু মানুষ, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন খুন হলে নীরব থাকেন; হয়ে যান বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। ভাবখানা কিছুই যেন ঘটেনি তিনিও শুনতে পাননি। একই ধরনের হত্যাকা-ের পরও কখনো বোধশক্তিসম্পন্ন হন; কখনো হন বোধশক্তিহীন। বিবেকের তাড়নায় কখনো হন অনুভূতিসম্পন্ন, কখনো থাকেন অনুভূতিহীন। কেন এই দ্বিমুখিতা? দুর্ভাগ্যজনক হলো মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন হত্যাকা-ের পর খুনিদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে ইসলামী দলগুলোও মাঠে নামার প্রয়োজন বোধ করে না। কিছু সংগঠন বিবৃতি দেয় এবং দু-একটি প্রতিবাদ মিছিল করেন সেটাও দায়সারাভাবেই। তাহলে কি মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জীবন এতই মূল্যহীন?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন