এ থেকে এক কথাও আমি ছাড়তে পারব না।’ অতঃপর তিনি (হিনদার কাছ থেকে) সম্পূর্ণ অর্থই আদায় করে নেন। কারণ লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে এটি হয়নি। অন্যান্য খলিফার আমলেও বায়তুলমাল থেকে ঋণ দান করা হত। ঐতিহাসিক তাবারী বলেন, ‘উসমান রা.-এর খিলাফতকালে সা’দ ইব্ন আবি ওয়াক্কাস রা. কে বায়তুলমাল থেকে ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছিল”প্রসঙ্গত উল্লেখক্য যে, “হাজাজ্জ ইব্ন ইউসুফ কৃষি উৎপাদনের জন্য ইরাকের কৃষকদের বিশ লক্ষ দিরহাম ঋণ বিতরণ করেছিলেন। বর্তমান যুগের ব্যাংকগুলোও বাণিজ্যিক শিল্পগত প্রভৃতি (উৎপাদনশীল) উদ্দেশেখ্য পুঁজি সরবরাহ করে বটে, তবে এর উপর সুদ কেটে নেয়। অথচ ইসলামী বায়তুলমাল জনসাধারণকে ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য ঋণ দিত এবং শুধু এর লাভ-ক্ষতির মধ্যেই শরিক থাকত। অনুৎপাদনশীল উদ্দেশ্যে যে ঋণ দেয়া হয়, তাতে ঋণ গ্রহীতার যেন এরূপ ক্ষতি না হয় যে, তাকে মূল পুঁজির উপর সুদ হিসেবে অতিরিক্ত কিছু দিতে হয় এবং ঋণ দাতারও যেন এরূপ ক্ষতি না হয় যে, তার মূল পুঁজির কোনরূপ ঘাটতি দেখা দেয়। ইমাম ফাখরুদ্দীন আর রাযী রহ. কুরআনের সুদ সম্পর্কিত আয়াত “তোমরা অত্যাচার করবে না এবং অত্যাচারিতও হবে না”এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন: ঋণ গ্রহীতার উপর এরূপ অত্যাচার যেন না হয় যে, তার কাছ থেকে মূল পুঁজির উপর অতিরিক্ত কিছু তলব করা হয় এবং তোমাদেরকেও যেন তোমাদের মূল পুঁজির মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হতে না হয়।
বিদায় হজ্জে রাসূল স. পরিষ্কার ভাষায় ঘোষনা করেছিলেন: প্রত্যেক প্রকারের সুদই অবৈধ, অবশ্য মূল পুঁজি তোমাদেরই এবং এটা তোমাদের পাওয়া উচিত, যাতে তোমাদের উপর কোন অত্যাচার না হয় এবং তোমরাও অন্যদের উপর যাতে অত্যাচার না কর। কুরআন মাজিদের বিভিন্ন জায়গায় ধনিক শ্রেণীকে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং কোথাও কোথাও নির্দেশও দেয়া হয়েছে, যেন তারা বিত্তহীন লোকদেরকে তাদের প্রয়োজনের সময় টাকা ধার দেয়। কুরআনের দৃষ্টিতে এও একটা বিরাট পুণ্যের কাজ। এ পন্থায় ধনিক শ্রেণীর টাকাও সংরক্ষিত থাকে এবং সমাজের বিত্তহীন লোকেরা তাদের বিপদও কাটিয়ে উঠতে পারে।
উপরিউক্ত কারণেই ইসলামী রাষ্ট্রের কোথাও সুদী ঋণের কোন নাম-নিশানা ছিল না। কুরআনের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে কিছু লোক তাদের মৃত্যুর পরবর্তী সময়ের জন্যও কিছু অর্থ ‘ওয়াকফ’ করে যেত, যাতে বিপন্ন লোকেরা এ থেকে সুদবিহীন ঋণ পায় এবং এতে করে তাদের দ্বারা দুনিয়ায় একটি পুণ্যের কাজ জারী থাকে। গত শতাব্দীতে ‘পেয়েরে জোসেফ প্রম্নধোঁ (১৮০৯-১৮৬৫) নামক কমিউনিস্ট সুদকে সমস্ত সামাজিক দুর্নীতির মূল বলে অভিহিত করেন এবং একে উৎখাত করার জন্য তিনি যে প্রস্তাব পেশ করেন তা হল “এমন একটি বিনিময় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হোক, যা থেকে ব্যবসায়ী এবং কারিগরকে সুদবিহীন ঋণ দেয়া হবে। তার মতে, যদি এরূপ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয় তাহলে কোন লোকই ঋণের জন্য পুঁজিপতিদের শরণাপন্ন হবে না”।
যদি বিত্তশালী লোক ঋণী অবস্থায় মারা যায়, তাহলে ইসলামী আইন অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি থেকেই তার ঋণ পরিশোধ করা হবে। আর যদি ঋণগ্রহীতা কপর্দকহীন অবস্থায় মারা যায়, তাহলে ‘বায়তুলমাল’ থেকেই তার ঋণ পরিশোধ করা হবে। ইসলামের প্রথম যুগে যখন কোন মুসলিম ঋণী অবস্থায় মারা যেত, তখন অন্য কোন মুসলিম কিংবা মৃতের কোন আত্মীয় তার ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব গ্রহণ করত। অতঃপর যখন বায়তুলমালের আয় বৃদ্ধি পায়, তখন সেখান থেকেই বিত্তহীনদের ঋণ পরিশোধ করা হতে থাকে। রাসূলুল্লাহ স.-এর কাছে যদি এমন কোন জানাযাকে নিয়ে আসাত হত, যার উপর ঋণের বোঝা রয়েছে, তিনি স. নিজে তার নামায না পড়ে মুসলিমদের বলতেন, ‘তোমরা তোমাদের সঙ্গীর নামায পড়ে নাও।’ অতঃপর যখন মুসলিমরা বিভিন্ন দেশের উপর আধিপত্য বিস্তার করে, তখন তিনি স. বলতেন: আমি মু’মিনদের জন্য তাদের নিজেদের অপেক্ষাও অধিক দায়িত্বশীল। অতএব, যে লোক ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মরে গেল এবং সে ঋণ পরিশোধ করার মত কিছুই রেখে যায়নি, তার এ ঋণ শোধ করার দায়িত্ব আমার উপর বর্তাবে। আর যে লোক ধনমাল রেখে যাবে, তা তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টিত হবে।
বায়তুলমাল হলো দরিদ্র ও অভাবী জনগণের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। কেননা, তা কোন আমির বা বিশেষ কোন শ্রেণির সম্পদ নয়, তা সাধারণ মানুষের সম্পদ। অসহায় নিঃস্ব মানবতার প্রয়োজন পূরণের কোন উপায় না থাকলে রাষ্ট্র বা বায়তুলমালই তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্ব নিবে। তিনি আরো বলেন: যে লোক ঋণগ্রস্ত হয়ে অথবা সহায়-সম্বলহীন অক্ষম সন্তানাদি রেখে মরে যাবে, পরে তারা যেন আমার নিকট আসে। কেননা, এরূপ অবস্থায় আমিই তাদের অভিভাবক। যে লোক ধন-মাল রেখে মারা যাবে, তা তার উত্তরাধিকারীরা পাবে। পক্ষান্তরে যে লোক দুর্বহ বোঝা, অসহায় সন্তানাদি ও পরিবার রেখে যাবে, তা বহনের দায়িত্ব আমার উপর বর্তাবে। রাসূলুল্লাহ স.-এর পর তাঁর খলীফারাও এ দায়িত্ব পালন করেন। খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও এ নিয়ম ছিল যে, কপর্দকহীন ঋণগ্রহীতাদের ঋণ সরকারি কোষাগার অর্থাৎ বায়তুলমাল থেকে পরিশোধ করা হত।
বিশ্বে আজ ও.আই.সি.র সদস্যভূক্ত সাতান্নটি মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে। এসব রাষ্ট্র যদি রাসূলুল্লাহ স. ও খুলাফায়ে রাশেদিনের যুগের ন্যায় বায়তুলমাল তথা রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জনকল্যাণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য কার্যকর করে, বায়তুলমালের অর্থ দিয়ে জনগণের প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে, আপদকালীন সময়ে মানুষের পাশে দিয়ে দাড়ায়, বায়তুলমাল থেকে সুদবিহীন ঋণদানের ব্যবস্থা করে, তাহলে তা বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের জন্য দিক নির্দেশকের ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশ্বমানবতার জন্য তা অনুকরণীয় হতে পারে। মুসলিম বিশ্বের জনগণের জীবনমান উন্নত করার জন্য, তাঁদের মধ্যকার উচু-নীচু ভেদাভেদ দূর করার জন্য বায়তুলমাল বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। অতএব, বলা যায় বায়তুলমালের সম্পত্তি সুপরিকল্পিতভাবে ব্যয় করলে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের সমাজ জীবনেও বায়তুলমাল গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। বাংলাদেশের ন্যায় দরিদ্র ও অনুন্নত দেশে প্রান্তিক জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে বায়তুলমাল হতে পারে অতুলনীয় ব্যবস্থা। দেশের ধর্মপ্রাণ ও মানবদরদী ব্যক্তিগণ প্রতি বছর যে পরিমাণ যাকাত, ফিতরা দেন এবং দান-সাদাকাহ করে থাকেন তা দিয়ে পরিকল্পিতভাবে বায়তুলমাল নামক তহবিল গঠন করে সুপরিকল্পিত উপায়ে অভাবী, অসহায়, ছিন্নমূল, হতদরিদ্র মানবতাকে স্বাবলম্বী করে তোলা সম্ভব। যার মাধ্যমে তারা ভিক্ষুক বা পরনির্ভর শ্রেণিতে পরিণত না হয়ে স্বনির্ভর হবে। যাকাত-ফিতরা গ্রহণ না করে যাকাত-ফিতরা দান করার উপযোগী হবে। এর জন্য দরকার সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন