শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মস্তিষ্কে স্থাপিত চিপের সাহায্যে ডান হাতের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তি

প্রকাশের সময় : ১৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : পাঁচ বছর আগে সদ্য কলেজ পাশ করা যুবক আয়ান বার্কহার্ট উত্তর ক্যারোলিনার সমুদ্র সৈকতে সাগরে ঝাঁপ দেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তার মাথা পানির নিচে বালির মেঝেতে আঘাত করে ও ঘাড় ভেঙ্গে যায়। তিনি স্থায়ীভাবে হাত ও পায়ের অনুভূতি হারান।
এপ্রিল ডাক্তাররা জানান যে ২৪ বছর বয়স্ক বার্কহার্ট তার ডান হাত ও আঙ্গুলের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছেন। তার হাতের মাংসপেশিসমূহ দিয়ে তার চিন্তা সরাসরি প্রবাহিত করা এবং তার মেরুদন্ডের ক্ষতকে অতিক্রম করার একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা এ সাফল্য লাভ করেন। নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত চিকিৎসকদের এ গবেষণায় মারাত্মক পক্ষাঘাতের শিকার কোনো মানুষের আঙ্গুলের পুনরায় অনভূতি ফিরে পাবার প্রথম ঘটনার কথা জানা গেছে।
বার্কহার্টের মস্তিষ্কে দু’বছর আগে একটি চিপ বসানো হয়। একটি গবেষণাগারে বসে কম্পিউটারের ভিতর দিয়ে মস্তিষ্কের চিপের সাথে তার বাহুর আস্তিনকে সংযুক্ত করা হয়। তিনি বারংবার শিক্ষা ও অভ্যাসে বোতল থেকে পানি ঢালতে এবং একটি নাড়াচাড়া করার স্ট্র নিতে ও তা দিয়ে দ্রবণ করতে সক্ষম হন। এমনকি তিনি একটি গিটার ভিডিও গেমও বাজান।
ওহিওর ডাবলিনের অধিবাসী ব্যবসা বিষয়ের ছাত্র বার্কহার্ট টেলিফোন সাক্ষাতকারে বলেন, এ এক অবিশ্বাস্য বিষয়। কারণ আমার হাতগুলোতে কোনো অনুভূতি ছিল না। আমি আঙ্গুল গোটাতে বা প্রসারিত করতে পারি কি না তা বোঝার জন্য হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হত। তার আঘাত তার বুকের নিচ থেকে বাকি অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে। তার কাঁধ ও বাহুর মাংসপেশিতে কিছু নড়াচড়া আছে।
নতুন প্রযুক্তি পক্ষাঘাত নিরাময়ক নয়। বার্কহার্ট তার হাত তখনি নাড়াতে পারেন যখন তা গবেষণাগারে কম্পিউটারগুলোর সাথে সংযুক্ত থাকে। গবেষকরা বলছেন, এ ব্যবস্থার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভ্রাম্যমাণ স্বাধীনতা দেয়ার আগে অনেক কিছু করার আছে।
তবে স্নায়বিক প্রকৌশলের ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি ঘটছে। মস্তিষ্কে চিপ ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের সংকেত উদ্ধার ও সুনির্দিষ্ট গতিবিধির সাথে তার সামঞ্জস্য বিধান করতে পারেন। আগে লোকে তাদের চিন্তা অনুযায়ী স্ক্রিনের উপর একটি কার্সর পরিচালনা করতে শিখেছিল, স্তন্যপায়ী প্রাণিরা শুধু স্নায়বিক সংকেত ব্যবহার করে দক্ষতার সাথে একটি রোবোটিক বাহু ব্যবহার করতে শিখেছিল এবং বিজ্ঞানীরা স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন যে চিন্তা বাহুর মাংসপেশিকে নাড়াতে পারে। এই নতুন গবেষণা এটাই দেখায় যে বাইপাস পদ্ধতি মস্তিষ্কের সাথে আর সংযুক্ত না থাকা আঙ্গুলের জরুরি অনুভূতি পুনরুদ্ধার করতে পারে।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর সেন্সরিমোটর নিউরাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পরিচালক রাজেশ রাও বলেন, তারা যা দেখিয়েছেন তা অত্যন্ত চমকপ্রদ, কিছু তুলে নেয়া, কিছু ঢালা ও ও স্ট্র নাড়িয়ে কিছু দ্রবণ করাÑ এগুলো এ ধরনের রোগীদের আমরা যতটা সম্ভব যে স্বাধীনতা দিতে চাইছি সে লক্ষ্যে এক অগ্রগতি।
আঘাত পাওয়ার পর বার্কহার্ট পুনর্বাসনের জন্য কয়েকমাস আটলান্টায় ছিলেন। তারপর তাকে তার বাড়ির কাছে ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সেখানে চিকিৎসকদের বলেন যে তিনি পরীক্ষামূলক চিকিৎসায় অংশ নিতে চান। বার্কহার্ট বলেন, ‘আমি ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় ছিলাম। তবে তার অর্থ ছিল এই যে আমার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করতে হবে যা আমার দরকার ছিল না।’ তার পরিবার এর বিরুদ্ধে ছিল।
২০১৪ সালে ওহিও রাজ্যের একটি অস্ত্রোপচারকারী টিম তার হাতের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের যে অংশ তা বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে ব্রেন ইমেজিং ব্যবহার করেন। মস্তিষ্কের বামপাশে ও কানের ঠিক উপরের ঐ স্থানটি মোটর কর্টেক্স এলাকা নামে পরিচিত। অস্ত্রোপচারকালে টিম স্থানটি আরো সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে বের হয়ে আসা মস্তিষ্ক টিস্যু ব্যাপকভাবে পরীক্ষা করেন।
সার্জন ও ওহিও স্টেটের সেন্টার ফর নিউরোমড্যুলুশনের পরিচালক ডা. আলি রেজাই বলেন, অপারেশনটি করতে ৩ ঘণ্টা লেগেছিল। সঠিক স্থানটি খুঁজে পেতে আমাদের দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। তিনি একটি ইরেজারের মাথার আকৃতির একটি চিপ ঐ স্থানে স্থাপন করেন। চিপটি পৃথক নিউরোন বর্ষণ রেকর্ড করার জন্য ৯৬টি ফিলামেন্ট সদৃশ “মাইক্রোইলেকট্রোডস” ধারণ করছে।
বাকহার্টের ক্ষত নিরাময় হওয়ার পর প্রশিক্ষণ শুরু হয়ঃ হাতের নড়াচড়ার জন্য প্রতি সপ্তাহে গবেষণাগারে বিভিন্ন ধরনের অনুশীলন। কম্পিউটারের সাথে বার্কহার্টের মাথার পিছনে লাগানো কেবলের মধ্য দিয়ে চিপের নিউরোন বর্ষণের পদ্ধতি সংগ্রহ করা।
ওহিওর কলম্বাসে একটি অলাভজনক সংস্থা ব্যাটেলি মেমোরিয়াল ইনস্টিটউট অন্যান্য সরঞ্জামের সাথে চিকিৎসা সরঞ্জামও তৈরি করে। এর বিজ্ঞানীরা ঐ নিউরোন বর্ষণ পদ্ধতির রহস্য উদ্ধারের লক্ষ্যে সফটওয়ারের ডিজাইন করেন। ব্যাটেলির একজন সিনিয়র গবেষণা নেতা হার্বাট ব্রেসলার বলেন, প্রতিটি সেশনেই ঐ সংকেত পুনঃক্রমাঙ্কিত করতে হয়।
ডা. ব্রেসলার বলেন, সংকেত অব্যাহত ভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে এবং আমাদের সেসব পরিবর্তন সমন্বয় করতে হয়। তিনি বলেন, মেশিন শেখে যেমন শেখে আয়ান বার্কহার্ট।
ডা. ব্রেসলার হলেন চলমান প্রকল্পের অন্তর্বর্তী প্রধান। পূর্বের প্রধান ইনভেস্টিগেটর ও চাকরি পরিবর্তনকারী শাদ বুটন হচ্ছেন প্রধান লেখক। ডা. রেজাই সহ ওহিও রাজ্য ও ব্যাটেলিতে আরো এক ডজন সহ-লেখক রয়েছেন।
বার্কহার্ট বলেন, প্রশিক্ষণ ছিল বিরক্তিকর। একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ কম্পিউটার তাকে স্ক্রিনে বিভিন্ন ধরনের নড়াচড়ার চেষ্টা করার পদ্ধতি দেখাতেন। তিনি বলেন, আমাকে সত্যি সত্যিই সেগুলো করার জন্য মনঃসংযোগ করতে হত যা আমি কোনো পূর্বচিন্তা ছাড়াই করতাম। তবে বিষয়টি ছিল খেলার মতÑ আপনি যত বেশী কাজ আর কাজ করবেন, ক্রমেই তা সহজ হয়ে উঠবে।
কয়েকমাস পর বার্কহার্টের আর বিশেষজ্ঞের সহায়তা প্রয়োজন হয়নি। ডা. রেজাই বলেন, প্রথমবারের মত তার হাত মুঠো করতে দেখা ছিল এক পরাবাস্তব মুহূর্ত। আমরা উপস্থিত সবাই একে অপরের দিকে চাইছিলাম আর ভাবছিলামÑ ও.কে, এইমাত্র কাজটি শুরু হল।
এক বছর প্রশিক্ষণের পর বার্কহার্ট একটি বোতল তুলতে ও তার পানি একটি পাত্রে ঢালতে সক্ষম হন। তিনি একটি স্ট্র ধরতে এবং তা দিয়ে দ্রবণের কাজ করেন। চিকিৎসকরা যদিও উল্লসিত, তবু তারা বলেন যে বাইপাস ব্যবস্থাকে বাস্তবসম্মত, সাশ্রয়ী ও কম অনাক্রমণমূলক করতে আরো উন্নয়ন করা প্রয়োজন, খুব সম্ববত তা করতে হবে ওয়ারলেস প্রযুক্তির মাধ্যমে। তবে এ অগ্রগতিটি ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত গবেষণাগারে, তা এ জন্য যে পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞরা বার্কহার্টের বিকলতাকে মারাত্মক সি৫ পর্যায় থেকে অনেক কম মারাত্মক সি৭ পর্যায়ে পুনঃশ্রেণিকরণ করতে পেরেছিলেন।
বর্তমানে এ প্রকল্পÑ যা কিনা বার্কহার্টকে নড়াচড়ার ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়েছে, তার জন্য বরাদ্দ তহবিল এ বছরেই শেষ হবে। বার্কহার্ট বলেন, এটা এক বিপদ হতে চলেছে। আমি এখান থেকে অত্যন্ত উপকার লাভ করেছি। আমি যদি বাড়িতেও এ অগ্রগতিটুকু ধরে রাখতে পারি তাহলে আরো অগ্রগতি হবে। এখন আমাকে বহু বিষয়েই কারো উপর নির্ভর করতে হয়। যেমন কাপড় পরা, দাঁত মাজা প্রভৃতি সকল বিষয়। আমি চাই অন্য লোকেরাও এ বিষয়টি জানুক। তারা জানুক যে আশা আছে। চারপাশে এমন কিছু আসবে যাতে এ ধরনের আঘাত নিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকা যায়। সূত্র দি নিউ ইয়র্ক টাইমস।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন