মুহিউসসুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান
॥ শেষ কিস্তি ॥
(২৫ মার্চ ২০১৬ প্রদত্ত বয়ান)
নিজের ভাইয়ের কল্যাণকামী হওয়া যেমন বিবেকের চাহিদা, তেমনি ক্ষতি কামনা করাও বিবেকপ্রসূত চাহিদা নয়। বিকারগ্রস্ত মানসিকতাসম্পন্ন লোক ভাইয়ের অকল্যাণ কামনা করে, ক্ষতি করতে তৎপর হয়ে ওঠে। তাই ভাইয়ের ক্ষতি থেকে বিরত থাকা চাই। উপরের দিকে থুথু নিক্ষেপ করলে যেমন তা নিজের শরীরে এসে পড়ে, তদ্রƒপ ভাইয়ের ক্ষতি কামনা নিজের ক্ষতি করার শামিল। নিজের মধ্যে মনুষত্ববোধ ও মানবতার বিলুপ্তি ঘটলে ভাই তার আপন ভাইয়ের ক্ষতি চাইতে পারে। এটি চরম স্বার্থপরতা। নিজের ক্ষতি চায় না অথচ ভাইয়ের ক্ষতি করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। নিজের পরম সুখ লাভের আশায় ভাইয়ের ক্ষতি কামনা করে। সমাজ যার পরিচয় দেয় ‘স্যাডইজম’। অসুস্থ, বিবেকহীন বিকারগ্রস্ত লোক এ ধরনের ‘স্যাডইজম’ কাজ করে থাকে। অতএব, পরস্পর আপন ভাই হয়ে থাকারও কোনো বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরেকটি পরামর্শ দিচ্ছেন, তোমরা এক ভাই আরেক ভাইয়ের সহায়ক হবে। এ তো গেল ধর্মমত নির্বিশেষে সকলের প্রতি রাসূলের সুকৌশলী পরামর্শ।
কিন্তু মুসলমানদের জন্য রাসূলের উদাত্ত আহ্বান ন্যূনতম পাঁচটি বিষয়ে একে অপরের সহযোগী হবে। শৈশব-কৈশরে, কবরে, হাশরের উত্তপ্ত ময়দানে, পুলসিরাত ও আখেরাতে একে অপরের সাহায্যের হাত প্রসারিত করবে। এসব কালপরিক্রমায় যে পাঁচ বিষয়ে সহযোগিতা করবে, তার অন্যতম হলো ধর্মীয় বিষয়ে অর্থাৎ ঈমান-আমলের প্রতি পরস্পর সহযোগী হবে। এমন সহযোগিতা করবে না যেটা নিজের ও তার ভাইয়ের ঈমান-আমলের জন্য ক্ষতিকর। অতীতে নিজের ঈমানের হেফাজতের জন্য ইসলামের বীরপুরুষরা শৌর্য-বীর্যের পরিচয় দিয়েছেন। জান-মাল, ইজ্জত-আবরুর কোনো পরোয়া তারা করেননি। এ ঈমান হেফাজত করতে গিয়ে ইমাম আবু হানিফা, আহমদ ইবনে হাম্বল শাফেয়ী, মালেক, বুখারী রহ. প্রমুখ অসহ্য বেদনা অকাতরে সয়ে গেছেন। এ ঈমান হেফাজত করার দায়িত্ব আমার। আমার ভাইয়ের। তাই এ বিষয়ে পারস্পারিক সহযোগিতা থাকতে হবে।
ঈমান রক্ষার জন্য হয়ত জান যাবে, রক্তাক্ত হবে জনপদ, তবুও ঈমান রক্ষার দাবি থেকে সামান্যতম পিছপা হওয়া যাবে না। শুধু এতেই ঈমান রক্ষা নয়, ঈমানের দাবি অনুপাতে নিবিষ্ট মনে ইবাদতে নিমগ্ন হওয়াও ঈমান রক্ষার নামান্তর। কারণ ঈমানের পিপাসা হলো ইবাদত। মানুষ যেমন তৃষ্ণার্ত হয়, সে তৃষ্ণা নিবারিত হয় শীতল পানিতে। লবণাক্ত কিংবা তিতো পানি সে সময়ে মানুষকে কড়া লিকারের মতো কেবল ঝাঁঝিয়ে তোলে। তেমনি ঈমানকে শরীর মনে করলে ঈমানেরও তৃষ্ণা লাগে, পিপাসাক্ত ঈমানের তৃষ্ণা নিবারণ হয় কেবল ইবাদতে। আর ইবাদতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নামাজ আদায় করলে ঈমানের ক্ষুধা নিবারণ, রোজা রাখলে পেটের ব্যথা নিঃসরণ, যাকাত দিলে অযাচিত লোভ দূরীভূতকরণ আর হজ আদায় করলে মানবজাতির প্রতি ঈমানী ভ্রাতৃত্ববন্ধন সূচিত হয়। এছাড়াও ঈমানের রকমফের ব্যাধির জন্য হরেকরকম প্রতিষেধক মজুদ আছে। সেগুলো প্রতিসেবনে ঈমান সুস্থ-সবল থাকে।
এ ঈমান শুধু শরীরের সাথেই সম্পৃক্ত নয়। এটি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শরীর, ব্যক্তি ও রাষ্ট্র পর্যায়ে ঈমানের চাহিদা হলো কেউ কারো সম্পদ লুট করবে না। অর্থনীতি হবে পানির মতো স্বচ্ছ। হারাম উপার্জন হবে না। ধোকা দিবে না। মিথ্যা বলবে না। পরনিন্দা করবে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম সমুন্নত রাখতে আল্লাহর রাসূলের আদর্শে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করবে। ধর্মীয় চেতনা, ভাবধারা, বিশ্বাস, স্বকীয়তা এবং অধিকার আদায়ে পরস্পর একাত্মতা পোষণ করবে। এটিই ঈমানের দাবি।
আল্লাহ কুরআনে কারীমে বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করলাম।’
প্রসিদ্ধ আয়াত এটি। বলা হয়, কুরআনের সর্বশেষ আয়াত এটি। নাযিল হয়েছে আরাফার ময়দানে। সময়কাল তখন ৯ম হিজরি। হজের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাদ আসর জাবালে রহমতে দাঁড়িয়েছেন লোকসম্মুখে কিছু বলার জন্য। ইসলামের ইতিহাসে যেটি ‘বিদায় হজের ভাষণ’ হিসেবে খ্যাত। সামনে উপস্থিত লক্ষাধিক তৌহিদী জনতা। এত মানুষের সামনে বয়ানকালে মাইক কিংবা আওয়াজ বুলন্দের কোনো যান্ত্রিক উপায়-উপকরণ ছিল না। তথাপি সে সময়ে উপস্থিত সাহাবীদের রেওয়ায়েতে পাওয়া যায়, সে সময়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা এতটাই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল যেন রাসূল সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। বস্তুত এটি ছিল রাসূলের মোজেযা। তিনি হয়ত আগেই জেনে গিয়েছিলেন তাঁর মহান বন্ধুর সান্নিধ্যে যাওয়ার কথা। এ কারণে আল্লাহর রাসূল ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বলছেন, হে উপস্থিত লোকসকল, আমি কি তোমাদের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে ইসলামের বাণী পৌঁছাতে পেরেছি? কথাটি রাসূল তিনবার বলেছিলাম। উপস্থিত জনতা সমস্বরে বলেছিলেন, অবশ্যই আপনি পৌঁছিয়েছেন। তখন রাসূল আবার বললেন, আমি কি আসলেই পৌঁছাতে পেরেছি? সকলে আবারও সমস্বরে বললেন, হে নবী অবশ্যই আপনি পৌঁছিয়েছেন। এভাবে আরও একবার কথোপকথন হলো। ইসলামের ইতিহাসে এমন পুণ্যময় সমাবেশ দ্বিতীয়টি নেই। সেই সমাবেশে লক্ষাধিক সাহাবা সমস্বরে সাক্ষ্য দিলেন, হে নবী অবশ্যই আপনি আমাদের মাঝে ইসলামকে পুঙ্খানুপুঙ্খ উপস্থাপন করেছেন। তখন ওহী আসলোÑ আলইয়াওমা আকমালতু লাকুম...। এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা যেন বলতে চাইছেন, হে নবী আমি আদম আ. থেকে দীন শুরু করেছি। মাঝখানে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়েছে। এখন শুনুন, আমি কুরআন নাযিল করলাম। এর একটি যের-যবর হেরফের হতে পারে না। এর কোনো পরিবর্তন নেই। এটি চিরন্তন সংবিধান। এ সংবিধানের সামান্যতম অংশ পরিবর্তনযোগ্য নয়। মুসলমান না এর পরিবর্তনে একমত হবে, না হতে দিবে।
এ চিরন্তন সংবিধানের শুরুতে লেখা আছে ‘বিসমিল্লাহ’। বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু হওয়া এ পবিত্র সংবিধানে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করলাম’। এখানে ঈমান-আকিদা, ইবাদত-বন্দেগি, ছোট-বড়, পুরুষ-মহিলা, শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ সব বিষয়ের বিধি-বিধান সন্নিবেশিত হয়েছে। কোথাও সামান্যতম ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই। তাই ইসলামের এসব বিষয়ে না পরিবর্তন করা যাবে, না পরিবর্ধন করা যাবে। যারা পরিবর্তন করবে, তারা মুলহিদ, তারা বিজাতি। মুসলিম সম্প্রদায়ের সংবিধান এর আলোকেই হতে হবে।
কুরআন নিয়ে ৭৩টি ফিরকা হবেÑ আল্লাহর রাসূল এমনটিই বলেছেন। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণে, দলীয় স্বার্থে মানুষ বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। নিজেদের দল-মত প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যাচ্ছেতাই করবে। জেনে রেখো, যারাই এরূপ করবে তারা আমার উম্মত নয়।
তাহলে উম্মত কে? ‘যে মত ও পথের ওপর আমি ও আমার সাহাবায়ে কেরাম আছে’ যারা সেটা গ্রহণ করবে তারাই মূলত সুস্থ উম্মত (উম্মতে ইজাবাহ)। যেটা কুরআনে আছে, যে দর্শন আমার সুন্নতে আছেÑ জীবনের সর্বক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করেছে আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী, আনাস প্রমুখের মতো জগদ্বিখ্যাত সাহাবী। ইসলাম কি পকেটে থাকা ছোট বস্তু, নাকি ইসলাম সামগ্রিক জীবনব্যবস্থাÑ তারা সেটা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে। তারা রাষ্ট্র চালিয়েছে। অর্থনীতির সুষ্ঠু ব্যবস্থা করেছে। শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী, দরিদ্র-কৃষক, দিনমজুর এবং সমাজপতি মোড়লদের কিভাবে সংশোধন করতে হয়। বৃদ্ধদের সহযোগিতা কিভাবে করতে হয়Ñ এসব কিছু পবিত্র কুরআনে রয়েছে। হাদিস শরীফে রয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের জীবনীতে রয়েছে। এর বাইরে ইসলাম নেই। মুসলিম জাতির সংবিধানের এসবই মূলনীতি ও চিরন্তন রূপরেখা। ইসলামকে কাটছাঁট করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন