এমদাদুল হক সুমন, নওগাঁ থেকে : ভারতের পানি আগ্রাসনে ও এক তরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে এক সময়ের খরস্রোতা আত্রাই ও ছোট যমুনা নদী যেন এখন মৃত খালে পরিণত হয়েছে। ৩৮৫ কিলোমিটার দীর্ঘ আত্রাই নদী প্রতিবছরই প্রয়োজনীয় মুহূর্তের শেষ সময়ে শুকিয়ে যাওয়ায় সেচ কাজে আর পানি পাওয়া যায় না। ছোট যমুনা নদীরও একই অবস্থা।
স্বাধীনতার পর থেকে মওকা পেয়ে ভারত আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে তাদের দীর্ঘ পরিকল্পণা অনুয়ায়ী এক প্রকার জোরপূর্বকভাবে নদীর মুখে বাঁধ দিয়ে এক তরফা পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে চলেছে। এতে তাদের স্বার্থ হাসিল হলেও অত্র অঞ্চলে ব্রি- (ইরি) ধান চাষের মওসুমে পানির প্রবাহ স্বাভাবিকের চেয়ে অত্যন্ত কম হওয়ায় কৃষকেরা দিনদিন ফসল চাষাবাদ নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, বর্তমান প্রতি বছর মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত নদী ২টি একেবারে শুকিয়ে যায়। তাই প্রয়োজনের মুর্হূতে ভাটির দিকের কৃষকেরা পানির অভাবে চাষাবাদ করতে পারছেন না। অথচ এক সময় প্রতি বছর প্রবল বন্যার পানির তোড়ে নদীর উভয় তীরে তীব্র ভাঙ্গন দেখা যেত। তখন নদীর নিকটবর্তী ঘরবাড়ি, ফসলের জমি, রাস্তা-ঘাট,হাট-বাজার, বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, অফিস গ্রাস করে নিত। সময়ের ব্যবধানে এখন বাংলাদেশের ৫৩টি বড় বড় নদীর মতো আত্রাই ও ছোট যমুনা নদীরও বেহাল দশা হয়েছে। এটিও কালের অতল গহর্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চলে বন্যার তেমন দেখা পাওয়া যায় না। ভরা বর্ষা মওসুমেও নদী দুটির পানি তেমন একটা বাড়ে না। তবে ২০১৫ সালে বন্যা যেন একটু হলেও মাথা চাড়া দিয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, নদীটি হিমালয় পর্বতমালার কৈলাস শৃঙ্গ হতে উৎপত্তি হয়ে ভারতের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে প্রথমে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলা উপর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে আত্রাই নদী নাম ধারণ করে প্রবাহিত হচ্ছে। এরপর বোদা উপজেলা, পঞ্চগড় সদর, আবার বোদা উপজেলা হয়ে দেবীগঞ্জ দিয়ে দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ,কাহারোল, দিনাজপুর সদর, চিরিরবন্দর ও বিরল উপজেলা হয়ে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করেছে। পরে এটি দ্বিতীয়বারের মতো বৃহত্তর নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার উপর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে পত্মীতলা, মহাদেবপুর, মান্দা, আত্রাই ও নওগাঁ উপজেলা হয়ে নাটোর জেলার সিংড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম দিয়ে পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুরা, ফরিদপুর, সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলার ভিতর দিয়ে প্রায় ৩শ’ ৮৫ কিলোমিটার দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বির্স্তীণ এলাকার অনেক লোকালয় ও অনেক বিখ্যাত এলাকা নদীগর্ভে বিলীন ও ধ্বংস করে শ্লথ গতিতে প্রবাহিত হয়ে বৃহত্তর যমুনা নদীতে গিয়ে মিশেছে।
নদী অববাহিকায় অবস্থিত বির্স্তীণ এলাকার কয়েক লাখ মানুষ নদীটির পানি ব্যবহার করে তাদের কৃষিকাজসহ পরিবারের প্রয়োজনের দৈনন্দিন কাজকর্ম চালাত। ৮০’র দশকেও দু’পাড়ের বাসিন্দারা নদীর উপর নির্ভরশীল ছিল। আগে ৮৫ ভাগ মৎস্যজীবী নদী দুটিতে মাছ ধরে তাদের সংসার চালাত। কিন্তু বর্তমানে নদীতে পানি কম থাকায় আগের মতো তেমন কোন মাছও পাওয়া যায় না। ফলে এলাকাবাসী দেশী মাছ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। মৎস্যজীবীরা তাদের পরিবার নিয়ে মানবেতন জীবনযাপন করছেন। একমাস ধরে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় মৎস্যজীবীরা কোন কাজ না পেয়ে একেবারে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন দাদন ব্যবসায়ী ও এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন।
মান্দা উপজেলার প্রসাদপুর গ্রামের জেলেপাড়ার স্বপন, অঞ্চল, তপন, খুদিয়াডাঙ্গার নিরেশ, বীরেনসহ অনেকে আবার পেশা বদলিয়ে কেউ কেউ বিভিন্ন দোকানে, চা-স্টল, কৃষি শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশায় জড়িত হচ্ছেন। এক সময় এখানকার প্রায় ৭০ ভাগ কৃষকেরা সরাসরি নদীর পানি সেচের মাধ্যমে চাষাবাদের কাজ করত। কিন্তু এখন নদীর বেশিরভাগ অঞ্চল শুকিয়ে বড় বড় চর পড়ে। তাছাড়া নদীর পানি প্রবাহ অত্যন্ত কম হওয়ায় পলি পড়ে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে জমির উর্বরতা শক্তি ও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ব্রি-ধান সেচের মাঝপথে এসে নদীটি পুরোপুরি শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। বর্তমানে বেশিরভাগ টিউবওয়েলে বিশুদ্ধ পানি ও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে পানিতে আর্সেনিকের মাত্রাও বেড়ে গেছে।
নওগাঁর মান্দা উপজেলার প্রসাদপুর বাজারের আতাউর রহমান, আকরাম হোসেন, প্রসাদপুর গ্রামের আবুল কালাম, নিপেন চন্দ্রসহ এলাকাবাসী ও ব্যবসায়ী ভোলানাথ, আবদুর রসিদ, মৎস্যজীবী খুদিয়াডাঙ্গা গ্রামের সিরাজ উদ্দিন কবিরাজ, জানান, ৩৫ বছর আগেও এ নদী ছিল স্থানীয় যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান চালিকাশক্তি। নদীটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল প্রসাদপুর বাজার, কালিকাপুরবাজার, পঁাঁটাকাঠাহাট, জোতবাজার, পাঁজরভাঙ্গাহাট, মিঠাপুকুরহাট, দাসপাড়া প্রভৃতি হাট-বাজারসহ গঞ্জ ও বন্দর। এক সময় নদী দুটিতে যাত্রী বহনে ও মালামাল পরিবহনে লঞ্চ, ফেরিসহ বড় বড় নৌকা চলাচল করলেও বর্তমানে যা ইতিহাস। এখন এসব বন্দরের কোন জৌলুস নেই।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে সংস্কার না হওয়ায় নদীটি এখন এলাকাবাসীর তেমন কোন কল্যাণে আসতে পারছেনা। শুষ্ক মওসুমের আগেই পানি শুকিয়ে যাওয়ায় নদীর বুক চিরে এখন সবুজের সমারোহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নদীর দু’পারের বাসিন্দারা তাই মহা ধুমধামে ধান, গম, মরিচ, টমেটো, আলু, মিষ্টি আলু, পেঁয়াজ, রসুন, তিল, খিরা, মিষ্টি কুমড়াসহ রকমারী ফসলের চাষাবাদ করছেন। এলাকাবাসীর দাবী অচিরেই নদীটিকে বাঁচাতে হলে ভারতের একতরফা নদী আগ্রাসনের হাত থেকে যেমন রক্ষা করতে হবে, তেমনি পরিকল্পিত ও বিকল্প উপায়ে নদীর ড্রেজিং করতে সরকারকে সময় থাকতেই উদ্যোগ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন