হাসান-উজ-জামান : ঘটনাটি গত বছরের। ৭ আগস্ট ভোর থেকে কলাবাগান ব্রিজ সংলগ্ন ফুটপাতে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলো একটি ভারী কার্টন। যে কার্টনে ভরে রাখা হয় ফ্রিজ। সেটিকে ঘিরে একদিকে কৌতুহল অন্যদিকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। লোকজন বিষয়টি অবহিত করেন স্থানীয় থানায়। পুলিশ এসে সেটি খোলেন। এর পরই হতচকিয়ে ওঠেন। দেখতে পান সাদাগেঞ্জি ও কালো প্যান্ট পরিহিত এক যুবকের নিথর দেহ। যার হাত-পা বাঁধা। গলায় গামছা পেঁছানো। তড়িঘড়ি করে গলার গামছার বাঁধন খোলা হয়। দেখা যায় এ হ্যান্ডসাম এ যুবকের দেহে প্রাণ নেই। ততক্ষণে সেটির পরিচয় হয় যুবকের লাশ। আনুমানিক ৪০ বছরের এ যুবকের লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করে তা ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল মর্গে। অজ্ঞাত এ যুবকের পরিচয় উদঘাটনে পুলিশ মাঠে নামে। কিন্তু ব্যর্থ তারা। লাশটি বেশ কিছু দিন পড়ে থাকে মর্গে। পরিচয় না মেলায় শেষ পর্যন্ত বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফনের জন্য হস্তান্তর করা হয় আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামকে। যে সংস্থাটি বেওয়ারিশ লাশের দাফনসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আযম মিয়া গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, হতভাগা ওই যুবককে আঘাত করে হত্যা করেছে খুনিরা। পরে লাশ ফ্রিজের কার্টনে ভরে কলাবাগান মাঠের ফুটপাতের ওপর ফেলে যায়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেছে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত নিহতের পরিচয় কিংবা খুনিদের সম্পর্কে জানা যায়নি। নূরে আযম মিয়া আরো বলেন, নিহত যুবকের ছবি ও আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। কোন দাবিদার পেলে তখন তাদের ডিএনএ’পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করা হবে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে রাজধানীর সিকদার মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তায় ডিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ২ যুবক। পুলিশের দাবি, নিহতরা পুরান ঢাকার হোসনিদালানে হামলাকারী এবং জেএমবি নেতা ছিলেন। দীর্ঘদিন তাদের লাশ পড়ে ছিলো ঢাকা মেডিকেল মর্গে। ঢাকা মেডিকেল সূত্র জানায়, লাশ দুটির কোন দাবিদার না পেয়ে শেষে গত ১০ এপ্রিল বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের জন্য আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
লাশ মিলছে খালে, বিলে, রাস্তারধারে এমনকি ডাস্টবিনেও। সড়ক দুর্ঘটনা, রেল লাইনে কাটা পড়ে, লঞ্চ ও নৌকা ডুবি কিংবা পানিতে ডুবে মারা যান অনেকে। এসব ঘটনায় নিহতদের অনেকেরই পরিচয় মেলে না। আবার পূর্ব শত্রুতা কিংবা অপহরণের পরেও অনেককে হত্যার পর লাশ ফেলে দেয়া হয় যেখানে সেখানে। অনেক ক্ষেত্রে পরিচয় উদঘাটন না হয় সেজন্য লাশের চেহারা বিকৃত করে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এসব লাশই এক সময় পরিচিতি পায় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য বেওয়ারিশ লাশের একটি বড় অংশই নবজাতকের।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সদ্য বিদায়ী এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (সাবেক সচিব) কাজী আবুল কাশেম ইনকিলাবকে বলেন, শুধুমাত্র ২০১৩-১৪ অর্থ বছরেই ৫ শতাধিক নবজাতকের লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। পুলিশ এসব নবজাতকের লাশগুলোর বেশিরভাগই উদ্ধার করেছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। হয়তো ডাস্টবিন কিংবা রাস্তা থেকে। এসব নবজাতক কোন না কোন নারী পুরুষের অবৈধ ফসল। এ পরিসংখ্যান থেকেই আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ ও আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্রটি ফুটে উঠে। তিনি আরো বলেন, যতদিন না সমাজে সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে ততদিন এ সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। এদিকে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সূত্রমতে, গত ১ বছরে (২০১৫) বেওয়ারিশ হিসেবে সংস্থাটি ১২৮৪টি লাশ দাফন করেছে। আর চলতি বছরের তিন মাসে ৩৪১টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়। এ হিসেবে মাসে ১১০টিরও বেশি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে এ সংস্থাটি। অর্থ বছরের হিসেবে এ সংস্থাটি ২০১২-১৩ অর্থ বছরে ১৪৯৫টি, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৩২৫টি ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে ১৩৩৩ জন নারী পুরুষের বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। আর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বেওয়ারিশ নবজাতকের ৪৯৪ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মাত্র কয়েকমাসে ১৬৪টি নবজাতকের লাশ দাফন করা হয়। ২০১৪ সালের আগের সাড়ে ৬ বছরে অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবে শুধু আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম ৬ হাজার ৭০০ জনের লাশ দাফন করেছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সূত্র মতে, ২০১৫ সালে এক বছরে সেখানে মোট ১৩ হাজার ৬৭১টি লাশের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে ৯৮টি লাশ ছিলো বেওয়ারিশ। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৪৯৫টি লাশের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে ৭টি লাশ বেওয়ারিশ। ফেব্রয়ারি মাসে ময়না তদন্ত হয় ২০টি। যার মধ্যে ১১টি বেওয়ারিশ লাশ। নবজাতকের রয়েছে ৫টি।
এ পরিসংখ্যান শুধু ঢাকা এবং আঞ্জুমান মুফিদুলের আঞ্চলিক কয়েটি এলাকার। সারা দেশের হিসেবে এ সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হবে বলে ধারণা করছেন বিশেষঞ্জরা। হিসেব মতে, বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বাড়ছেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্ঘটনা, অপমৃত্যু এবং খুন বেওয়ারিশ লাশের অন্যতম কারণ।
দৈনিক ইনকিলাবের সঙ্গে আলাপকালে ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলা বলেন, সামাজিক মূল্যবোধ এবং নীতিবোধের অভাবে মানুষ তার মনুষত্ব ও মানবতা হারিয়ে পাশবিক প্রতিহিংসাসহ নির্মম, নিষ্ঠুরতার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যে কারণে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য প্রতিপক্ষকে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ যেখানে সেখানে ফেলে দিচ্ছে। মানুষকে হত্যা করার মধ্যে কোন কৃতিত্ব নেই। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখাই কৃতিত্ব। সম্ভব হলে কারো উপকার করা উচিত- কারো ক্ষতি করা উচিত নয়। এটাই প্রতিটি মানুষের আদর্শ হওয়া উচিত।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী প্রধান এলিনা খান দাবি করেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বেড়ে যায়। তিনি বলেন, বিভিন্ন দুর্ঘটনায়ও অনেকে নিহত হন। যাদের পরিচয় মেলে না। সে ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির ছবি স্থানীয় এবং জাতীয় সবগুলো পত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে। প্রয়োজনে সবগুলো ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। এ জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে সার্কুলার জারি করা যেতে পারে। এক কথায় রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। বিভিন্ন স্থান থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় মানুষের শরীরের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন অংশ উদ্ধার করা হয়। তাদেরকে হত্যা করার স্পষ্ট নমুনা মেলে। এটি অসুস্থ সমাজেরই নির্দেশনা।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, প্রত্যেকেরই জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা নিজের ঠিকানা লিখে তা সঙ্গে রাখা উচিত।
পরিচয়হীন লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশন্স এন্ড ব্রাঞ্চ এফিয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিম বখ্শ ইনকিলাবকে বলেন, দুর্ঘটনা ও অপমৃত্যু ঘটছে। বাড়ছে খুন-খারাবি। বাড়ছে জনসংখ্যাও। এসব কারণেই বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বাড়ছে। লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ করে থাকে। আমরা পুলিশ এবং মর্গের কাগজপত্রসহ লাশ বুঝে নেই। সিটি কর্পোরেশনের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে সে সব লাশ দাফন করি। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের নিজস্ব কোন কবরস্থান নেই। যে কারণে কোন একটি লাশ নিয়ে মামলা হলে, ওই তারিখে দাফন করা সবগুলো লাশই কবর থেকে তুলতে হয়। এটা খুবই অমানবিক। বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া লাশের মধ্যে হত্যা, ট্রেনে কাটা, সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাই বেশি। তবে হত্যাজনিত ঘটনায় বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। ঢাকা মহানগরীতে উদ্ধার হওয়া পরিচয়হীন এসব লাশ দাফন করা হয় জুরাইন ও আজিমপুর কবরস্থানে।
মানবাধিকারকর্মী ও সমাজবিজ্ঞানীরা লাশ শনাক্তে পুলিশের পদক্ষেপ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তারা মনে করেন, অন্যান্য মামলার ন্যায় বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধারের পর পুলিশের তদন্ত যথেষ্ট নয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, মানুষ হিসেবে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি রাষ্ট্রের নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, বেওয়ারিশ লাশের পরিচয় শনাক্তের ক্ষেত্রে পুলিশ যথাযথ উদ্যোগ নেয়। আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করা হয়। কোন অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ নিহত ব্যক্তির ছবি টেলিভিশন ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা প্রকাশ করে। তারপরও দুর্ঘটনাসহ নানা কারণে লাশ বিকৃত থাকায় অনেক সময় পরিচয় শনাক্ত দুষ্কর হয়ে যায়। এই লাশগুলোর পরিচয় জানার সম্ভাবনা অনেক কম। তবে অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ সফল হয়েছে। বেওয়ারিশ প্রতিটি লাশের ছবি সংরক্ষণ করে গোয়েন্দা পুলিশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন