নিজস্ব বিমানের দেখা নেই। নেই কোন ধরনের অনুমতি পত্র (এনওসি)। অথচ কেবিন ক্রু-বিমান বালাসহ বিভিন্ন পদে কর্মী নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। লোভনীয় বেতন ও তরুণী ক্রুদের সাথে ডিউটির অফার দেয়া হচ্ছে। আর চাকুরির নিয়োগ দেয়ার নামে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এ অভিযোগ উঠেছে জাপান বাংলাদেশ (জেবি) এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধে। তবে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয় কয়েকটি পদের বিপরীতে ট্রেনিং এর খরচের অর্ধেক টাকা নেয়া হচ্ছে। তবে চাকুরি প্রত্যাশীদের অভিযোগ, কখনো জামানত আবার কখনো ট্রেনিংসহ আনুষাঙ্গিক খরচের জন্য অর্থ দাবি করছে জেবি কর্তৃপক্ষ। তাদের আশঙ্কা ইতিপূর্বে নেপচুনসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান এভাবে নিয়োগ বাণিজ্য করে হাওয়া হয়ে গেছে। জেবিও মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হবে এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায়না।
সিভিল এভিয়েশনের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, যাত্রিবাহী বিমান হিসেবে বাংলাদেশে জেবি এয়ার লাইন্স এখনো চালুই হয়নি। আর চাকুরির নামে এ ধরনের জামানত নেয়া সম্পূর্ণ বেআইনি। যা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
এদিকে একটি সূত্র বলছে, কোন ভাল এয়ার লাইন্স কখনো চাকুরি প্রত্যাশীর কাছ থেকে জামানত নেয়না। তারা যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগ দেন। তবে এর আগে নেপচুন এয়ারলাইন্সসহ বেশ কয়েটি কোম্পানী এভাবে চাকুরি দেয়ার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। ওই সূত্রের দাবি, জেবি এয়ার লাইন্সও ওই সব কোম্পানীর মতো টাকা হাতিয়ে নিয়ে গা ঢাকা দেয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায়না। ইতিমধ্যে অনেক ক্রু প্রত্যাশী জেবি এয়ার লাইন্সকে প্রতারনার হাতিয়ার বলে উল্লেখ করেছেন। তারা বলেন, বড় ধরনের ঘটনা ঘটার আগেই জেবি প্রতিষ্ঠানের চাকুরি বাণিজ্যের নামে কি হচ্ছে তা সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত করে দেখা উচিত। অন্যথায় অনেক মেধাবী তরুনের সর্বনাশ হতে দেরি লাগবে না।
জেবি এয়ারলাইন্সের ফেইসবুক পাতায় উল্লেখ করা হয়েছে, জেবি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের বিমান চলাচল খাতে একটি সদ্য আসন্ন এয়ার লাইন্স। একটি বাণিজ্যিক যাত্রী এয়ারলাইন্সের সাথে সাধারণ বিমান চলাচল করার জন্য আমরা দিগন্ত ছাড়িয়ে যাচ্ছি। জেবি বিমান খাতে গবেষনা করে এবং বিমান চলাচল ব্যবসার চ্যালেঞ্জ গ্রহন করে জাপান বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স শুরু করে।
কেবিন ক্রু পদে চাকুরির বিজ্ঞাপন দেখে জেবি এয়ার লাইন্সের অফিসে যোগাযোগ করেছিলেন কয়েকজন উদ্যমী তরুণ। ভূক্তভোগী তারাও। নিজেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সব ভূক্তভোগীরা জানান, বিডি জবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে জেবি এয়ার লাইন্সে চাকুরির সুযোগ আছে জানতে পেরে তারা প্রতিষ্ঠানটির গুলশান-১ নম্বর ২৩/সি নম্বর রোডের ১০ নং হোল্ডিংস্থ অফিসে যোগাযোগ করেন। যদিও মতিঝিল বলাকা ভবনের লেভেল-১০এ জেবি এয়ারলাইন্সের অপর একটি ঠিকানার কথা উল্লেখ আছে। তবে বলাকা ভবনের ওই ঠিকনাটি একেবারেই ভূয়া।
ওই সব তরুনরা জানান, গুলশানের অফিস থেকে তাদের ক্রু হিসেবে নিয়োগের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। তবে জুড়ে দেয়া হয় কয়েকটি শর্ত। প্রথম শর্ত হচ্ছে, চাকুরি প্রত্যাশিকে সব সময় একাকি অফিসে আলোচনায় যেতে হবে। এছাড়া প্রত্যেকের কাছেই ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা দাবি করা হয়। যার অর্ধেক পরিশোধ করতে হবে ট্রেনিং শুরুর আগেই। তাদের বলা হয়, গুলশানে তাদের নিজস্ব ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে। তবে পরে আবার বলা হয়েছে, মহাখালীর সরকারি ট্যুরিজম থেকে তাদের প্রশিক্ষন কোর্স করানো হবে। এসব শিক্ষার্থীদের বলা হয়, অতি শীঘ্রই দেশের ২৫টি রুটে ২৫টি এয়ারক্রাফট দিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে জেবি এয়ার লাইন্স। এয়ার ক্রু দের প্রাথমিক বেতনই ধার্য করা হবে ১২শ’ ডলার অথবা সম পরিমান ৯৬ হাজার টাকা। লোভনীয় এ ধরনের বেতন অফারে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত জামানত দিতে রাজী হয়েছে অনেকে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা দেখা গেছে, মতিঝিলের বলাকা ভবনের লেভেল-১০ জেবি এয়ারলাইন্সের যে ঠিকানার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে ওই প্রতিষ্ঠানের কোন অস্তিত্ব নেই। বলাকা ভবনের সীমাবদ্ধতা লেভেল-৮ পর্যন্ত। ভবনটির প্রধান গেটের নিরাপত্তাকর্মীরা জানিয়েছেন, প্রতি দিনই একাধিক লোক ওই ঠিকানা খুঁজতে আসে। এদিকে ঢাকার গুলশানের যে ঠিকানা ব্যবহার করা হচ্ছে সেখানে নেই চোখে পড়ার মতো কোনো সাইনবোর্ড। শুধু মাত্র দরজায় জেবি এয়ারলাইন্সের একটি স্টিকার সাটানো রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে যারা বসেন তারা চাকুরি প্রত্যাশীদের কাছে বলে বেড়াচ্ছেন, দেশের স্বনামধন্য একটি গ্রæপ অব কোম্পানীর কর্ণধার জেবি এয়ারলাইন্সের প্রধান ব্যক্তি। আসলে এর সবই মিথ্যা। গুলশানের ওই অফিসটি জেবি এয়ার লাইন্সের অফিস হিসেবে গত ৪ মাস ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর আগে নামী-দামী অনেককে সেখানে বড় বড় পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজনকেও নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। এদের মধ্যে অনেকেই চাকুরি ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের তাদের কাছে জেবি এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের মনোভাব সুবিধাজনক মনে হয়নি। নিজেদের ইজ্জতের কথা চিন্তা করেই তারা চাকুরি ছেড়ে দিয়েছেন। এদিকে চাকুরি প্রত্যাশীদের কিংবা ট্রেনিং করতে ইচ্ছুকদের পৃথক পৃথকভাবে ডাকা হয়। তাদের সাথে আলোচনার ধরনও ভিন্ন। এ নিয়ে চাকুরি প্রত্যাশীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের সন্দেহ প্রতিষ্ঠানটি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে।
জেবির গুলশান কার্যালয়ে এক্সিকিউটিভ পদে কাজ করেছিলেন একজন নারী। কিছুদিন পূর্বে তিনি সেখানকার চাকুরি ছেড়ে দিয়েছেন। চাকুরি ছাড়ার কারন ও জেবি এয়ারলাইন্সের ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি কোন ধরনের মন্তব্য করতে রাজী হননি।
এ বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা ইনকিলাবকে জানান, জাপান বাংলাদেশ (জেবি) এয়ারলাইন্স নামে কোন প্রতিষ্ঠান আছে বলে তাদের জানা নাই। অনুমোদনের প্রশ্নই ওঠেনা।
এ ব্যাপারে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম সচিব জনেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, জেবি এয়ার লাইন্সের নাম প্রথম শুনলাম। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো এয়ারলাইন্স চালুর প্রক্রিয়ায় আছে কিনা সেটাও আমার জানা নেই। তাদের বিমান চালানোর অনুমতি আছে কিনা সেটা সিভিল এভিয়েশন অথরিটি ভালো বলতে পারেন।
তবে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান এমডি এনামুল হক ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশে জাপান বাংলাদেশ (জেবি) এয়ারলাইন্স চালুর বিষয়টি চুড়ান্ত। ইতিমধ্যে এনওসি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) হাতে পেয়েছেন তারা। এখনো দক্ষ জনবল নিয়োগ চুড়ান্ত হয়নি। এছাড়াও কিছু টেকনিক্যাল প্রবলেম রয়েছে। সব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে কয়েকটা দিন সময় লাগবে। আগামি ১ সেপ্টেম্বর জাপান-বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বাংলাদেশে চালু হবে। তাদের বিমানগুলো জাপানের কারখানাগুলোতে রয়েছে। উদ্বোধনের আগে বাংলাদেশে বিমান এনে লাভ কি? শুধু শুধু সিভিল এভিয়েশনকে ভাড়া গুনতে হবে। চাকুরি প্রত্যাশীদের কাছ থেকে ট্রেনিংয়ের খরচ নেয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ট্রেনিংয়ের খরচের অর্ধেকটা নেয়া হয়। বাকি অর্ধেক কোম্পানী বহন করবে। ঘুষ কিংবা জামানত হিসেবে অর্থ নেয়ার বিষয়টি ভিত্তিহীন। উত্তরা, গুলশান, মহাখালিসহ বিভিন্ন স্থানে কেবিন ক্রু ও এয়ার হোস্টেসদের ট্রেনিং করানো হবে। তিনি আরো বলেন, পাইলট, ইঞ্জিনিয়ার, অপারেশন, লোডার, এক্সিকিউটিভসহ বিভিন্ন পদেই লোক নিয়োগ হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ৫০ জন কেবিন ক্রু নেয়ার কথা ছিলো। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ২০ জন নেয়া হয়েছে। বাকিদের নেয়া হবে, নেপাল-ভুটান-থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশ থেকে। বাংলাদেশে কি ক্রু হবার মতো দক্ষ ও মেধাবি শিক্ষার্থীর অভাব রয়েছে কিনা জানতে চাইলে এনামুল হক বলেন, অনেক শিক্ষার্থী ট্রেনিংয়ের জন্য এসেছিলো। কিন্তু ইউসএস বাংলা নামে একটি এয়ারলাইন্স তাদের ভুল তথ্য দিয়েছে। যে কারণে তারা আসেনি। তাছাড়া ইউএস বাংলা তাদের নিয়ে গেছে। একটি প্রতিষ্ঠান জেবির নামে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। তারাই মতিঝিলের ঠিকানা ব্যবহার করেছে। এ ব্যাপারে জেবির আইন শাখা কার্যকরি উদ্যোগ নিয়েছে। তারা বিষয়টি দেখভাল করছে। তিনি আরো বলেন, নিন্দুকেরা জেবির পেছনে লেগেছে। তবে অল্পদিনের মধ্যেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে বলে তিনি দাবি করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন