রাস্তার নাম ‘৩০০ ফুট’। পূর্বাচল প্রকল্পের এ রাস্তাটি মূলত এক্সপ্রেসওয়ে। নিরিবিলি এক্সপ্রেসওয়েটি আর আগের মতো নেই। সন্ধ্যা হলেই এ রাস্তায় সৃষ্টি হয় ভয়াবহ যানজট। রাত যতো বাড়ে যানজটও ততো বাড়ে। প্রকল্পের জন্য তৈরী এ রাস্তা দিয়ে সমানে চলাচল করছে আন্ত:জেলা বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন ভারী যানবাহন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, যে হারে ভারী যানবাহন চলাচল করছে তাতে যানজট ছাড়াও খুব শিগগিরি এ রাস্তাটি অন্যান্য রাস্তার মতো ভেঙ্গে একাকার হয়ে যাবে। ২০০৪ সালে পূর্বাচল নতুন শহরের সঙ্গে রাজধানীর সংযোগ সৃষ্টির জন্য রাজউক ৩০০ ফুট রাস্তা প্রকল্পটি গ্রহণ করে। প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের ওই প্রকল্পে আজও নিরবচ্ছিন্ন যান চলাচলের ব্যবস্থা করা যায়নি।
ইতোমধ্যে ৩০০ ফুট রাস্তাটি তার নামের সার্থকথা হারাতে বসেছে। কুড়িল থেকে বালু নদ পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার অংশে দুই পাশের ৬৫ ফুট রাস্তা কেটে তৈরী করা হচ্ছে খাল। এতে করে ৩০০ ফুটের বদলে রাস্তাটির প্রস্থ দাঁড়াবে ২৩৫ ফুট।
রাজউক সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় প্রায় সাড়ে ১৩ কিলোমিটার খাল, প্রায় সাড়ে ১৩ কিলোমিটার সড়ক, ৩৯ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, চারটি ইউলুপ, খালের ওপর ১৩টি সেতু, চারটি এক্সপ্রেসওয়ে ফুটওভারব্রিজ এবং পাঁচটি স্লইসগেট নির্মাণের কাজ চলছে। এছাড়া একটি পাম্প হাউজ, ১২টি ওয়াটার বাস স্টপ ছাড়াও ৪ দশমিক ৭ কিলোমিটার স্টর্ম স্যুয়ার লাইন নির্মাণ করা হবে। এক্সপ্রেসওয়ের দুপাশে খাল ছাড়াও থাকবে ৬ মিটার সার্ভিস সড়ক। এরপর তিন মিটার প্রশস্ত হাঁটার পথের পর ৩০ মিটার খাল থাকবে। খালের পর আবার দুই মিটার হাঁটার পথ, ছয় মিটার সার্ভিস রোড থাকবে। সবার শেষে থাকবে দেড় মিটার করে হাঁটার পথ। রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, এতে করে পূর্বাচল প্রকল্পের নান্দনিক সৌন্দর্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। তবে প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগেই ৩শ’ ফুট রাস্তা দিয়ে দুরপাল্লা ও ভারী যানবাহন চলাচলে অনেকেই নাখোশ। পূর্বাচল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক উজ্জ্বল মল্লিক বলেন, ৩০০ ফুট রাস্তাটি প্রকল্পের জন্য করা। রাস্তাটি কাঞ্চন ব্রিজ হয়ে মহাসড়কের সাথে যুক্ত হওয়ায় এর ব্যবহার বেড়ে গেছে। এখন আর আমাদের কিছুই করার নেই। এ প্রসঙ্গে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ৩০০ ফুট কেনো, রাস্তাটি এক হাজার ফুট করা হলেও এখানে যানজট হবেই। তিনি বলেন, একটা রাস্তা ফাঁকা পেলে সবাই যানজট এড়াতে সেই রাস্তা ব্যবহার করবে-এটাই স্বাভাবিক। কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল এ বিষয়ে একটা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। আবু নাসের খান বলেন, কোনো বড় শহরে স্যাটেলাইট সিটি দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যায় না। পূর্বাচলের পরিকল্পনাই ‘ভুল ছিল’- উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটার ন্যাচারাল ল্যান্ডস্কেপ (খাল, নদী, উঁচু-নিচু স্থান) ঠিক রেখে আবাসিক পরিকল্পনা করলে ভালো হতো। আবু নাসের বলেন, পূর্বাচলের জন্য রেললাইনের ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল। শুধুমাত্র রাস্তার উপর নির্ভর করে এতো বড় একটা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা যায় না।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় সাড়ে ১৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে কুড়িল থেকে বালু নদ পর্যন্ত প্রায় ৬ কিলোমিটার ৩০০ ফুট প্রশস্ত সড়কের দুই পাশে ১০০ ফুট চওড়া খাল খননের কাজ শুরু হয়েছে গত বছরের ৯ জুলাই থেকে। কাজটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে চলতি বছর আগস্ট মাসে। নান্দনিক এ প্রকল্পের নকশা তৈরি করেছে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল। তাদের নকশা অনুযায়ী, খালের উভয় পাশে ২০ ফুট চওড়া একটি সার্ভিস রোড রয়েছে। এ ছাড়া বাধাহীনভাবে যানবাহন চলাচলের জন্য তিনটি ইউলুপ, উভয় পাশে ১৫টি আর্চ ব্রিজ ও পাঁচটি ফুট ওভারব্রিজের ব্যবস্থা রেখে নকশা করা হয়। কিন্তু পরে এ নকশার কিছুটা পরিবর্তন করা হয়। নতুন নকশায় যুক্ত করা হয় খাল। ইউলুপের পরিবর্তে ব্যয়বহুল আন্ডারপাস করার বিষয়টিও নতুন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
রাজউক সূত্র জানায়, ‘কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের উভয় পাশে ১০০ ফুট চওড়া খাল খনন ও উন্নয়ন’ নামের প্রকল্পটি ২০১৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের সংশোধিত ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পরিবর্তিত নকশায় কুড়িল থেকে বালু নদ পর্যন্ত ৬ কিলোমিটারের মধ্যে আট লেনের এক্সপ্রেসওয়ে হলেও তা বালু নদ থেকে কাঞ্চন পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার দূরত্বে সরু হয়ে ছয় লেনে নেমে আসছে। এ ছাড়া কুড়িল থেকে বালু নদ পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মাত্র তিনটি ড্যাপের রাস্তা সংযুক্ত করা হচ্ছে। নতুন এই পরিকল্পনায় জমি অধিগ্রহণে জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ব্যবহারকারী বেশিরভাগ যানবাহনই এখন ৩০০ ফুট রাস্তা দিয়ে চলাচল করে। এ কারনে এ রাস্তা দিয়ে বাধাহীনভাবে কোনো যানবাহনই চলার উপায় নেই। স্থানীয়রা জানান, সন্ধ্যার পর ৩০০ ফুট রাস্তা থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় প্রবেশের মুখে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। একই সাথে ঢাকার বাইরে থেকে আসা গাড়ীগুলোর ভিড়ে কুড়িল প্রান্তেও যানজটের সৃষ্টি হয়। কখনও কখনও এ যানজট এক ঘণ্টারও বেশি স্থায়ী হয়। স্থানীয়রা জানায়, দুরপাল্লার বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ বিভিন্ন ভারী যানবাহনের ভারে ৩০০ ফুট রাস্তার পরিবেশই বিনষ্ট হয়ে গেছে। তারা বলেন, এভাবে ভারী যানবাহন চলতে থাকলে পূর্বাচল প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগেই পুরো রাস্তা ভেঙ্গে একাকার হয়ে যাবে।
আলাপকালে স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, নতুন পরিকল্পনায় থাকা এক্সপ্রেসওয়ের উভয় পাশের সার্ভিস রোড বাদ দেওয়ার ফলে আরও দুর্ভোগের আশঙ্কা রয়েছে। গোলাম মর্তুজা নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ইতোমধ্যে এ এলাকা ঘিরে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, হাসপাতালসহ অসংখ্য বসতবাড়ি। তাই সার্ভিস রোড এবং ব্রিজ বাদ দেওয়ায় অনেককেই দুর্ভোগ পোহাতে হবে। ###
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন