এক
কুরবানী হলো ইসলামের একটি শি’য়ার বা মহান নিদর্শন। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন: ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানী কর।’ (সূরা আল-কাউসার : ২)
কুরবানী আল্লাহ তা‘আলার একটি বিধান। আদম আ. হতে প্রত্যেক নবীর যুগে কুরবানী করার ব্যবস্থা ছিল। যেহেতু প্রত্যেক নবীর যুগে এর বিধান ছিল সেহেতু এর গুরুত্ব অত্যধিক। যেমন ইরশাদ হয়েছে: আমি প্রত্যেক স¤প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি; তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করে। (সূরা আল-হাজ্জ: ৩৪) ‘আর তুমি তাদের নিকট আদমের দুই পুত্রের সংবাদ যথাযথভাবে বর্ণনা কর, যখন তারা উভয়ে কুরবানী পেশ করল। অতঃপর একজন থেকে গ্রহণ করা হলো আর অপরজনের থেকে গ্রহণ করা হলো না। (সূরা আল-মায়িদাহ:৩৪)
আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বন্ধু ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে বিভিন্ন পরীক্ষায় অবতীর্ণ করেছেন এবং ইবরাহিম আ. সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহিমকে তার রবের কয়েকটি বাণী দিয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর সে তা পূর্ণ করল। তিনি বললেন, আমি তোমাকে নেতা বানাবো’। (সূরা আল-বাকারাহ-১২৪) নিজ পুত্র যবেহ করার মত কঠিন পরীক্ষার সম্মুখিন হয়েছিলেন ইবরাহিম আ.। কুরবানী হযরত ইব্রাহিম আ. এর সুন্নাহ। আজকে আমরা কুরবানী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।
কুরবানীর শরয়ী মর্যাদা: কুরবানী করা ওয়াজিব। হযরত আবু হোরায়রা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম স. এরশাদ করেছেন, সামর্থ থাকা সত্তে¡ও যে কুরবানী করবে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। (মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয় নবী স. মদীনায় দশ বছর অবস্থান করেন। এ সময় তিনি প্রতি বছর কুরবানী করতেন। (তিরমিযী)
কুরবানীর শরয়ী মর্যাদা সম্পর্কে ফকিহগণের মত হচ্ছে ইমাম নখয়ী, ইমাম আবু হানিফা, আবু ইউসুফ প্রমুখ কুরবানী করাকে সাধারণ সামর্থবান মুসলমাদের জন্য ওয়াজিব বলেছেন। কিন্তু ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদের মতে কুরবানী সুন্নাতে মুসলিমিন।
কুরবানীর ফজিলত: কুরবানী একটি ফজিলত পূর্ণ ইবাদত। কুরবানীর ফজিলতের ব্যাপারে কোরআন এবং হাদীসে অনেক বর্ণনা এসেছে। হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ স. এর সাহাবীগন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই কোরবানী কি? রাসুল সাঃ জওয়াবে বললেন, এটা তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহিম আ. এর সুন্নাত (রীতিনীতি)। তাকে আবারও জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এতে আমাদের কি (পূণ্য রয়েছে)? রাসূল স. বললেন, (কুরবানীর জন্তুর) প্রতিটি লোমের পরিবর্তে নেকী রয়েছে। তারা আবারও বললেন, পশমওয়ালা পশুদের জন্য কি হবে? (এদের তো পশম অনেক বেশী)। রাসূল স. বলেছেন, পশমওয়ালা পশুর প্রত্যেক পশমের পরিবর্তেও একটি করে নেকী রয়েছে। (মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ) হজরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, আদম সন্তান (মানুষ) কুরবানীর দিন রক্ত প্রবাহিত করা (কুরবানী করা) অপেক্ষা আল্লাহর নিকটে অধিক প্রিয় কাজ করে না। নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন (কুরবানী দাতার পাল্লায়) কুরবানীর পশু, এর শিং, এর লোম ও এর খুরসহ এসে হাজির হবে এবং কুরবানীর পশুর রক্ত মাটিতে পতিত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তায়ালার নিকট সম্মানিত স্থানে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা কুরবানী করে সন্তুষ্ট চিত্তে থাকো। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
কুরবানী ও জীবনদানের প্রেরণা ও চেতনা সমগ্র জীবনে জাগ্রত রাখার জন্যে রাসূল স. কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কারীমে বলেছেন, বলুন, হে মুহাম্মদ স.! আমার নামাজ আমার কুরবানী আমার জীবন আমার মরণ সবকিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্যে। তা কোন শরীক নেই, আমাকে তারই নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আমিই সর্বপ্রথম অনুগত। (সূরা আল আনআম ঃ ১৬২-১৬৩)
কুরবানীর প্রাণশক্তি হচ্ছে তাকওয়া ও ত্যাগ, যার ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহ প্রেম। যেই কুরবানীতে লৌকিকতা রয়েছে, গোশত খাওয়ার নিয়ত রয়েছে সেই কুরবানী আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেন “আল্লাহর কাছে কুরবানীর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না, পৌঁছে কেবল তোমাদের তাক্বওয়া”। (হজ্জ-৩৭)
যার উপর কুরবানী ওয়াজিব: হযরত আবু হোরায়রা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম স. এরশাদ করেছেনÑ সামর্থ থাকা সত্তে¡ও যে কুরবানী করবে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। (মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজা)
হজ্জ্ব পালনকারীদের জন্য কুরবানী ওয়াজিব।
যার উপর সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব, তার উপর কুরবানীও ওয়াজিব।
মুকীম হতে হবে। অর্থাৎ নিজ বাড়িতে থাকতে হবে, সফরে নয়।
যে ব্যাক্তি নিজ পরিবার পরিজনের বাসস্থান, খাওয়া-পরাসহ সাংসারিক নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাব-পত্র ব্যতিত অতিরিক্ত ঘর, আসবাব পত্র যেমন- বড় বড় ডেগ সমুহ, উন্নতমানের বিছানা, গদি, শামিয়ানা, রেডিও, টেলিভিশন, ভি.সি.ডি, ডিস এন্টিনা ইত্যাদি জরুরী আসবাব পত্রের মধ্যে গণ্য নয়। এজন্য এগুলোর মূল্য যদি নিসাব পরিমান হয় তাহলে তাদের কুরবানী ওয়াজিব হবে।
জমির মূল্য নিসাবের মধ্যে শামিল নয়। কিন্তু তার ফসল যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত থাকে ও তার মূল্য নিসাব পরিমাণ হয় তাহলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। (শামী ৫/১৯৮)
নিসাব পূর্ণ হওয়ার জন্য স্বর্ণ রৌপ্যের নিসাব পৃথক ভাবে হওয়া জরুরী নয় বরং দুটি মিলে অথবা এদের অলংকারাদির ওজন যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের সমান হয় তাহলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। (শামী ৫/১৯৮)
স্ত্রীলোকের নিজস্ব মাল বা গহনাদি যদি নিসাব পরিমাণ থাকে তবে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব। (শামী ৫/১৯৮)
কুরবানী শুধু নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজীব হয়, স্ত্রী ও বড় ছেলে মেয়ের পক্ষ থেকে ওয়াজিব হয় না।
যদি নিসাবের মালিক নিজের নামে কুরবানী না করে অন্যের নামে অর্থাৎ বাবা, মা, ভাই, বোন, দাদা, দাদী, আত্মীয়-স্বজন, পীর, নেতা-নেত্রী ও মৃত ব্যক্তির নামে কুরবানী করে তাহলে জিম্মায় ওয়াজিব বাকি থাকবে। (হিন্দিয়া ৬/১৯৫)
যদি কোন মহিলার উসুলকৃত মোহর নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব। (হিন্দিয়া ৬/১৮৭)
কোন কোন স্থানে মানুষ এক বছর নিজের নামে, এক বছর স্ত্রীর নামে, এক বছর ছেলের নামে অর্থাৎ প্রতি বছর নাম পরিবর্তন করে কুরবানী দেয়, এটা জায়েজ নয়। বরং যার উপর কুরবানী ওয়াজিব হয় শুধু তারই নামে কুরবানী করা ওয়াজিব। নচেৎ কুরবানী আদায় হবে না। তবে সকলের উপর নিসাবের মালিক হলে সকলকেই পৃথক পৃথক কুরবানী করা ওয়াজিব। (হিন্দিয়া ৬/১৯৫)
১০ ই যিলহজ্জ হতে ১২ই যিলহজ্জের সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কোন ব্যক্তি যদি মালেকে নিসাব, অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ মালের অধিকারী হয়, তবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। তবে ঋণী ব্যক্তির উপরে কুরবানী ওয়াজিব নয় কারণ ঋণ পরিশোধ করাই তার কর্তব্য। ঋণী ব্যক্তির কুরবানী করার অর্থ ফরজ নামাজ না পড়ে নফল নামাজ পড়ার জন্য ব্যস্ত হওয়া, যার কোন প্রয়োজন নেই।
একান্নভুক্ত পরিবারে পিতা জীবিত থাকলে শুধু পিতার উপর কুরবানী ওয়াজিব। আর যদি ছেলেরা নিসাব পরিমাণ মালের অধিকারী হয় এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হয় তাহলে তাদের পৃথক ভাবে কুরবানী দিতে হবে। পিতার উপর তাদের কুরবানী ওয়াজিব নহে। (শামী ৫/২০০)
কেহ ১০ ও ১১ তারিখে সফরে ছিল বা গরিব ছিল, ১২ তারিখে সূর্যাস্তের পূর্বে বাড়ী এসেছে বা মালদার হয়েছে বা কোথাও ১৫ দিন থাকার নিয়ত করেছে, এরূপ অবস্থায় তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে।
যে সব পশু কুরবানী করা জায়েয: কুরবানীর জন্য মোটা-তাজা ও সুন্দর পশু অর্থাৎ দেখতে মানানসই হওয়া দরকার। রাসুল স. খুব সুন্দর মোটা তাজা, হৃষ্ট-পুষ্ট পশু দ্বারা কুরবানী করেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন