ইখতিয়ার উদ্দিন সাগর : উত্তর আমেরিকাভিত্তিক ক্রেতাদের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানা পরিদর্শন জোট অ্যালায়েন্সের কাজে অসহযোগিতা ও অনিরাপদ কর্মপরিবেশের (নন কমপ্লায়েন্স) কারণে ৭৭টি তৈরি পোশাক কারখানার সঙ্গে তারা ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। বাংলাদেশে গার্মেন্টস কারখানার সংস্কার কাজ তদারকির লক্ষ্যে তিন বছর আগে কার্যক্রম শুরু করে অ্যালায়েন্স ফর ওয়ার্কার্স সেফটি ইন বাংলাদেশ বা অ্যালায়েন্স। ইতোমধ্যে তাদের অর্ডার সরবরাহ করে এমন প্রায় ৭শ’ কারখানা পরিদর্শন শেষে সংস্কার কাজ তদারক করছে তারা।
অ্যালায়েন্সের চেয়ারম্যান ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কংগ্রেস ওম্যান অ্যালেন টশার এক বিৃতিতে বলেছেন, ক্রেতাদের ব্যবসা বাতিলের অধিকার রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে কঠোর বার্তা দিতে চাই যে, অ্যালায়েন্সের নিরাপত্তা মানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ না হলে আমরা ওই কারখানার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রাখবো না। তিনি বলেন, সংস্কার কাজে ধীরগতি চলছে। এটা হুমকিস্বরূপ।
তবে সংস্কার কার্যক্রমে ধীরগতির কারণ হিসেবে কারখানা মালিকরা অর্থ সংকটকে দায়ী করছেন। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিটি কারখানা সংস্কারে গড়ে ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা করে ব্যয় করতে হচ্ছে। পুঁজির দিক থেকে ছোট ও মাঝারি মানের কারখানা মালিকদের পক্ষে এ অর্থের সংকুলান করা কঠিন। তাদের সহজ অর্থায়নের লক্ষ্যে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা ও আইএফসি (ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন) নামমাত্র সুদে (এক শতাংশেরও কম) অর্থায়নে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এ অর্থায়ন থেকে সুদ নিচ্ছে। অন্যদিকে ঋণদানকারী ব্যাংকের সুদসহ গ্রাহকের কাছে এ অর্থ আসতে প্রায় ১০ শতাংশ হয়ে যাচ্ছে, যা দেশীয় ব্যাংক ঋণের সুদের হারের প্রায় সমান।
অ্যালায়েন্সের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, কারখানা অগ্নি, ভবনের কাঠামো ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার লক্ষ্যে যে সংস্কারের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে তার প্রায় অর্ধেক সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে। অ্যালায়েন্স এ পর্যন্ত ৬৭৭টি কারখানা পুরোপুরি পরিদর্শন কাজ সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে ঝুঁকির বিবেচনায় ৩৬টি কারখানাকে বন্ধের লক্ষ্যে পর্যালোচনা কমিটির কাছে সুপারিশ করেছে। একটি কারখানা স্থানান্থর হয়েছে। ১৩টি কারখানা জোরেশোরে সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাদবাকি ২২টি বন্ধ হয়েছে কিংবা অ্যালায়েন্সের সঙ্গে তাদের কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রম নেই। সব মিলিয়ে ব্র্যান্ডগুলোর এখন পর্যন্ত ৭৭টি কারখানার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তবে অ্যালায়েন্সভুক্ত কারখানাগুলোকে তুলনামূলক নিরাপদ হিসেবেই অভিহিত করা হয়েছে।
এর ফলে জোটের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ২৮টি বিদেশি ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরির ক্রয়াদেশ পাবে না ওই কারখানাগুলো। অন্যদিকে সব ধরনের সংস্কারকাজ শেষ করার স্বীকৃতি পেয়েছে ২৪ পোশাক কারখানা। সংস্কারকাজের অগ্রগতির বিষয়ে অ্যালায়েন্স বলছে, ৩৪ কারখানা শূন্য থেকে ২০ শতাংশ, ১৪৩ কারখানা ২০-৪০ শতাংশ, ২১৯ কারখানা ৪০-৬০ শতাংশ, ১৪৮ কারখানা ৬০-৮০ শতাংশ এবং ৩৬ কারখানা ৮০-১০০ শতাংশ সংস্কারকাজ শেষ করেছে।
গত মঙ্গলবার এনবিআরের প্রাক বাজেট আলোচনায় তৈরী পোষাক শিল্পের সংগঠন বিজিএমইএর বলা হয়েছে, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর থেকে দেশের পোশাক খাত সংকটে পড়েছে। এই সংকট থেকে গার্মেন্টস খাতের এখনো উত্তরণ হয়নি। দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে অ্যাকর্ড এলাইন্স এ পর্য্ন্ত ৩৬ হাজার ৯৬টি ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করেছেন। তাদের সুপারিশ অনুসারে আমাদের কারখানা শেয়ার বিল্ডিং ভিন্ন স্থানে স্থানান্থর, নতুন-পুরাতন বিল্ডিংএ ফায়ার ডোর লাগানোসহ যাবতীয় সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এই জন্য অন্তত দুই থেকে তিন বছরের জন্য করপোরেট কর ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার দাবি জানাচ্ছি।
তবে বাংলাদেশে অ্যালায়েন্সের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ব্যবসায়ের স্বার্থেই সংস্কার কাজে বিনিয়োগ করবেন। নইলে তিনি ব্যবসা হারাবেন। তবে অর্থায়নের বিষয়ে তিনি বলেন, অর্থায়নের সুদের হার কমানোর বিষয়ে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরাও বিভিন্ন সময় সরকারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে বিশেষ অগ্রগতি হয়নি। অন্যদিকে মাত্র চারটি ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়নের বাধ্যবাধকতার বিষয়টি একান্তই যে সংস্থা অর্থায়ন করছে, তাদের পছন্দের বিষয়। এতে অ্যালায়েন্সের কিছু করার নেই।
বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য প্রায় ৮০ ভাগ কারখানার কাজ শেষ হয়েছে। আশা করি এই বছরের মধ্যে বাকি কাজ শেষ হবে। তবে তিনি বিদেশি সংস্থার দেয়া ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে বলেছেন, বিদেশিদের এ ঋণ সহায়তায় সরকার মুনাফা করতে চায়। এ কারণে শূন্য দশমিক শূন্য এক ০.০১ শতাংশ সুদের ঋণ উদ্যোক্তা পর্যায়ে যেতে ১০ শতাংশে গিয়ে ঠেকছে। এ ঋণের সুদের হার ৪ শতাংশে রাখার দাবি আমরা জানিয়েছি। অথচ গত কয়েক মাস ধরে স্থানীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে আরও কম সুদে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের অর্থ দরকার থাকলেও আমরা বিদেশিদের এই ঋণে কাজ করা আর আগ্রহ নেই। এই ঋণ মাত্র দুটি কারখানা নিয়েছে বলেও তিনি জানান। এছাড়া আইএফসি’র অর্থ মাত্র চারটি ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণের বাধ্যবাধকতার সমালোচনা করে তিনি বলেন, যাদের ওই ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন নেই, তাদের অর্থ প্রাপ্তি কঠিন হয়ে গেল। তার ব্যাংক এ জন্য গ্যারান্টি দিলে এ জন্য বাড়তি এক শতাংশ হারে সুদ গুনতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন