স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীর ইসলামপুরের ঝব্বু খানম মসজিদটির এককভাবে নিয়ন্ত্রণ নিতেই খাদেম হাবিবুর রহমানের পরিকল্পনায় মুয়াজ্জিন হাজী বেলাল হোসেনকে হত্যা করা হয়। বেলাল খুনে হাবিবুরের আরো ৪ সহযোগী অংশ নেয়। হত্যার পরিকল্পনা করা হয় দক্ষিণ কেরানিগঞ্জের একটি মসজিদে। এ ঘটনায় বেলালসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল বুধবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (ডিসি, লালবাগ) মো. মফিজউদ্দিন আহমেদ এ দাবি করেন। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, খাদেম হাবিবুর রহমান (২০), সহকারী মুয়াজ্জিন হাফেজ মো. মোশারফ হোসেন (১৯), তাদের সহযোগী তফাজ্জেল হোসেন (২৩) এবং মুয়াজ্জিন বেলালের ব্যবসায়িক অংশীদার সারোয়ার হালিম (৩৮)। এ হত্যাকা-ের সঙ্গে আরও একজন জড়িত রয়েছেন। তবে তিনি পলাতক রয়েছেন।
মফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঝব্বু খানম মসজিদের নিচ তলায় দুটি ফ্লোরে ৩৩টি দোকান থেকে মাসিক ৪২ হাজার টাকাসহ দানবাক্স থেকে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে মসজিদের আয় হতো। কমিটি না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে মসজিদটির দেখাশোনাসহ অর্থের নিয়ন্ত্রণও করতেন মুয়াজ্জিন বেলাল। যিনি দীর্ঘ ২৮ বছরেরও বেশি সময় সুনামের সাথে ওই মসজিদে চাকরি করে আসছিলেন। কিন্তু মসজিদের খাদেম হাবিব ও দ্বিতীয় মুয়াজ্জিন মোশারফ নিহত বেলালের এ একচ্ছত্র আধিপত্য সহ্য করতে পারছিলেন না। তাই তারা মুয়াজ্জিন বেলালকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এর আগেও তারা মুয়াজ্জিন বেলালকে দুইবার হত্যা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
মফিজউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, মুয়াজ্জিন বেলালকে হত্যার দুইদিন আগে খাদেম হাবিব ছুটি নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি নড়াইলে চলে যান। হত্যার উদ্দেশ্যেই হাবিব নড়াইল থেকে সরাসরি কেরাণীগঞ্জ তোফাজ্জলের কাছে যান। ঘটনার সময় গত ৩ এপ্রিল রাত পৌনে ১১টার দিকে বাইরে থেকে ফিরে দোতলায় ওজুর কার্পেট ঠিক করে তৃতীয় তলায় শোয়ার ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন বেলাল। এর আগে দোতলা ও তৃতীয় তলার সিঁড়ির মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান নেন হাবিব। বেলাল কাছাকাছি এলে তার পেট ও শরীরের বিভিন্ন অংশে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করেন হাবিব। মৃত্যু নিশ্চিতের পর হাবিব নিহতের পকেট থেকে নগদ ৬ হাজার টাকা ও মোবাইল নিয়ে যান। সেখান থেকে দুই হাজার টাকা মোশারফকে ভাগ দেন। বেলালকে খুনের পর ব্যবহৃত ছুরিটি বাবু বাজার ব্রিজ সংলগ্ন ড্রেনে ফেলে তারা কেরাণীগঞ্জ চলে যায়। পরদিন সকালে সেখান থেকে আবার নড়াইল চলে যায় হাবিব। গ্রেফতারের পর হাবিবের তথ্যমতে সেখান থেকে ছুরিটি উদ্ধার করা হয়।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুলিশ হাবিবকে নড়াইল জেলার নড়াগাতি থেকে, মোশারফকে নেত্রকোনার দুর্গাপুরের পাইকপাড়া থেকে, তোফাজ্জেলকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আমবাগিচা থেকে এবং সারোয়ার হালিমকে ঢাকার ইসলামপুর থেকে গ্রেফতার করে। হত্যার নেপথ্যের কারণ হিসেবে ডিসি বলেন, সারোয়ারের কাছে প্রায় আট লাখ টাকা জমা রেখেছিলেন বেলাল। বেলালকে হত্যা করা হলে এই টাকা আর ফেরত দিতে হবে না। এ কারনে হাবিব ও তোফাজ্জেলকে ইন্ধন দেন সারোয়ার। বেলাল খুন হলে প্রধান মুয়াজ্জিন হবেন হাবিব। এ ছাড়া মসজিদের আর্থিক বিষয় পরিচালনার দায়িত্বও দেওয়া হবে তাকে। নিজেদের এরকম স্বার্থের কথা চিন্তা করে তারা মুয়াজ্জিন বেলালকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন। পুলিশ জানায়, বেলাল খুনে জড়িত ৫ ঘাতকের মধ্যে পলাতক একজনকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
খাদেমসহ তিনজন রিমান্ডে
পুরান ঢাকার ইসলামপুরে ঝব্বু খানম মসজিদের মুয়াজ্জিন বিল্লাল হোসেন হত্যা মামলায় তিন আসামিকে তিন দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম সাজ্জাদুর রহমান এ আদেশ দেন। এই তিন আসামি হলেনÑমসজিদের জুনিয়র মুয়াজ্জিন মোশারফ হোসেন (২৩), খাদেম মো. হাবিবুর রহমান (২০) ও হাফেজ তোফাজ্জল হোসেন ওরফে তাজিনুল (২৩)। এর আগে আসামিদের ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি চান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক পারভেজ হোসেন।
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, যে চাকু দিয়ে মুয়াজ্জিন বিল্লালকে হত্যা করা হয়েছে, সেটি উদ্ধার করা হয়েছে। হত্যার সঠিক তদন্ত করতে আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি।
রিমান্ড শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতে বলা হয়, ঝব্বু মসজিদের নিচের দুটি ফ্লোরে ৩৩টি দোকান থেকে প্রতিমাসে ৪২ হাজার টাকা ভাড়া আসে। এছাড়া মসজিদের দানবাক্স থেকেও আয় হয়। বিল্লাল বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েও বাড়তি রোজগার করতেন। মসজিদের কর্মীদের বেতন দেওয়ার পর অতিরিক্ত টাকা বিল্লাল নিজের অ্যাকাউন্টে জমা রাখতেন এবং বাইরের লোকের কাছে লাভে খাটাতেন। খাদেম হাবিব ও দ্বিতীয় মুয়াজ্জিন মোশাররফ মসজিদে বিল্লালের এই একক আধিপত্য মেনে নিতে পারছিলেন না। এ কারণেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। তাই আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।
জানা গেছে, আসামি হাবিবুর রহমানের বাড়ি নড়াইলের নড়াগাছিতে, মোশারফ হোসেনের নেত্রকোনার দুর্গাপুর ও তাজিনুলের রংপুরের তারাগঞ্জে। ২৮ বছর ধরে পুরান ঢাকার ইসলামপুরের ওই মসজিদে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন বিল্লাল। গত ৪ এপ্রিল মসজিদের সিঁড়িতে তার রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যায়। মসজিদের নিয়ন্ত্রণ ও টাকার ভাগের লোভে খাদেম হাবিবের প্ররোচনা ও পরিকল্পনায় বিল্লালকে হত্যা করা হয় বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছে পুলিশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন