নোয়াখালী ব্যুরো : নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. এম অহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তদন্ত করবে বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। আগামী শনিবার নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যলয়ে এ সংক্রান্ত তদন্ত অনুষ্ঠিত হবে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রফেসর মো. মমিনুল হক তদন্তের বিষয়টি স্বীকার করলেও কোন বিষয়ে তদন্ত করা হবে সেটা উল্লেখ করেননি।
ভিসি কর্তৃক দুর্নীতি ও অনিয়মসম্বলিত যাবতীয় তথ্যপ্রমাণসহ একটি অভিযোগপত্র শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন বিভাগে প্রেরণ করা হয়। যার প্রেক্ষিতে অভিযোগ তদন্ত করার জন্য বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত টিম গঠন করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন বিভাগে প্রেরিত অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয় যে, গত ১৬/১/২০১৬ ইং স্মারক নং ইউজিসি/পাব-বিশ^/অংশ (২)/২০০৭/২৪১ বাংলাদেশ বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে সকল সরকারী বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাবর অতিরিক্ত পরিচালক ফেরদৌস জামান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয় যে, বাংলাদেশ বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদন ব্যতীত বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কোনো পদেই নিয়োগ প্রদান করা যাবে না। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে উল্লিখিত পদসমূহে নিয়োগ প্রদান করা হলে তার দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট বিশ^বিদ্যালয়কে বহন করতে হবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া যে কোনো পদে নিয়োগ প্রদান করা হলে ভবিষ্যতে ওই সকল পদের অনুমোদন দেয়া যাবে না এবং উক্ত খাতে অর্থ ছাড় করা সম্ভব হবে না। কিন্তু ভিসি ড. অহিদুজ্জামান উক্ত আদেশ উপেক্ষা করে বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ২ জন সহকারী অধ্যাপক, এগ্রিকালচার বিভাগে ২ জন সহযোগী অধ্যাপক ও এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ১জন সহযোগী অধ্যাপক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করেন। নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে আবার অনেকেরই নোবিপ্রবি শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার বর্ণিত যোগ্যতাও ছিল না।
বিশ^বিদ্যালয়ের আইন প্রক্রিয়া না মেনে গত ৩/২/২০১৬ ইং স্বারক নং-নোবিপ্রবি/রেজি/সং-শা/শিনি/২০১৬/২৪৬৪ পত্রে বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (বিজিই) বিভাগে ২ জন সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের শেষ তারিখ ১৮ ফেব্রুয়ারী উল্লেখ করা হলেও রহস্যজনকভাবে তার পূর্বে অর্থাৎ ৯/২/২০১৬ ইং তারিখে উক্ত বিভাগের দুই শিক্ষককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া একই তারিখের বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ বিভাগে বিভিন্ন পদের জন্য যে যোগ্যতা চাওয়া হয় তা বিশ^বিদ্যালয়ের বর্তমান নীতিমালার পরিপন্থী। প্ল্যানিং কমিটি গঠন ও শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশেও অনিয়ম করা হয়। গত ২/২/২০১৬ ইং তারিখে ড. অহিদুজ্জামান বিশ^বিদ্যালয়ের আইন অমান্য করে চারটি বিভাগ (বিজিই, ডিবিএ, কৃষি ও ইএসডিম) স্পেশাল কমিটি গঠন করেন। উক্ত স্পেশাল কমিটির পূর্বে তৈরী হওয়া বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটি যাহা জাতীয় সংসদ কর্তৃক পাস হওয়া বিশ^বিদ্যালয় আইন দ্বারা গঠিত হয়েছিল সেটা বিলুপ্ত না করেই স্পেশাল কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত স্পেশাল প্ল্যানিং কমিটি সম্পূর্ণরূপে অবৈধ বিধায় এর সকল কার্যক্রমই অবৈধ। বিশ^বিদ্যালয়ের ১ম সংবিধি, ধারা ৯(খ) অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটির সুপারিশক্রমে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। যেহেতু নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি বিতর্কিত স্পেশাল প্ল্যানিং কমিটির সুপারিশে হয়েছে, সুতরাং বিজ্ঞপ্তিটি সঙ্গত কারণেই অবৈধ বলে অভিযোগে প্রকাশ।
ভিসি প্রফেসর ড. মো. অহিদুজ্জামান বিগত ২/৬/২০১৫ ইং তারিখ নোবিপ্রবিতে যোগদানের পর থেকে কারণে-অকারণে প্রতি সপ্তাহে ২/৩ বার ঢাকায় যাতায়ত করেন। এজন্য বিশ^বিদ্যালয় ফান্ড থেকে প্রতিবার ২০ হাজার টাকা গ্রহণ করেন। যাহা পূর্ববর্তী উপাচার্যের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫ হাজার টাকা। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার সকল কার্যক্রম সম্পন্ন হবার তিন মাস পর তিনি এখানে যোগদান করে ভর্তি পরীক্ষার পারিতোষিক বাবত ১ লাখ ৫ হাজার টাকা অযৌক্তিকভাবে গ্রহণ করেন। অথচ উক্ত শিক্ষা বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম চলাকালীন সময় উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন উপ-উপাচার্য ড. আবুল হোসেন। এছাড়া ইমপ্রেস মানি বাবদ পূর্বের উপাচার্যের সময় ভিসি অফিসের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫ হাজার টাকা। কিন্তু ড. অহিদুজ্জামান তা বৃদ্ধি করে ১০ হাজার টাকায় উন্নীত করেন এবং পূর্বে উপাচার্যের বাংলোর জন্য কোন বরাদ্দ না থাকলেও তিনি বাংলোর জন্য ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ করান।
ড. মো. আহিদুজ্জামানের যোগদানের দুই মাসের মধ্যে ৬ জন শিক্ষককে অযৌক্তিক কারনে কারন দর্শাও নোটিশ প্রদান করা হয়। পরে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রবল প্রতিবাদের মুখে শেষতক তিনি কারন দর্শানো নোটিশ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। ২১তম রিজেন্ট বোর্ডে অনুমোদনকৃত শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নয়ন ও পদোন্নতি নীতিমালা অনুযায়ী ৩ শিক্ষকের সহকারী অধ্যাপক হতে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সকল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্য থেকে শুধুমাত্র ভিসির পছন্দনীয় এক জনকে পদোন্নতি দিয়ে বাকীদের বঞ্চিত করা হয়। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে ভিসি’র পছন্দনীয় প্যানেলকে সমর্থন না করায় নির্বাচন পরবর্তী দুই কার্য দিবসের মধ্যেই ৮ জন শিক্ষককে এব পরবর্তীতে আরো ৭ জনকে বিনা কারনে প্রশাসনিক পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা করেন। বিশ^বিদ্যালয় আইনে একাডেমিক কাউন্সিল কর্তৃক বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য হতে নির্বাচনের মাধ্যমে রিজেন্ট বোর্ডের ২ জন সদস্য নির্বাচিত হবার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ভিসি একাডেমিক কাউন্সিলে বিনা নির্বাচনে ২ জন শিক্ষকের নাম প্রস্তাব করেন। যার প্রেক্ষিতে চলমান ১৪টি বিভাগের মধ্যে ৯টি বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপকগনের একমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ মোট ১০ জন সদস্য ”নোট অব ডিসেন্ট” প্রদান করেন। তা সত্বেও তিনি স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে তার প্রস্তাবিত ২জন শিক্ষককে রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য মনোনয়ন করেন।
অভিযোগে প্রকাশ, কৃষি বিভাগে আইন বহির্ভূত প্ল্যানিং কমিটি গঠন ও অন্যায়ভাবে নিয়োগ বিষয়ে প্রতিবাদ করায় উক্ত বিভাগের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান রুবলকে কোন কারন না দেখিয়ে চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যহতি প্রদান এবং অবৈধভাবে নিয়োগকৃত চুক্তিভিত্তিক শিক্ষককে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। ভিসি ড. অহিদুজ্জামান নেবিপ্রবি বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ, বর্তমান শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত সাধারন সম্পাদক এবং সহকারী অধ্যাপক মো. রুহুল আমিনকেও রেহাই দেননি। তার বিরুদ্বে কতিপয় অভিযোগ এনে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সূযোগ না দিয়ে তাকে বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে অব্যহতি দেয়া হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে ২০১২ সালে শহীদ স্বরনিকা প্রকাশের জন্য ড. অহিদুজ্জামান বিশ^বিদ্যালয় ফান্ড থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা গ্রহন করেন। কিন্তু তিন বছর অতিবাহিত হবার পরও শহীদ স্বরনিকা প্রকাশিত না হওয়ায় গত ২১/১২/২০১৫ ইং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কার্যকরী পরিষদের সভার সিদ্ধান্তক্রমে চিঠি প্রাপ্তির ১৫ দিনের মধ্যে সমুদয় টাকা ফেরত প্রদানের জন্য ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. এস এম মাকসুদ কামাল স্বাক্ষরিত একটি চিঠি গত ২৯/১২/২০১৫ ইং তারিখে এবং এর আগে আরো দুইবার ড. অহিদুজ্জামান বরাবরে চিঠি প্রেরণ করা হয়। কিন্তু তিনি ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা এখনো পরিশোধ করেননি বলে জানা গেছে।
ভিসি ড. মো. অহিদুজ্জামান কর্তৃক অনিয়মের প্রতিবাদ করলে তাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা নিত্যকার বিষয়। তাই এখন কেউ আর প্রতিবাদ করাতে সাহস পাচ্ছে না। ইউজিসি থেকে প্রেরিত চিঠিতে বলা হয়েছে যে, অত্র বিশ^বিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী যদি অভিযোগ তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দিতে চান তাহলে উল্লেখিত তারিখে তাদেরকে ক্যাম্পাসে হাজির থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় ইতিমধ্যে অনেককে অন্যায়ভাবে বদলী ও হয়রানি করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হলে পরবর্তীতে তারা আবারও ভিসি’র রোসানলে পড়তে হবে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কয়েকজন শিক্ষক ইনকিলাবকে জানায়, ইউজিসি প্রেরিত তদন্ত কমিটি যদি অভিযোগকারীদের থেকে লিখিতভাবে বক্তব্য গ্রহণ করে তা হলে আরো অনেক রহস্য উন্মোচিত হবে। কারন নোবিপ্রবি’তে ভিসি অনেক ক্ষমতাধর। তাই ভয়ে কেউ তদন্ত কমিটির সম্মুখে হাজির হবে না। এদিকে ভিসি গতকাল (বুধবার) তড়িঘড়ি করে তার বাসভবন কার্যালয়ে সাংবদিকদের সাথে এক মতবিনিময় সভা ও প্রীতি সম্মেলনের আয়োজন করে সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন। এসময় কয়েকজন সাংবাদিক ভিসিকে প্রশ্ন করেন যে, ভিসি’র জন্য নির্মিত বাসভবনে অবস্থান করেও আপনি সরকারী কোষাগারে হাউজ রেন্ট প্রদান না করে গেষ্ট হাউসে অবস্থানের কথা বলে প্রতিদিন মাত্র ১শত টাকা করে কেন প্রদান করছেন। তখন ভিসি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আগের ভিসি’রা এটা করে গেছে। আমি এটাকে পরিবর্তন করব। পরে প্রত্যেকের হাতে একটি করে হলুদ খাম ধরিয়ে দেয়া হয়। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিক পরে এ বিষয়টি নিয়ে রসগল্প করেন। তড়িখড়ি করে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় অনুষ্ঠান সম্পর্কে নোবিপ্রবি’র কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানান, শনিবার তদন্ত কমিটি আসার পূর্বে সাংবাদিকদের সাথে ভিসি’র মতবিনিময় সভা মূলত প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেয়া এবং তিনি নিজে সাদা মনের মানুষ হবার চেষ্টা করছেন। টেলিভিশনের বিভিন্ন টক শো’তে ভিসি অহিদুজ্জামান সুন্দর সুন্দর কথা বললেও বাস্তবে এখনে তিনি কি কি করছেন তার সকল অভিযোগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। তারা আরো বলেন, সরকার অত্র বিশ^বিদ্যালয়ে আধুনিক শিক্ষা প্রসার ও উন্নয়নে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করছে। কিন্তু একজন অহিদুজ্জামানের কারনে সরকারের সফলতা ভেস্তে যাবার উপক্রম হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন