শেষ
কুরবানীর অংশীদার নেওয়ার ক্ষেত্রে শরয়ী হুকুম হলো উট, গরু, মহিষ- এর থেকে সাতজন লোক কুরবানী করতে পারবে। আবার উট, গরু, মহিষের মধ্যে প্রত্যেকটিতে সাতভাগ দিতে হবে এমন কোন শর্ত নেই। বরং কুরবানী দাতা একাই একটি বা একাধিক গরু, উট, মহিষ নিজের ও তার পরিবারের সবার পক্ষ থেকে কুরবানী করতে পারবে।
দুম্বা, ছাগল ও ভেড়া একজনের পক্ষ থেকে একটাই কুরবানী করতে হবে। এসব পশুতে অন্য কোন পৃথক ওয়াজিব কুরবানী দাতা কুরবানীর অংশীদার হতে পারবে না।
যদি গরু খরিদ করার পূর্বেই সাত জনে ভাগ হয়ে সকলে মিলে খরিদ করে, তবে তা অতি উত্তম, আর যদি কেহ একা একটি গরু কুরবানীর জন্য খরিদ করে এবং মনে মনে এই ইচ্ছা করে যে, পরে আরও লোক শরীক করব এবং তাদের সঙ্গে মিলে একত্রিত হয়ে কুরবানী করব, তবে তাহা দুরুস্থ আছে। কিন্তু যদি গরু ক্রয়ের সময় অন্যকে শরীক করার এরাদা না করে, একা একাই কুরবানী করার নিয়ত করে, এবং পরে অন্যকে শরীক করতে চায়, (কিন্তু ইহা ভাল নয়) এমতাবস্থায় যদি ঐ ক্রেতা গরীব হয় এবং তার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়, তবে পরে সে অন্য কাউকে শরীক করতে পারবে না, একা একাই গরুটি কুরবানী করতে হবে। আর যদি ঐ ক্রেতা মালদার হয় এবং তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হয়, তবে ইচ্ছা করলে পরে অন্য কেও শরীক করতে পারবে। (কিন্তু নেক কাজের নিয়ত বদলানো ভাল নয়)
শরীকদার কুরবানীর মধ্যে যদি কাহারও শুধু গোস্ত খাওয়ার নিয়ত থাকে তাহলে সকলের কুরবানী নষ্ট হয়ে যাবে। (শামী ৫/২০১)
সুদখোরের সহিত কখনো কুরবানীতে অংশীদার হওয়া ঠিক নহে।
কুরবানীর শরীকদারের জন্য দু’টি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
১. সকলের নিয়ত এক হওয়া
২. ভাগের প্রতিটি অংশ সমান হওয়া।
কুরবানীর পশুর গোশত বণ্টনের পদ্ধতি: কুরবানীর গোশত নিজে খাবে, নিজের পরিবারবর্গকে খাওয়াবে, আত্মীয়-স্বজনকে হাদিয়া তোহফা দিবে এবং গরীব মিসকীনকে দান করবে। মুস্তাহাব তরীকা হলো কুরবানীর গোশত তিন ভাগে ভাগ করা। ১. নিজ পরিবার পরিজনের জন্য এক ভাগ। ২. আত্মীয় স্বজনের জন্য এক ভাগ। ৩. ফকীর মিসকীনদের জন্য একভাগ। আর যদি পরিবারের লোক সংখ্যা বেশী হয় তবে কুরবানীর সমস্ত গোশত খেলেও অসুবিধা নেই। তবে কেহ যদি ফকীর মিসকীনকে সামান্যও দান করে তাতেও গুনাহ হবে না। (শামী ৫/২০৮)
কোরবানীর গোশত কাফেরদেরকেও দান করা জায়েয আছে। কিন্তু মজুরি স্বরূপ দেওয়া জায়েয নেই।
মান্নতের কুরবানীর গোশত গরীব মিসকীনদের হক। নিজে খেতে পারবে না। যদি নিজে খায় অথবা কোন মালদারকে দেয়, তবে যে পরিমাণ খেয়েছে অথবা মালদারকে যে পরিমাণ দিয়েছে সে পরিমাণ পুনরায় গরীব মিসকীনকে দান করতে হবে।
কুরবানীর জীব জবেহকারী ও গোশত প্রস্তুতকারীর পারিশ্রমিক পৃথকভাবে দিতে হবে। কুরবানীর গোশত, কল্লা বা পা দ্বারা দেয়া যাবে না।
কুরবানীর গোশত শুকিয়ে বা ফ্রিজে জমা করে রাখা জায়েয। (শামী ৫/২০৮)
কুরবানীর যত অংশীদার ততভাগ করতে হবে। যেমন সাত শরীকের কুরবানীর ৮ ভাগ করার প্রচলন সমাজে রয়েছে তা শরীয়ত সম্মত নয়।
সাতজনে শরীক হয়ে যদি একটি গরু কুরবানী করে, তবে গোশত আন্দাজে ভাগ করলে হবে না। পাল্লা দ্বারা মেপে সমান সমান ভাগ করতে হবে, অন্যথায় যদি ভাগের মধ্যে কিছু কমবেশী হয় তবে সুদ হবে এবং গোনাহগার হতে হবে। (শামী ৫/২০২)
কুরবানীর পশুর চামড়ার বিধান: কুরবানীর পশুর চামড়া নিজে ব্যবহার করতে পারবে। যদি কেহ কুরবানীর পশুর চামড়া দিয়ে চালুন, মশক, ডোল বা জায়নামায তৈরী করে ব্যবহার করে তাহলে কোন সমস্যা নেই। তবে চামড়া বিক্রি করলে ঐ টাকা নিজে, পরিবার পরিজন ও মালদার ব্যক্তিও ব্যবহার করতে পারবে না। সব টাকাই ফকীর মিসকিনদের (যারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য) মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে। আবার কুরবানীর চামড়া পুরোটাই দান করাও যাবে। তবে কুরবানীর পশুর চামড়ার টাকা মসজিদ মেরামত বা নির্মাণের কাজে ব্যয় করা যাবে না। কিন্তু যে সব মাদরাসায় লিল্লাহ বোডিং বা এতিমখানা আছে সেখানে দান করা যাবে।
জানীন বিষয়ক মাসয়ালা: জানীন এর মাসয়ালা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জবাইকৃত প্রাণীর পেটে যে বাচ্চা পাওয়া যায় তাকে জানীন বলা হয়। হালাল প্রাণী জবাই করার পর তার গর্ভে যদি কোনো বাচ্চা পাওয়া যায় তাহলে তা কিভাবে ভক্ষণ করা যাবে এ বিষয়ে ইসলামী আইনশাস্ত্রবিদগণ যুক্তিপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। ফিকাহশাস্ত্রবিদগণ জানীন তথা গর্ভস্থ বাচ্চার দুটি অবস্থা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
১. গর্ভস্থ বাচ্চা জীবিত অবস্থায় পাওয়া যেতে পারে।
২. গর্ভস্থ বাচ্চা মৃত অবস্থায় পাওয়া যেতে পারে।
গর্ভস্থ বাচ্চার মাকে জবাই করার পর গর্ভস্থ বাচ্চাকে যদি জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায় তাহলে সকল আলেম ফকীহগণের ঐক্যমতে গর্ভস্থ বাচ্চাকে আলাদা ভাবে জবাই করে ভক্ষণ করা বৈধ। তবে গর্ভস্থ বাচ্চার মাকে জবাই করার পর যদি জানীন তথা গর্ভস্থ বাচ্চাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তাহলে তার হুকুম কী হবে, এ নিয়ে ইমামদের মাঝে মতভেদ রয়েছে।
ইমাম শাফেয়ী রহ. এর মতে গর্ভস্থ বাচ্চাকে যদি পরিপূর্ণ গঠন ও ত্রæটিমুক্ত অঙ্গপ্রতঙ্গসহ মৃতাবস্থায় পাওয়া যায় তাহলে তা ভক্ষণ করা হালাল। কারণ হাদীসে এসেছে- “যাকাতুল জানীন যাকাতু উম্মিহী”
ইমাম আবু হানিফা রহ. ও সাহেবাইনদের মতে গর্ভস্থ বাচ্চার শারীরিক গঠন পূর্ণ হোক বা না হোক তাকে তার জবাইকৃত মায়ের গর্ভে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেলে তার গোশত ভক্ষণ করা হারাম। তিনি দলীল হিসাবে নি¤েœাক্ত আয়াত পেশ করেন- “তোমাদের জন্য মৃত জীব, রক্ত, শুকর-মাংস, আল্লাহ ছাড়া অপরের নামে উৎসর্গীকৃত পশু, কন্ঠরোধে মারা পশু, আঘাত লেগে মরে যাওয়া পশু, পতনের ফলে মৃত পশু শৃংগাঘাতে মৃত পশু এবং হিং¯্র জন্তুতে খাওয়া পশু হারাম করা হয়েছে; তবে যা তোমরা যবেহ দ্বারা পবিত্র করেছ তা হালাল। ( সূরা মায়িদাহ:৩) তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, জবাইয়ের অন্যতম শর্ত হলো রক্ত প্রবাহিত করা। এক্ষেত্রে গর্ভস্থ বাচ্চার রক্ত প্রবাহিত হয় না। সূতরাং গর্ভস্থ বাচ্চা হারাম। তিনি ২য় যুক্তি দিয়েছেন গর্ভস্থ বাচ্চা তার মায়ের জবাইয়ের কারণে মরেছে, নাকি অন্য কোনো কারণে মরেছে তা অজানা। সূতরাং সতর্কতামুলক ভাবে তা ভক্ষণ করা হারাম। (শামী ৫/২০৭)
আমাদের গ্রামে গঞ্জে একটি কুসংস্কার রয়েছে যে, গর্ভস্থ বাচ্চা থেকে এক টুকরো গোশত নিয়ে গাভীর গোশতের সাথে মিশাতে হবে। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কারণ, গর্ভস্থ বাচ্চার এক টুকরো খাওয়া যদি জায়েয হয় তাহলে তা পুরোটাই জায়েয হওয়ার কথা। গর্ভস্থ বাচ্চা থেকে এক টুকরো গোশতো নিয়ে গাভীর গোশতের সাথে মিশালে গাভীর গোশতো হালাল হওয়া সত্বেও তা হারাম হয়ে যাবে। যেমন একমণ দুধের সাথে এক ফোটা নাপাকি লাগলে পুরো দুধই হারাম হয়ে যায়।
উপসংহার: কুরবানী আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে এক বিশেষ অনুগ্রহ। কেননা বান্দাহ কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারে। কুরবান শব্দটি কুরবুন শব্দ থেকে উৎকলিত। অর্থাৎ নিকটবর্তী হওয়া, সান্নিধ্য লাভ করা। আল্লাহ যেন আমাদেরকে এই কুরবানীর মত বিশেষ ইবাদতের মাধ্যমে তার নৈকট্য প্রাপ্ত বান্ধাদের মধ্যে অন্তর্ভক্ত তরে নেন। আমীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন