শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

কম টাকায় দেদারসে চলছে হজযাত্রী সংগ্রহ

১৪ ফেব্রুয়ারি দ্বি-পাক্ষিক হজ চুক্তি : ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রাক-নিবন্ধন শুরু

প্রকাশের সময় : ২৬ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শামসুল ইসলাম : সরকার ঘোষিত হজ প্যাকেজের চেয়ে কমমূল্যে হজযাত্রী সংগ্রহ চলছে দেদারছে। এক শ্রেণী’র অবৈধ গ্রুপ লিডার গ্রাম-বাংলার আনাচে-কানাচে ২ লাখ ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকায় হজযাত্রী সংগ্রহ শুরু করছে। অবৈধ গ্রুপ লিডারদের কাছে বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলো জিম্মি হয়ে পড়েছে। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি জেদ্দায় সউদী-বাংলাদেশ দ্বি-পাক্ষিক হজ চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
বাংলাদেশের পক্ষে হজ চুক্তিতে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এবং সউদী হজ মন্ত্রী ড. বন্দর বিন মোহাম্মদ হাজ্জার সউদী পক্ষে স্বাক্ষর করবেন বলে জানা গেছে। আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে হজযাত্রীদের প্রাক-নিবন্ধন কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ১০ সেপ্টেম্বর পবিত্র হজ (১৪৩৭ হিজরি) অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে। সউদী-বাংলাদেশ দ্বি-পাক্ষিক হজ চুক্তি সাপেক্ষে চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার হজযাত্রী হজব্রত পালন করতে সউদী আরবে যেতে পারবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৫ হাজার (কমবেশি) এবং বাকি সব বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যাবেন। চলতি বছর হজ প্যাকেজে এ-ক্যাটাগরি প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার ২৮ টাকা এবং বি-ক্যাটাগরি প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৪ হাজার ৯শ’ ৩ টাকা।
গত বছরের তুলনায় চলতি বছর হজ প্যাকেজের মূল্য বেড়েছে প্রায় ৮ হাজার ৩শ’ টাকা। তার পরেও অবৈধ গ্রুপ লিডাররা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে গ্রাম-গঞ্জে কম টাকায় পবিত্র ক্বাবা শরীফের কাছে আবাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে হজযাত্রী সংগ্রহ করছে নির্বিঘেœ। হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫শ’ মার্কিন ডলার (সিটি চেকিংসহ)। আগামী ৩০ মে-এর মধ্যে নির্ধারিত হজ প্যাকেজের পুরো টাকা পরিশোধ করে হজযাত্রীগণ পিলগ্রিম আইডি নিয়ে হজে যাওয়ার সুযোগ পাবেন।
কম টাকায় হজযাত্রী সংগ্রহের প্রতিযোগিতা প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলে সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম চরমভাবে বিঘিœত হবার আশংকা রয়েছে। অভিজ্ঞ মহল এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সম্প্রতি হাবের ৪র্থ নির্বাহী কমিটির সভায় অবৈধ গ্রুপ লিডারদের কম টাকায় হজযাত্রী সংগ্রহের অপতৎপরতা নির্মূল এবং হাজীদের খেদমত নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে সেন্ট্রাল প্যাকেজের অনুসরণে হাবের একটি বিশেষ একাউন্টে সকল হজ এজেন্সির হজযাত্রীদের সরকার ঘোষিত হজ প্যাকেজের পুরো টাকা জমা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। হাব কর্তৃপক্ষ গতকাল এক সার্কুলারে সকল হজ এজেন্সিগুলোর কাছে হজযাত্রীদের পুরো টাকা হাবের একাউন্টে জমা দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। হাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হেলাল গতকাল এতথ্য জানিয়েছেন। হাব নেতা মোহাম্মদ হেলাল বলেন, মধ্যসত্বভোগি অবৈধ গ্রুপ লিডাররা সরকার ঘোষিত হজ প্যাকেজের প্রতি তোয়াক্কা না করে গ্রাম-গঞ্জের সরলমনা হজযাত্রীদের জনপ্রতি ২ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকায় হজযাত্রী সংগ্রহ করছে। এদের কারণেই প্রতি বছর সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এতে কম টাকার প্রলোভনে পড়ে হাজীগণ প্রতারণার শিকার হন। হাজীদের খেদমত নিশ্চিতকরণ এবং বেআইনীভাবে কম টাকায় হজযাত্রী সংগ্রহের অপচেষ্টা বন্ধের জন্য হাব কর্তৃপক্ষ হাবের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিয়ে সকল হজযাত্রীদের ঘোষিত হজ প্যাকেজের পুরো টাকা হাবের একাউন্টে জমা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে আইনগত কোনো বাধা নেই বলেও হাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হেলাল উল্লেখ করেন। হাব নেতা আরো বলেন, কম টাকায় হজে গেলে হজযাত্রীগণ প্রতারণার শিকার হবেন। এর পরেও কেউ কম টাকায় হজে যাওয়ার জন্য মধ্যসত্বভোগি গ্রুপ লিডারের কাছে হজের টাকা জমা দিয়ে প্রতারিত হলে তার দায় দায়িত্ব সরকার ও হাব বহন করবে না।
বাংলাদেশ হজযাত্রী ও হাজী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি আলহাজ এডভোকেট আব্দুল্লাহ আল নাসের এক বিবৃতিতে সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনার স্বার্থে এবং হাজীদের প্রতারণার কবল থেকে রক্ষার জন্য অবৈধ গ্রুপ লিডারদের অবিলম্বে গ্রেফতারপূর্বক শাস্তির জোর দাবী জানিয়ে বলেন, হজ ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য দেশের সকল অবৈধ হজ কাফেল ও মধ্যসত্তভোগীদের বিরুদ্ধে সরকারকে জরুরী ভিত্তিতে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এডভোকেট আব্দুল্লাহ আল নাসের বলেন, অবৈধ গ্রুফ লিডাররা হাজীদের সাথে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে কম টাকায় হজে নেয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনপ্রতি ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকায় হজযাত্রী সংগ্রহ করছে। যাহা জাতীয় হজ ও ওমরাহ নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী ও বেআইনী।
এদিকে, গত বছর কম টাকায় হাজী সংগ্রহ করায় অনেক হজ এজেন্সিকে মক্কা-মদিনায় হাজীদের সেবা দিতে হিমসিম খেতে হয়েছে। গত হজে নানা অনিয়মের অভিযোগে ইতিমধ্যে আরও ২০ হজ এজেন্সিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে সউদী সরকার। অভিযোগ খন্ডনে কোনো প্রমাণ বা মতামত থাকলে তা গত ২০ জানুয়ারির মধ্যে জানাতে বলেছে সউদী কর্তৃপক্ষ। নির্ধারিত সময়ের পর সউদী হজ মন্ত্রণালয় কোনো হজ এজেন্সির প্রমাণাদি গ্রহণ করবে না বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। হজ এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে চুক্তির বাইরে অন্য বাড়িতে রাখা, একই স্থানে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত হজযাত্রীদের আবাসনের ব্যবস্থা করা, নির্দিষ্ট সময়ের বেশি হোটেলে রেখে অর্থ পরিশোধ না করা, নিয়ম ভেঙে রান্নার ব্যবস্থা করা, আবর্জনা জমা করে রাখাসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনেছে সউদী হজ মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ কমিটি। ধর্ম মন্ত্রণালয় অভিযুক্ত হজ এজেন্সিগুলোকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছে। এর আগে গত ৮ নভেম্বর একই ভাবে ১৬টি এজেন্সিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল সউদী কর্তৃপক্ষ। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, গত বছরের হজ মৌসুমে সউদী হজ মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ কমিটি এজেন্সিগুলোর ত্রুটি মক্কার মোয়াচ্ছাসার প্রধান ড. রাফাত ইসমাঈল বদর গত ১৫ ডিসেম্বর চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশের হজ মিশনকে জানিয়েছেন। মক্কাস্থ হজ মিশন ১৭ ডিসেম্বর চিঠিটি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠিয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ প্রশাসনিক দলের পর্যবেক্ষণ ও হজযাত্রীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। ৭৮৩টি হজ এজেন্সি’র মাধ্যমে এবার বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৬শ’ ২৮ জন হজযাত্রী হজব্রত পালন করেছেন।
সরকার ও হাব ঘোষিত হজ প্যাকেজের অনেক কম টাকায় হজে নেয়ার জন্য গ্রামাঞ্চলের সহজ সরল হজযাত্রীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে অবৈধ গ্রুপ লিডাররা। মধ্যস্বত্ব্যভোগি গ্রুপ লিডাররা কম টাকায় কিভাবে হজে নিবে তার কোনো বিবরণ হজযাত্রীদের কাছে তুলে ধরছে না। শতাব্দী এভিয়েশনের (৫৩২) মালিক রফিকুল আলম গাজীপুরী মনোহরদী চন্দনবাড়ীর হজযাত্রী মনিরুল হক আকন, রতন মিয়া, শফিকুল ইসলাম তালুকদার ও ছলিম উদ্দিন আকনকে চলতি বছর ২ লাখ ৪০ হাজার টাকায় হজে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে এলাকার একজন হজযাত্রী জানিয়েছেন। একই থানার চরমান্দালিয়ার গ্রামের গ্রুপ লিডার আব্দুল মান্নান চড়চাপা, নয়ানগর, চালাকচর, সাগরদী গ্রামের প্রায় ৩০ জন হজযাত্রীকে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকায় হজের নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাসপোর্ট সংগ্রহ করছে। বাব-ই-মদিনার ট্রাভেলসের সুলতান মাহমুদ নওগা জেলার মহাদেবপুর হাসানপুর গ্রামে ২ লাখ ২০/২৫ হাজার টাকায় হজযাত্রী সংগ্রহ করছে। আকবর গ্রুপের বগুরা কাহালু থানার গ্রুপ লিডার রাজু মিয়া ও আদমদিঘি থানার গ্রুপ লিডার মতিউর রহমান ২ লাখ ৩০ হাজার টাকায় হজযাত্রী সংগ্রহ করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। লাইম স্টোন রির্সোট এন্ড টুরিজম (৯০৭) জাহাঙ্গীর নওগা জেলায় ২ লাখ ২০ হাজার টাকায় হজযাত্রী সংগ্রহ করছে। নওগা মহাদেবপুর সদরে মেহেদী এয়ার ট্রাভেলস ট্রেড -এর লোকজন এবং নওগার শাপাহার থানা এলাকায় গ্রুপ লিডার মজিবুর রহমান ২ লাখ ১৫ হাজার টাকায় হজযাত্রী সংগ্রহ করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। শেরপুরের নালিতাবাড়ী নিচিন্তপুরের হজযাত্রী প্রফেসর ইলিয়াস ও তার স্ত্রী, হজযাত্রী হামিদুলকে কম টাকায় হজে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে নিবির ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি’র লোকজন। নালিতাবাড়ী বাস স্ট্যান্ড এর গ্রুপ লিডার মুরাদ, নকলা থানার গ্রুপ লিডার শামীম, আমিনুল মোবাল্লিক ট্রাভেলসের মাধ্যমে হজযাত্রী তাফাজ্জলকে কম টাকায় হজে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে জানা গেছে।
হাবের মহাসচিব শেখ আব্দুল্লাহ গতকাল রাতে ইনকিলাবের সাথে আলাপকালে বলেন, হাবের সর্বনি¤œ হজ প্যাকেজ ২ লাখ ৫ হাজার টাকা। এক শ্রেণীর দালাল ও কিছু হজ এজেন্সি সরকার ও হাবের প্যাকেজ-এর প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদশন করে ২ লাখ ২০ হাজার টাকায় হজযাত্রী সংগ্রহ করছে। এরা প্রতি বছর কম টাকায় হাজী সংগ্রহ করে মক্কা-মদিনায় নিয়ে ঠিকমতো খাবার সরবরাহ করে না, আবাসনের ব্যবস্থা না করে হাজীদের রাস্তায় ছেড়ে দেয়। এসব প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হাব কর্তৃপক্ষ সেন্ট্রালভাবে হাবের একাউন্টে সকল হজযাত্রীর নির্ধারিত প্যাকেজের ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা জমা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যারা সর্বনি¤œ হজ প্যাকেজের ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা হাবের একাউন্টে জমা দিতে ব্যর্থ হবে তারা হজে যাওয়ার নিশ্চয়তা পাবে না। তারা পিলগ্রিম আইডিও পাবেন না। হাব মহাসচিব বলেন, আকবর হজ গ্রুপর ও সুবর্নলতা ট্রাভেল এন্ড ট্যুরস প্রতি বছর কম টাকায় হজযাত্রী সংগ্রহ করে সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। এরা প্রতি বছর হাজীদের কম টাকায় হজে নিয়ে কষ্ট দিচ্ছে। তিনি বলেন, মধ্যস্বত্ব্যভোগি গ্রুপ লিডারদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্ব নি¤œ হজ প্যাকেজের কমে কেউ লেনদেন করে হজে যেতে না পারলে তার দায় দায়িত্ব সরকার ও হাব নিবে না। হাব মহাসচিব সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনার স্বার্থে কোনো অবৈধ গ্রুপ লিডারের কাছে হজে টাকা জমা না দিয়ে সরাসরি হজ এজেন্সির কাছে ঘোষিত প্যাকেজের টাকা জমা দেয়ার অনুরোধ জানান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন