মনির হোসেন হেলালী
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানব জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল সমস্যার সমাধান ও প্রয়োজন পূরণে ইসলাম এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ইসলামকে বলা হয় সাম্যের ধর্ম। ধন, বংশ ও ভৌগোলিক পরিচয়ের কারণে এখানে কারো মর্যাদা নির্ণীত হয় না। তাকওয়া বা খোদাভীতি হচ্ছে ইসলামের দৃষ্টিতে সম্মান ও মর্যাদার একমাত্র মানদ-। আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে ‘নিশ্চয় তোমাদের মাঝে তাকওয়ার দিক থেকে যে এগিয়ে রয়েছে আল্লাহর নিকট সে-ই সবচেয়ে সম্মানীত। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং সব বিষয়ে অবহিত’- সূরা : হুজরাত-১৩।
এখানে কেউ কারো প্রভু নয়, ভৃত্যও নয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব সময় গরিবদের সঙ্গে থাকতেই পছন্দ করতেন। সাহাবায়ে কিরামও দরিদ্র পরিবেশ নিয়েই থাকতেন। কেউ ধন বা ক্ষমতার বিন্দুমাত্র অহংকার প্রকাশ করুক, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা সহ্য করতেন না। তিনি প্রভু-ভৃত্য বা মনিব-গোলামের প্রথাকে ঘৃণা করতেন। সাহাবি আনাস রাদি আল্লাহু একটানা দশ বছর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমত করেছেন। তিনি বলেছেন, এই দীর্ঘ সময়ে আমি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যত না খেদমত করেছি, তিনি আমার খেদমত করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। তিনি আমাকে মনিবসুলভ ধমক দেয়া তো দূরের কথা, কোন দিন এমন কথাও বলেননি যে, এ কাজ হলো না কেন? মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রভুতন্ত্রের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘তোমরা আমাকে মুকুট পূজারীর মত সম্মান দেখাবে না, ইসলামের তাওহীদ এ থেকে পুরোপুরি পবিত্র।’ সাহাবায়ে কিরামও সমঅধিকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আমিরুল মু’মিনিন ওমার ফারুক রাদি আল্লাহু স্বীয় কর্মচারীকে উটের ওপর সওয়ার করে নিজে হেঁটেছেন উটের লাগাম ধরে। মানব হিসেবে ওমার আর চাকরের মাঝে ছিল না কোন তফাত। বরং দুজনই ভোগ করেছেন সমঅধিকার। এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে ইসলামে।
আল্লাহ তা‘আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘বলুন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মত একজন মানুষই।’ (সূরা কাহাফ : ১১০)।
পক্ষান্তরে ফরাসী বিপ্লব থেকে মানুষের সমঅধিকারের কথা ঘোষণা করা হলেও আধুনিককালের সেরা সুসভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও প্রকৃত সাম্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। শাসক শ্রেণি ও জনসাধারণের মর্যাদা ও অধিকারে আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে রয়েছে আকাশ-পাতাল বৈষম্য। রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানকে সাধারণ আইনের বাইরে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেয়া থাকবে, সাধারণ কর্মচারী ও রাষ্ট্র প্রধানের সুযোগ-সুবিধার মধ্যে বিস্তর তফাত, পদস্থ কর্মকর্তা আর একান্ত দরিদ্র জনসাধারণের সম্বোধনে থাকবে প্রায় মনিব ও দাসের মতই পার্থক্যÑ এ হচ্ছে আধুনিক সভ্যতায় কথিত সমঅধিকারের দৃষ্টান্ত। আনাস রাদি আল্লাহুর কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে বেশি খেদমত পেয়েছেন বলে নিজেই স্বীকার করেছেন। সভ্যতার ইতিহাসে সমঅধিকারের এর চেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। মাখযুম গোত্রের জনৈকা সম্ভ্রান্ত মহিলাকে চুরির অপরাধে হাত কাটার দ-াদেশ দেয়া হয়। সম্ভ্রান্ত পরিবারের খাতিরে তাকে দ- থেকে রেহাই দেয়া হোকÑ এ মর্মে সুপারিশ করার জন্য উসামাকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি তাঁর অনুরোধ গ্রাহ্য করেননি। তিনি সকলকে ডেকে ঘোষণা করেছিলেন, ‘হে মানুষেরা! তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতেরা ধ্বংস হয়ে যাবার কারণ ছিল, তাদের উঁচু স্তরের কেউ চুরি করলে তাকে ছেড়ে দেয়া হত আর নিম্ন স্তরের কেউ চুরি করলে তাকে শাস্তি দেয়া হত। জেনে রেখো, আল্লাহর শপথ, মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি (আল্লাহ রক্ষা করুন) করে, তাহলে নিশ্চয় তার হাত কাটা যাবে।’ যেখানে ইসলাম দিয়েছে বিচার ব্যবস্থায় এমন সমঅধিকার সেখানে মানব রচিত সমঅধিকার রাষ্ট্রে মারাত্মক ধরনের অপরাধ করার পরেও বিশেষ বিবেচনায় ক্ষমা করে দেয়া হয় খুনের দায়ে দ-প্রাপ্ত আসামিদেরকে। আবার কখনো বিচারের নামে অবিচার করে দ-িত করা হয় নিরপরাধ কাউকে।
জনৈক সাহাবী তার গোলামকে প্রহার করছিলেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা দেখতে পেয়ে বললেন, ‘সে তোমার ভাই। তুমি নিজে যা খাও, তাকে তাই খেতে দাও। তুমি নিজে যা পরিধান করো তাকেও তাই পরিধান করতে দেবে।’ এমন ঘোষণা বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্রে সমঅধিকারের দাবিদার কোন কর্তাব্যক্তি আজো দিতে পারেননি, কারো পক্ষে এ ঘোষণা দেয়া সম্ভবও নয়। কারণ যিনি এ ঘোষণা দেবেন তিনিই পারবেন না তা আমল করতে। ইসলামের নবীর পক্ষেই সম্ভব ছিল এমন ঘোষণা দেয়া। কারণ তিনি সকল মানুষকে দেখতেন একই চোখে। তিনি যা বলেছেন তা নিজে আমল করেছেন, আমল করেছেন তার অনুসারিরাও।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আজীবন গরিবদের সাথে নিঃস্ব অবস্থায় কাটিয়েছেন। তিনি দু‘আ করতেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে গরিব করে রেখো, গরিব অবস্থায় আমার মৃত্যুদান করো এবং কিয়ামতের দিন আমাকে গরিবদের মাঝে উপস্থিত করো। ইন্তেকালের সময় তার ছোট্ট গৃহে পানিপাত্র ও কয়েকটি বাসনপত্র ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে বিন্দুবিসর্গও পার্থক্য ছিল না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে খোলাফায়ে রাশেদীন ও পরবর্তী খলীফাগণ সাম্যের আদর্শ সমুন্নত রেখেছিলেন। ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা ওমার রাদিআল্লাহুর বিরুদ্ধে বিচারক জায়েদ ইবনে সাবিত রাদিআল্লাহুর আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। কাযী যথারীতি খলীফার ওপর সমন জারি করেন এবং খলীফাও যথারীতি কাযীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে আদালতে হাযির হন। বিচারক খলীফার জন্য আদালতে বিশেষ ব্যবস্থা করেন। তা দেখে ওমর রাদি আল্লাহু বিরক্তিসহকারে বললেন, ‘ইবনে সাবিত, এ মামলায় আপনি এখনি যা করলেন তা হল প্রথম অবিচার।’ এই বলে তিনি আসামীর অনুরূপ অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ালেন। সমঅধিকারের এমন নজির ইসলাম ছাড়া অন্য কোথাও লক্ষ্য করা যায়নি।
আলী রাদিআল্লাহু একবার বাদী হয়ে আদালতে উপস্থিত হন। তাকে বাদীর মর্যাদায় স্থান দেয়া হয়েছিল। খলীফা হিসেবে নয়। খিলাফাতে রাশিদার যুগের পর ইসলামের প্রশাসনযন্ত্রে অনেক দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছিল। অনেক মৌলিক গুণ তখন বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও যা অবশিষ্ট ছিল আধুনিক সভ্যতার গালভরা অভিমানী রাষ্ট্রগুলোতেও তার নজির খুঁজে পাওয়া যায় না।
আব্বাসীয় খলীফা মনসুর ছিল অত্যন্ত দুর্ধর্ষ শাসক। তাঁর বিরুদ্ধে কুলি সম্প্রদায়ের জনৈক ব্যক্তি আদালতে মুকাদ্দমা দায়ের করলে তিনি একাকীই সাধারণ আসামী সেজে আদালতে হাজির হন। সেখানে তাকে সাধারণ আসামীর মতই স্থান দেয়া হয়েছিল।
খলীফা মামুনের দরবারে এক সাধারণ বৃদ্ধা শাহজাদা আব্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করলে খলীফা পুত্র আব্বাসকে সাধারণ আসামীর মতই দরবারে উপস্থিত হতে হয়েছিল। উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকদের শাসনে শুধু এশিয়া নয়, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশ পর্যন্ত প্রকম্পিত ছিল। এতদসত্ত্বেও তারা আদালতের ওপর কোনরূপ হস্তক্ষেপ করতে পছন্দ করতেন না। মুসলিম সভ্যতার সর্বনিকৃষ্ট রাজতন্ত্রেও যে সাম্য প্রতিষ্ঠিত ছিল আধুনিক সভ্যতার সেরা রাষ্ট্রটিতেও তার নজির পাওয়া যাবে না। পারস্য ও রোমান দু’টি বিশ্ব সেরা সাম্রাজ্য বিজয়ী খলীফাকে ‘হে ওমর’ বলে সম্বোধন করা যেত। অথচ আজকের যুগে একজন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যকেও সম্মানসূচক শব্দে সম্বোধন না করলে তিনি ক্ষেপে যান। কিন্তু আবূ বকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু খলীফা হওয়ার পর সর্বপ্রথম ভাষণে বলেছিলেনÑ আমি আপনাদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ নই। ওমার রাদিআল্লাহু একবার মজলিসে শূরায় একটি বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে বলেছিলেন, ‘আমিও আপনাদের মত একজন ছাড়া আর কেউ নই। আমি যা চাই আপনারা তাই মেনে নেবেনÑ এমনটি হতে পারে না।’
ইউরোপীয় অনেক ঐতিহাসিক মনে করেনÑ বিশ্বব্যাপী ইসলামের দ্রুত প্রসারের পিছনে অন্যতম প্রধান শক্তি ছিল ইসলামের সাম্য নীতি। একজন নিগ্রো খ্রিস্টান শ্বেতাঙ্গদের গির্জায় প্রবেশের অধিকার পায় না। অথচ সে যদি মুসলমান হয়ে যায়, তবে স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ আদায় করতে পারে। এখানে বর্ণ-গোত্রের দৃষ্টিতে কোন ভেদ-বিচার নেই। আদম সন্তান হিসেবে সকল মানুষ ভাই ভাইÑ একজনের ওপর অন্য জনের কোনই প্রাধান্য নাইÑ এ হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা। ইসলামে মানুষের সাথে মানুষের তুলনা হয় আমলের বিচারে। এ ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা হলোÑ ‘নিশ্চয় তোমাদের মাঝে তাকওয়ার দিক থেকে যে এগিয়ে রয়েছে আল্লাহর নিকট সে-ই সবচেয়ে সম্মানীত। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং সব বিষয়ে অবহিত।’ সুতরাং এ কথা প্রমাণিত সত্য যে, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে ইসলাম।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন