সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

রাবি শিক্ষক হত্যা - ক্লু পায়নি পুলিশ : উত্তাল ক্যাম্পাস আতঙ্কে শিক্ষক সমাজ

প্রকাশের সময় : ২৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রাবি রিপোর্টার : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকীর হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সোমবার তৃতীয় দিনের মতো ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ আন্দোলনে উত্তাল ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সোমবার সকাল ১০টা থেকে বিভিন্ন বিভাগ ও সংগঠনের পক্ষ থেকে মানববন্ধন, শোক-মিছিল, অবস্থান ধর্মঘট ও সমাবেশ কর্মসূচি পালন করা হয়।
হুমকিপ্রাপ্ত শিক্ষকরা আতঙ্কে : বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক জঙ্গি কায়দায় প্রগতিশীল শিক্ষক হত্যার ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ক্যাম্পাসে। আতঙ্কে রয়েছেন এর আগে বিভিন্নভাবে হুমকিপ্রাপ্ত শিক্ষকরা। হুমকি পেয়ে নিরাপত্তা চেয়েও নিরাপত্তা মেলেনি এমন অভিযোগও উঠছে। ফলে প্রগতিশীল শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিত্বরা আতঙ্ক নিয়েই দিন পার করছেন। তাঁরা বলছেন এক ধরনের অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে থাকলেও এ থেকে উত্তরণের পথ কেউ দেখাচ্ছে না। তাঁরা বলছেন বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ঘটনার নেপথ্য না খোঁজা আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবহেলায় রাজশাহীসহ গোটা উত্তরাঞ্চলে হামলা ও হত্যাকা-ের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
এ ব্যাপারে রাজশাহী মহানগরীর অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার সরদার তমিজউদ্দিন বলেন, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আসামিদের ধরতেও সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। নতুন করে হামলা প্রতিরোধে আরো নিরাপত্তা জোরদার করা হবে।
জানা যায়, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে লালবাহিনী, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, চরমপন্থী গ্রুপ কিংবা সর্বহারা দলের পরিচয়ে চাঁদা চেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ জন শিক্ষকের কাছে চাঁদা দাবি করে হুমকি দেওয়া হয়। তবে গত এক বছরে সে সংখ্যা ৩০ ছাড়িয়ে গেছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে। হুমকিদাতা হিসেবে এরই মধ্যে জেএমবি, জনযুদ্ধ নেতা মেজর জিয়া বা কখনো অজ্ঞাত পরিচয়ে হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় অনেক শিক্ষকই আইনগত পদক্ষেপ নেননি। অনেকেই প্রক্টর দপ্তরকে জানিয়ে জিডি করেছেন।
তিন দিনেও ক্লু পায়নি পুলিশ : এ হত্যাকা-ের তিনদিন পেরিয়ে গেলেও কোনো সুনির্দিষ্ট ক্লু পায়নি পুলিশ। পুলিশ বলছে, ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের হাতে তিনি খুন হয়েছেন। এছাড়া এ ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শীও মেলেনি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আরো এক শিবিরকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। আটককৃত শিবিরকর্মীর নাম খায়রুল। সে নগরীর ললিতাহার এলাকার আব্দুল মতিনের ছেলে। শিবিরকর্মী খায়রুলকে আটকের বিষয়টি সাংবাদিকের কাছে নিশ্চিত করেছেন মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রোববার গভীর রাতে বোয়ালিয়া থানা ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ একযোগে নগরীর ললিতাহার এলাকায় অভিযান চালায় সন্দেহভাজন আসামি শিবিরকর্মী খায়রুলকে আটক করে। পুলিশ জানায়, তারা আশা করছেন, গ্রেফতারকৃত খায়রুলের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাবে। রাতে প্রথম দফা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মহানগর গোয়েন্দা কার্যলয়ে রাখা হয়েছে। এর আগে ২৩ এপ্রিল রাতে শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাকা-ের ঘটনায় শিবির নেতা মো. হাফিজুর রহমানকে তার ছোট বনগ্রামস্থ বাসা থেকে আটক করা হয়।
শিক্ষক সমিতির মানববন্ধন : এদিকে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সিনেট ভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে দ্বিতীয় দিনের মতো মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। সভাপতি প্রফেসর শহীদুল্লাহ’র সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক শাহ্ আজম শান্তনু’র সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ড. চিত্তরঞ্জন মিশ্র, আইন বিভাগের প্রফেসর ড. মো. হাসিবুল আলম প্রধান, ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ.এফ.এম মাসউদ আখতার, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাহিদুর রহমান, ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী প্রমুখ।
মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর মুহাম্মদ মিজানউদ্দিন, প্রো-ভিসি প্রফেসর চৌধুরী সারওয়ার জাহানসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী এতে অংশগ্রহণ করেন।
মানববন্ধনে শিক্ষকরা বলেন, বিগত এক যুগে চোখের সামনে ৪ জন শিক্ষককে দিনে-দুপুরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যাকা-ের সুষ্ঠ বিচার এখনো হয়নি। আজো আমরা সুষ্ঠ বিচারের জন্য চেয়ে আছি। এই ক্যাম্পাসে আর কত রক্ত ঝরলে আমাদের এই অপেক্ষার প্রহার শেষ হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আজ নিরাপত্তাহীন এবং আস্থাহীনতার সাথে সময় পার করছে।
এদিকে, শিক্ষক হত্যা ঘটনায় সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন চেঞ্চ মেকারস-এর প্রতিষ্ঠাতা ও রাবি প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এ্যাড. তানবীর-উল ইসলাম সিদ্দিকী। এছাড়াও মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করেন বিশ^বিদ্যালয়ের সহায়ক কর্মচারী সমিতি, চলচ্চিত্র সংসদ, রাবি শাখা বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, আওয়ামী কর্মকর্তা পরিষদ।
শিক্ষক সমিতির আল্টিমেটাম : শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ্ আজম শান্তনু বলেন, আমাদের সহকর্মী সিদ্দিকীকে অন্যায়ভাবে হত্যার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে দুই দিন ধর্মঘট পালন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সকল প্রকার কার্যক্রম থেকে বিরত ছিল। শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে আমরা আপাতত আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য কর্মসূচি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। তিনি আরও বলেন আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে-এর প্রশাসন যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন তাহলে পরবর্তীতে আরো কঠোর কর্মসূচি নিতে বাধ্য হবো।
একই সাথে শিক্ষক হত্যার ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইন শৃঙ্খলার বাহিনীর সহায়তা কামনা করে ভিসি প্রফেসর মুহাম্মদ মিজানউদ্দিন বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ।
শোক সভায় বাধভাঙা কান্না : সোমবার দুপুরে ইংরেজি বিভাগের আয়োজনে শোক সভায় ড. রেজাউল সিদ্দিকীর স্ত্রী হোসনে আরা বলেন, ‘আমি যখন সংসার সাগরের মাঝামাঝি থেকে তীরের কাছাকাছি পৌঁছেছি ঠিক সেই মুহূর্তে এসে আমার তরী ডুবে গেল। আমার স্বামীকে গলা কেটে হত্যা করা হলো। তিনি যদি বাজারের আলু পটল বিক্রি করতেন তাহলে তাকে কেউ গলা কেটে হত্যা করতো না। আমার স্বামীর অপরাধ তিনি বুদ্ধিজীবী।’
সভায় তিনি আরও বলেন, ড. সিদ্দিকীকে গলা কেটে হত্যার পর যে রক্ত ঝড়েছে তা চাপা দিতে যতগুলো চাদর লেগেছে তা দিয়ে একটা মিউজিয়াম গড়া যেত। আমার স্বামীর অপরাধ ছিল তিনি বাচ্চাদের গান শেখার জন্য হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিলেন। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, হারমোনিয়াম কিনে দেওয়া যদি তার অপরাধ হয়, তাহলে যে ব্যক্তি বাচ্চাদের ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম কিনে দেন তাকেও কী গলা কেটে হত্যা করা হবে?
এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমাদের সমাজ দিন দিন এমন দিকে চলে যাচ্ছে যেখানে বিচার হয় না। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতির কারণেই আজ অপরাধীরা অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। আমি আমার স্বামীর হত্যাকারী সেই যমদূতদের স্বচোখে দেখতে চাই। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই তিনি সিদ্দিকীর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে প্রমাণ করুক যে বাংলাদেশের কতটা অগ্রগতি হয়েছে। তিনি বলেন, সঠিক বিচার পাবো কিনা তা নিয়ে আমরা ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছি।
শোক সভায় উপস্থিত ছিলেন রেজাউল সিদ্দিকীর মেয়ে রিজওয়ানা হাসিন শতভী। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা নাস্তিক ছিলেন না। ব্লগে লেখালেখি নিয়ে আমার বাবার বিরুদ্ধে নানা কথা মিডিয়ায় বলা হলো, কিন্তু আমার বাবা যে মসজিদ তৈরি করেছেন তার কথা তো কোথাও লেখা হলো না? গান-বাজনা করলেই বলা হয় লোকটা নামাজ-কালাম পড়ে না, লোকটা নাস্তিক। সমাজে এই ধরনের মিথ সৃষ্টি হওয়ার ফলে খুনীরা আরও উৎসাহিত হচ্ছে। যতদিন না এই ভুল ধারণা দূর হবে ততদিন এদেশে সঠিক বিচার হবে না। সঠিক বিচার ওই ব্যক্তির সঙ্গে কবরে চলে যাবে।’
বাবার শোক সভায় মেয়ে রিজওয়ানা হাসিন শতভী বলেন, আমাদের সমাজে একটি মিথ দাঁড়িয়ে গেছে যে, ‘মুক্তমনা মানেই আওয়ামী লীগ, নাস্তিক। দাঁড়িওয়ালা মানেই বিএনপি-জামায়াত-শিবির। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, সমাজে এ মিথ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য কি শুধু খুনিরাই দায়ী, নাকি আমরাও? এ মিথগুলো আমরাই সৃষ্টি করেছি।’
ড. সিদ্দিকীর ব্লগে লেখালেখির বিষয়ে তার মেয়ে আরো বলেন, ‘বাবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সম্পর্কে তেমন কিছুই বুঝতেন না। তিনি ব্লগে লেখালেখি করতেন না। তাই বাবার লেখালেখি সম্পর্কে যে ভুল ধারণা ছড়িয়েছে তা যেন আর না ছড়ায়।’
বাবার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে তিনি আরও বলেন, ‘এ রকম করে বাংলাদেশ চলতে পারে না। এদেশে এখন যে কেউ যখন যাকে খুশি হত্যা করছে। তার কোনো বিচার হচ্ছে না। এটা একটা দেশের সুষ্ঠু পরিস্থিতি তুলে ধরে না। আমি আমার বাবার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। যাতে করে ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের হত্যাকা-ের শিকার না হয়। এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লে পুরো শোকসভাস্থলে কান্নার রোল পড়ে যায়।’
ইংরেজি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক শেহনাজ ইয়াসমীন-এর সভাপতিত্বে আরো বক্তব্য রাখেন, ভিসি প্রফেসর ড. মিজানউদ্দিন, প্রো-ভিসি প্রফেসর চৌধুরী সারওয়ার জাহান, বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এএফএম মাসউদ আখতার, ড. হাসন রাজা, মাস্টার্সের শিক্ষার্থী অনিকা চৌধুরী প্রমুখ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন