রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ডিপ্লোম্যাটিক জোনে নান্দনিকতা

গুলশান-বনানী-বারিধারার লেক হবে বিনোদন স্পট

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১১ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০১ এএম

যানজট-দূষণ ও কোলাহলে হাঁসফাঁস রাজধানীবাসীর নিরাপদে ঘোরাঘুরি-আড্ডা বা বিনোদনের জায়গা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। গত কয়েক বছর ধরে অনেকের কাছেই অবসর কাটানো ও আনন্দ উপভোগের অন্যতম স্বস্তির নিঃশ্বাস একমাত্র হাতিরঝিল। আর তাই রাজধানীবাসীর বিনোদন-আড্ডার কথা মাথায় রেখেইে হাতিরঝিলের ন্যায় ডিপ্লোম্যাটিক জোন হিসেবে পরিচিত গুলশান-বনানী-বারিধারার লেককে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নিয়ে সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ কাল ২০২২ সাল পর্যন্ত। লেক উন্নয়ন প্রকল্পের নতুন কাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে উদ্ধোধন করবেন বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানান, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য প্রকল্পটির প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হয়েছে। আজকের একনেক বৈঠকেই এটি উপস্থাপন হতে পারে। প্রকল্পটির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। বাস্তবায়নকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, যানজট-দূষণে হাঁসফাঁস রাজধানীবাসীর জন্য আরেকটি স্বস্তির নিঃশ্বাসের নাম হবে গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্প। এ প্রকল্পে থাকছে লেকে এসে বিদেশীদের পরিবেশ উপভোগ করার জন্য আলাদা ব্যবস্থা। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে লেক এলাকায় গড়ে তোলা হবে উড়ালসড়ক-ওভারপাস। ১৬ কিলোমিটার নৌপথে চলবে নৌযান।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে ১০০ কোটি টাকার প্রকল্পের পরিকল্পনা নেয়া হয়। ওই বছরের ১৯ জুন লেক বিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ ও সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য রাজউককে নির্দেশ দেয়া হয়। এর পরে লেক ও আশপাশের এলাকা থেকে সব অবৈধ স্থাপনা অপসারণ, পানি সংরক্ষণ আইনের অধীনে লেক দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্প বাস্তবায়নে নতুন করে উদ্যোগ নেন। এরই ধারাবাহিকতায় গুলশান-বনানী-বারিধারা লেকের ২৯৮ একর জায়গার উন্নয়নে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় ২০১০ সালে। তবে কাজ শুরু হয় বছর দুয়েক আগে। প্রথমে প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৪১০ কোটি টাকার। পরে প্রকল্পে নতুন নতুন অনেক বিষয় যুক্ত হয়। এতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। দীর্ঘদিন এ প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা ছিল। আর তাই শুধুমাত্র ভূমি অধিগ্রহণেই খরচ হচ্ছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
লেক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, লেকদূষণ, দখল রোধ ও লেকের সৌন্দর্য রক্ষায় এগিয়ে চলছে আরেক হাতিরঝিল প্রকল্পের কাজ। ইতোমধ্যে লেকের চেহারা পাল্টাতে শুরু করেছে। বনানী ১৮ নম্বর সড়কের কাছে লেকের পানি এখন স্বচ্ছ টলমলে। বাঁধানো দুই পাড়ে জন্মেছে সবুজ ঘাস। দেখা যায়, লেকের বনানী কবরস্থান থেকে বনানী ১১ নম্বর সেতু পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার অংশের খননকাজ শেষ। লেকের এই অংশে পানি স্বচ্ছ। ১১ নম্বর সেতু থেকে বনানী ২৮ নম্বর পর্যন্ত, মহাখালী গাউসুল আজম মসজিদের কাছ থেকে নিকেতন পুলিশ প্লাজা পর্যন্ত এবং বনানী চেয়ারম্যান বাড়ির পেছনে ন্যাম ফ্ল্যাটের কাছ থেকে কড়াইল বস্তি পর্যন্ত খননকাজ হয়েছে। যেসব অংশে খননকাজ হয়নি, সেখানে পানি নোংরা, পাড়ে জমে আছে ময়লা-আবর্জনা। লেকের যে অংশে খনন হয়েছে, তা মাটির বাঁধ দিয়ে আলাদা করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লেক সংরক্ষণ, পরিবেশ সুরক্ষা ও জলযান চলাচলের জন্য এ প্রকল্প। হাতিরঝিল যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, অনেকটা এর চেয়ে উন্নতভাবেই এ প্রকল্প করা হবে। আর এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে রাজধানী ঢাকাবাসাীর জন্য দ্বিতীয় উপহার।
লেক পারের বাসিন্দা আল আমিন বলেন, গুলশান-বনানীর এ লেক উন্নয়ন প্রকল্প একটি ভালো উদ্যোগ। এটি হাতিরঝিলের মতো আরেকটি হাতিরঝিল হয়ে উঠবে। তিনি বলেন, প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরী। কারণ রাজধানীর যানজট দূরীকরণে এ প্রকল্প ভূমিকা রাখবে।
লেক উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক রাজউকের নির্বাহী প্রকৌশলী আমিনুর রহমান সুমন বলেন, লেকের খনন করা অংশ পরিষ্কার রাখার জন্য বাঁধ দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। তিনি বলেন, গুলশান সোসাইটি লেকের আবর্জনা পরিষ্কারে সহায়তা করবে। প্রকল্পের ৭০ শতাংশ গুলশান লেকে পড়েছে, যে কারণে সংগঠনটির সঙ্গে তাঁরা চুক্তি করেছেন। বনানী ও বারিধারা সোসাইটি গুলশান সোসাইটিকে এ কাজে সহায়তা করবে। গুলশান সোসাইটির সদ্য বিদায়ী মহাসচিব ওমর শাহদাত বলেন, শিগগিরই লেক পরিষ্কারের কাজ শুরু করবে সোসাইটি। এলাকার বাসিন্দারাই এর খরচ বহন করবেন।
প্রকল্পে থাকছে
লেক এলাকায় আড়াই কিলোমিটারের একটি গোলাকার উড়ালসড়ক থাকবে। গুলশান শুটিং ক্লাবের পেছন থেকে নিকেতন পর্যন্ত করা হবে এই উড়ালসড়ক। থাকবে আরও দুটি ওভারপাস। লেকের বিভিন্ন অংশে নয়টি সেতু থাকবে। দৃষ্টিনন্দন এসব সেতুতে হাতিরঝিলের মতো আলোকসজ্জার ব্যবস্থা থাকবে।
লেকের পাড়ে নির্মাণ করা হবে প্রায় সোয়া পাঁচ কিলোমিটার সড়ক। এ ছাড়া লেক ভরাট না করে কলামের ওপর সড়ক নির্মাণ করা হবে ৫ দশমিক ৬০ কিলোমিটার সড়ক। একইভাবে কলামের ওপর থাকবে প্রায় ১২ কিলোমিটার হাঁটার পথ। এ ছাড়া লেকপাড়ে ৬ দশমিক ২ কিলোমিটার পায়ে চলার পথ থাকবে। প্রকল্পের আওতায়প্রায় ১৫ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণের কাজ হবে। বাঁধাই করা হবে পাড়। কড়াইল বস্তির সামনে, গুলশান শুটিং কমপ্লেক্সের পেছনে, গাউসুল আজম মসজিদের পাশে থাকবে বিনোদন পার্ক। অ্যাম্পিথিয়েটার করা হবে কড়াইল বস্তির সামনে লেকপাড়ে।
এছাড়া ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পানিপথ থাকবে লেকে। এই পথে ওয়াটার বাস ছাড়াও চলবে ওয়াটার ট্যাক্সি। মগবাজার মোড় এলাকায় হাতিরঝিল থেকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালের পেছনে কালাচাঁদপুর যাওয়া যাবে নৌপথে। হাতিরঝিল থেকে বনানী কবরস্থান পর্যন্তও চলাচল করবে নৌযান। মগবাজারে হাতিরঝিলের মুখে, বাড্ডাসংলগ্ন গুদারাঘাট, কালাচাঁদপুর ও বনানী-১১ নম্বর সেতুর কাছে করা হবে চারটি বোট স্টেশন। এ জন্যই ৯টি সেতু উঁচু করে তৈরি করা হচ্ছে।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের প্রফেসর ও লেক প্রকল্পের পরামর্শক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আগে ছিল শুধু গুলশান লেক উন্নয়ন প্রকল্প। সেখানে যোগাযোগব্যবস্থার বিষয়টি যুক্ত ছিল না। পরে একনেক থেকে আমাদের কাছে মতামত চাওয়া হয়। সে অনুযায়ী নকশা করা হয়েছে। যার মাধ্যমে পুরো এলাকার যানজট দূর করা সম্ভব হতে পারে। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে লেক এলাকা আরও মনোরম ও পরিবেশবান্ধব হবে।’
রাজউকের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান বলেন, গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক হাতিরঝিলের চেয়ে আরও বেশি মনোরম ও দৃষ্টিনন্দন হবে। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী চার বছরের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হবে এবং নগরবাসী ও বাইরে থেকে আসা মানুষ এর সুফল পাবে।
এদিকে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের ১০ম একনেক সভায় আজ উপস্থাপিত অন্যান্য প্রকল্পসমূহ হল- স্থানীয় সরকার বিভাগের ‘রাজশাহী ওয়াসার ভূ-উপরিস্থিত পানি শোধনাগার নির্মাণ’, ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডে সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়ন এবং বাস/ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ’, ‘ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিবাস নির্মাণ’, ‘যশোর অঞ্চল গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন’ এবং ‘খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন’।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ‘ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ’, ‘বৈরাগীপুল (বরিশাল)-টুমচর-বাউফল (পটুয়াখালী) জেলা মহাসড়ক (জেড-৮৯১০) যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ’ এবং ‘ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের নিমিত্রে নন্দিগ্রাম (ওমরপুর)-তালোড়া-দুপচাঁচিয়া-জিয়ানগর-আক্কেলপুর গোপিনাথপুর) জেলা মহাসড়ক (জেড-৫২০২) এবং নন্দিগ্রাম (কাথম)-কালিগঞ্জ-রাণীনগর জেলা মহাসড়ক (জেড-৫২০৭) যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ’।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিদ্যমান চত্বরে ১টি বহুতল অফিস ভবন নির্মাণ (১ম পর্যায়)’, বিদ্যুৎ বিভাগের ‘বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, চট্টগ্রাম জোন (২য় পর্যায়)’ এবং ‘মোল্লাহাট ১০০ মেগাওয়াট সোলার পিভি পাওয়ার প্লান্ট’। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের ‘বঙ্গবন্ধু দারিদ্র বিমোচন প্রশিক্ষণ কমপ্লেক্স (বর্তমানে বাপার্ড), কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ এর সম্প্রসারণ, সংস্কার ও আধুনিকায়ন’। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ‘পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন’, এবং ‘বৃহত্তর ঢাকা জেলা সেচ এলাকা উন্নয়ন (৩য় পর্যায়)’। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘রংপুর জেলার মিঠাপুকুর, পীরগাছা, পীরগঞ্জ ও রংপুর সদর উপজেলায় যমুনেশ্বরী, ঘাঘট ও করতোয়া নদীর তীর সংরক্ষণ ও নদী পুনঃখনন’। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘উপকূলীয় চরাঞ্চলে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন’ এবং জননিরাপত্তা বিভাগের ‘দ্য প্রজেক্ট ফর দ্য ইমপ্রুভমেন্ট অব রেসকিউ ক্যাপাসিটিস ইন দ্য কোস্টাল এ্যান্ড ইনল্যান্ড ওয়াটারস’ প্রকল্প।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন