মুরশাদ সুবহানী, পাবনা থেকে : ভারতের পানি রাজনীতির কাছে বাংলাদেশ অসহায় হয়ে পড়েছে। পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, আত্রাই, চিকনাই, মরাপদ্মাসহ প্রায় ৫৪ নদ-নদীতে পানি নেই। যে টুকু পানির প্রবাহ ছিল তাও চৈত্রের শেষ থেকে বৈশাখের এই সময় পর্যন্ত টানা তাপদাহে শুকিয়ে গেছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। বহুস্থানে হস্তচালিত নলকূপে পানি উঠছে না। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে অগভীর নলকূপ দিয়ে সেচ কার্য ব্যাহত হচ্ছে। নদ-নদীর পানি শূন্যতার কারণে কোন স্থানে মাটি ফেটে চৌঁচিড় হয়ে গেছে। পানির জন্য উত্তরের জেলাসমূহে এখন হাহাকার শুরু হয়েছে। গঙ্গার পানি ৩০ সাল মেয়াদি পানি চুক্তির ২০ বছর চলছে। চলতি বছর জানুয়ারী থেকে এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত শুষ্ক মওসুমে ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে বাস্তবে চুক্তি মাফিক পানির প্রবাহ আসেনি। নদীপাড়ের মানুষ চোখে পানি প্রবাহ দেখছেন না। পদ্মা নদীতে পানির প্রবাহ না থাকায় এর মূল শাখা নদী গড়াই, আত্রাই এবং এই সকল নদীর সম্পর্কিত অন্যান্য নদীতেও পানির প্রবাহ কমে যায়। তিস্তা নদীতে পানি না থাকায় ব্রক্ষপুত্র নদে পানির প্রবাহ থেমে গেছে। ফলে যমুনা নদীও শুকিয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক আবহাওয়ায় এসেছে অস্বাভাবিক পরিবর্তন। মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া গরমের বৃদ্ধি মেয়ে এপ্রিল মাসে প্রায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় পৌঁছে গেছে। জেলার ঈশ্বরদী, পাবনা, রাজশাহীতে গড়ে ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা চলছে। এই তাপদাহ আরও বাড়তে পারে। নদ-নদীতে পানি না থাকার কারণে তাপদাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। প্রবীণ লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে বিগত সময়ে এই রকম তাপদাহ এপ্রিল মাসে তারা অনুভব করেননি। দেশের নদ-নদী বাঁচাতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ১২ ডিসেম্বর ভারতের সাথে ৩০ সাল মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি করেন। চুক্তি মাফিক এপ্রিল-মে মাসকে চুক্তির শর্তে পিক শুষ্ক মওসুম ধরে ভারতের ফারাক্কা পয়েন্টে পানি প্রবাহ যাই থাক তা কোনভাবেই বাংলাদেশের পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে ৩৪ হাজার কিউসেকের নিচে নামবে না। বাস্তবচিত্র ভিন্ন। ২০ বছরে পদ্মা নদীর এই পয়েন্টে ১৮ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়েছে কি না তা এক বড় প্রশ্ন। এখনও পদ্মায় যে পানি আছে সেটা নালার মত প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মা নদীতে পানি স্বল্পতার কারণে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে মরুকরণ অবস্থা স্থায়ী রূপ নিতে আর বেশী দিন লাগবে না। জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পতিত হয়েছে অনেক আগেই। পদ্মা পাড়ে এখন দৃষ্টিতে আসে না অন্যান্য পাখি। মাঝে মধ্যে কবতুর দেখা যায়। আর কোন পাখি নেই। পদ্মা নদীতে পানি না থাকায় এই নদীসহ অন্যান্য নদীতে মাছের টান পড়েছে। বেশিরভাগ মাছের বেশিরভাগ চাহিদা পূরণ হচ্ছে পুকুরে চাষ করা হাইব্রিড মাছ দিয়ে। নদী, জলাশয়, বিলের মুক্ত মাছের স্বাদ আর পাওয়া যায় না পুকুরে চাষ করা মাছে। আন্তর্জাতিক নদী পদ্মা (গঙ্গা) উজানে ভারত ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে ভাগিরথী নদীর মাধ্যমে পানি প্রবাহ ঘুরিয়ে নেয়ায় ভাটির দেশ বাংলাদেশ ক্রমেই তীব্র পানি সংকটে নিপতিত হয়। কালক্রমে প্রমত্তা পদ্মা নদীর সাথে প্রধান শাখা নদী আত্রাই, গড়াইসহ ৫৪টি নদ-নদীতে পানির টান পড়তে শুরু করে। এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যায়। ফলে নদী ও ভূ-গর্ভের পানি দিয়ে সেচ কার্যব্যাহত হয়ে পড়ে। চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর পদ্মা নদীর বুকে চুক্তি মাফিক পানি আসেনি। এখনও পানি পাওয়া যায় না। যদিও হাইড্রোলজি (বর্তমান নাম ভূ-পরিস্থি পানি জরিপ দপ্তর যা উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন) পাবনার অফিস চুক্তি পর থেকে পানি প্রবাহের কোন তথ্য সাংবাদিকদের প্রদান করা হয় না। জিজ্ঞেস করলে বলা হয় যৌথ নদী কমিশন দিতে পারবে। দু’একজন ব্যক্তি সামান্য তথ্য দিলেও নাম প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেন। সূত্র মতে, এ বছর শুষ্ক মওসুমের শুরুতে জানুয়ারী মাসে ভারত থেকে একটি প্রতিনিধি দল হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে আসেন। জানুয়ারী থেকে মে মাস পর্যন্ত তারা ১০ দিন পর পর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে নদীর বিভিন্ন স্থানে পানির প্রবাহ ও গভীরত্ব মাপজোক করেন। তাও আবার অনেকটা গোপনে। তাদের প্রাপ্ত ফলাফল এ যাবৎ কাল স্থানীয়ভাবে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের মানুষকে জানানোর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এবারও একই অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে।
উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ দেখছেন, নদী শুকিয়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। পদ্মা নদীতে পানি না থাকায় এর প্রধান শাখা নদী গড়াই ও আত্রাইসহ ৫৪টি নদ-নদীতে এখন পানির তীব্র সংকট বিরাজ করছে। গড়াই নদীর কুষ্টিয়া কয়ারা ব্রিজের নীচেও বালু চর। জিকে প্রজেক্ট কার্যত: অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পদ্মা, গড়াই, আত্রাই, চিকনাইসহ পদ্মার ৫৪টি শাখা-প্রশাখা নদীর বুকে জেগে উঠেছে ছোট বড় অসংখ্য চর। কোন কোন স্থানে বালু স্থায়ী মুত্তিকায় রূপ নেয়ায় নদী বক্ষে ফসলের চাষ করে আসছেন কৃষক বহুদিন ধরে। কিন্তু যে ফসলের জন্য সেচের প্রয়োজন সেই ফসল বুনন করে সেচ নদীর পানি দিয়ে সেচ কার্য করতে পারছেন না। পদ্মা নদীর উপর হার্ডিঞ্জ রেলওয়ে সেতু (ব্রিটিশ আমলে নির্মিত) আর লালন শাহ সড়ক সেতু স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের সময় চালু হয়েছে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আর লালন শাহ সেতুর কাছে গেড়ে উঠেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগের রেস্ট হাউজ। এই হাউজ তৈরী সময় মাটি উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট হয় খাল। যা দেখলে মনে হবে পদ্মা নদী। এই খালে লিজ নিয়ে স্থানীরা মাছ চাষ করছেন। শুষ্ক মওসুমে পদ্মা, তিস্তায় পানির প্রবাহ না থাকা আর বর্ষা মওসুমে ফারাক্কার গেট খুলে দিলে দেশে মানুষ ভাসে বানের জলে। নদীতে ড্রেজিং করে গভীরত্ব বাড়িয়ে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা নেয়া হলে বর্ষা মওসুমে আসা পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব। তবে সমস্যা হলো নদী ড্রেজিং-এর ফলে উত্তোলিত বালুর স্তূপ কোথায় রাখা যাবে? অপর এক সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ইউরেনিয়াম চুল্লি চালু হলে শুধু এর তাপমাত্রা ঠা-া করতে বার্ষিক ৮১ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানির প্রয়োজন হবে। পানির অর্ধেক রিসাইক্লিং মাধ্যমে পুনরায় ব্যহহৃত হবে। পানির উৎস হিসেবে পদ্মা নদী আর প্রকল্প এলাকায় পাম্প হাউজের মাধ্যমে পানির চাহিদা পূরণ হবে। যদি পদ্মা নদী থেকে পানির সরবরাহ নেয়া হয় তাহলে এই নদীর দশা আরও করুণ হবে কি? সেই প্রশ্ন সামনে আসছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন