প্রায় এক দশক ধরে দেশে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে গতি আসছে না। বিগত এক-এগারো সরকারের সময় আমরা বিশ্ব-অর্থনীতিতে মন্দার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে স্থবিরতায় সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখেছি। প্রায় এক দশক পেরিয়ে এসে এখনো আমরা বিনিয়োগে একই প্রকার স্থবিরতার চিত্র দেখছি। এর মধ্যেও দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির চাকায় যথেষ্ট গতিশীলতা দেখা যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে প্রিডিকশন করা হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে অবশ্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ থেকে ৬.৮ শতাংশ পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারে বলে বলা হচ্ছে। সর্বশেষ এ সপ্তাহে প্রকাশিত ইউএন এসকাপ রিপোর্টেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৮ শতাংশ হতে পারে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। নানাবিধ সংকট ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই হারকে সন্তোষজনক বলা যায়। তবে সামগ্রিক সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই সূচকই যথেষ্ট নয়। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে ইতিবাচক লক্ষণ না থাকায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ দরিদ্র মানুষ পাচ্ছে না। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের কারণে গ্রামীণ জনপদে জীবন-মানের কিছুটা উন্নয়ন লক্ষণীয় হলেও বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য একটি বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ায় একশ্রেণীর মানুষের হাতে জমা হচ্ছে শত শত কোটি টাকা, আরেক শ্রেণীর মানুষ দরিদ্র থেকে আরো দরিদ্র হচ্ছে। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকারি মহল যতই আত্মতুষ্টিতে ভুগছে, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাগুলো যেন ততই পেছনে পড়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগ না হওয়ার জন্য আগে বিরোধী দলের আন্দোলন ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে দায়ী করা হতো। প্রায় দেড় বছর ধরে দেশে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন ও অস্থিতিশীলতা না থাকলেও কোনো সেক্টরেই বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হতে দেখা যাচ্ছে না। এফডিআই অথবা অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কৃষি, শিল্প বিনিয়োগ, আবাসন ও নগরায়ণসহ প্রতিটি খাতেই দীর্ঘমেয়াদি খরা চলছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাসের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশেও তেলের দাম কমতে শুরু করেছে। এতদিন ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহারকে বিনিয়োগের প্রতিবন্ধক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এখন পর্যায়ক্রমে সুদের হার কমানোর পরও বিনিয়োগে কোনো গতি ফিরছে না। ব্যাংকগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকার উদ্বৃত্ত তারল্য জমা হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে বর্তমান তারল্যের পরিমাণ এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকেও রিজার্ভ বেড়ে চলেছে। সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিরা এই রেকর্ড রিজার্ভ নিয়ে গর্ব করলেও এটি যে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি, কর্মসংস্থান তথা টেকসই অর্থনীতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। দেশে বিনিয়োগ ও নিরাপত্তার কোনো গ্যরান্টি না থাকায় প্রতিমাসে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়াও বন্ধ হচ্ছে না। এহেন বাস্তবতায় বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া অথবা লুকিয়ে রাখা অপ্রদর্শিত আয় আবাসন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে আবারো দাবি জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা।
আগামী বাজেটকে সামনে রেখে একটি বাজেট প্রস্তাবনায় এফবিসিসিআই’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অপ্রদর্শিত আয় দেশের রিয়েল এস্টেট সেক্টরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কাছে জবাবদিহিতা বা হয়রানি না করার গ্যারান্টি দেয়া হলে এই সম্ভাবনাময় সেক্টরে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানসহ পুরনো বিনিয়োগে গতি আসতে পারে। বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক মন্দায় যেসব সেক্টর সবচেয়ে বেশি সংকট বা স্থবিরতার সম্মুখীন হয়েছে, আবাসন খাত তার অন্যতম। বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম প্রকল্পসহ নানাভাবে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া টাকার বেশিরভাগই অপ্রদর্শিত আয়। আবাসন খাতে বিনিয়োগকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে জবাবদিহিতামুক্ত রাখা হলেও দুদকসহ সরকারি এজেন্সির নজরদারি ও হয়রানির ভয়ে অনেকেই অপ্রদর্শিত আয় এ খাতে বিনিয়োগে ভরসা পান না বলে এ খাতের মন্দা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যক্তিপর্যায়ে এ খাতের বিনিয়োগকে ঝামেলামুক্ত করা সম্ভব হলে দেশের আবাসন খাতের মন্দা কাটিয়ে লক্ষ-কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের মধ্য দিয়ে অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চারিত হতে পারে। আবাসন খাতের যেমন অনেকগুলো ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ খাত রয়েছে, একইভাবে এই খাতের বিনিয়োগকে সার্থক ও গতিশীল করতে হলে গ্যাস-বিদ্যুতের মতো অত্যাবশ্যক ইউটিলিটি সার্ভিসেরও অনুরূপ নিশ্চয়তা থাকতে হবে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসার পরও আমাদের শিল্প ও গৃহস্থালিতে গ্যাসের মূল্য বাড়ানো হচ্ছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিশেষত আবাসন খাতের বিনিয়োগকেই বেশি বাধাগ্রস্ত করছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমত দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগ বোর্ড, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্মকা-ে সমন্বয় ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের হয়রানির ভয় ও শঙ্কা দূর করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন