চট্টগ্রাম ব্যুরো : নৌযান শ্রমিকরা কাজে যোগদানের পর এবার জাহাজ-নৌযান মালিকরা বেঁকে বসায় বিভিন্ন পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করছে না এখনও। এতে করে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে অচলদশা কাটেনি। দেশী-বিদেশী বড় জাহাজযোগে (মাদার ভেসেল) আমদানিকৃত বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রী বিশেষ করে আসন্ন রমজানের ভোগ্যপণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। গতকাল (শুক্রবার) পর্যন্ত চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের বহির্নোঙ্গরে ৫৮টি বড় জাহাজ অবস্থান করছিল। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের আমদানিকৃত শিল্পের কাঁচামাল বোঝাই ২৬টি জাহাজে কাজ চলছে।
কিন্তু বাদবাকি ৩২টি জাহাজে আনীত নিত্য ও ভোগ্যপণ্য লাইটারিং খালাস কাজ অচল হয়ে আসে। এসব জাহাজ আমদানিকৃত পণ্যসামগ্রী নিয়ে বহির্নোঙ্গরে অলস বসে আছে। এর জন্য প্রতিদিন বৈদেশিক মুদ্রায় বিপুল অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে শিপিং মালিকদের। শিডিউল অনুসারে এ সপ্তাহে বহির্নোঙ্গরে আরও জাহাজ এসে পৌঁছালে একইভাবে আমদানি পণ্য খালাসে অচলাবস্থার মুখে পড়তে হবে।
লাইটারিং খালাস কার্যক্রম অচল হয়ে পড়ার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্ণফুলী মোহনায় ও দেশের বিভিন্ন নৌ-বন্দরে, ঘাটে শত শত কার্গোজাহাজ, কোস্টার, নৌযান অলস অবস্থায় বসে আছে। ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলাসহ রোজার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সময়মতো লাইটারিং খালাস না হলে বাজারে সাময়িক সরবরাহ সংকটেরও আশংকা রয়েছে। আর এরজন্য খেসারত দিতে হবে ভোক্তা সাধারণকেই। ইতিমধ্যে চলমান সংকটের অজুহাতে চিনিসহ কয়েকটি খাদ্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট।
এদিকে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকা ধর্মঘট স্থগিত ঘোষণার পর বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন লাইটারেজ ও কার্গো জাহাজবহরে ফের কাজকর্ম শুরু হলেও সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজগুলোর চলাচল শুরু হয়নি। গত বুধবার থেকে এসব লাইটার, কার্গোজাহাজ, কোস্টারের শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিতে গেলেও মালিকেরা জাহাজ চালাচ্ছে না। লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলে মালিকপক্ষের নতুন করে ধর্মঘটের তৃতীয় দিনে গতকালও কোনো জাহাজ বুকিং দেয়া হয়নি। এতে করে শ্রমিকদের ধর্মঘটের ফলে সৃষ্ট সংকটের সুরাহা হলেও মালিকেরা বেঁকে বসায় পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।
মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোন ধরনের হিসাব-নিকাশ না করে ভাড়া এমনভাবে বাড়ানো হয়েছে তাতে মালিকদের পক্ষে জাহাজ চালানো মোটেও সম্ভব নয়। একটি জাহাজের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছিতে গিয়ে ঠেকবে। এ অবস্থায় জাহাজ মালিকেরা দেউলিয়া হয়ে যাবে বলেও তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এদিকে নিত্য ও ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকেরা বলছেন, আগে ধর্মঘট করেছিল শ্রমিকপক্ষ। আর এখন মালিকেরা বেঁকে বসেছেন। আমরা জিম্মি হয়ে আছি। কেননা এ অবস্থায় একেকটি জাহাজকে হাজার হাজার ডলার ডেমারেজ বা গচ্চার কবলে পড়তে হচ্ছে। যার যোগান দিতে হচ্ছে দেশের সাধারণ জনগণকেই। মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমেই সুষ্ঠুভাবে লাইটারেজ জাহাজের চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। এভাবে দেশকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ ১৫ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকে গত ২০ এপ্রিল রাত থেকে সারাদেশে নৌযান ধর্মঘট শুরু হয়। ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত লাগাতার ধর্মঘট চলাকালে দফায় দফায় বৈঠক হয়। পরবর্তী সময়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে এক বৈঠকে এ ক্যাটাগরির শ্রমিকদের মজুরি ১০ হাজার টাকা, বি ক্যাটাগরির শ্রমিকদের মজুরি ৯ হাজার ৫শ’ টাকা এবং সি ক্যাটাগরির শ্রমিকদের মজুরি ৯ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। বৈঠকে জাহাজ মালিকেরা উপস্থিত থাকলেও তারা এসব দাবির ব্যাপারে চূড়ান্ত কিছু না জানিয়ে বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসে। বেতন-ভাতা, মজুরি বৃদ্ধি এবং তা বাস্তবায়নের ঘোষণায় নৌযান শ্রমিকেরা কাজে যোগ দেন। এরফলে গত বুধবার রাত থেকে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন লাইটার জাহাজবহরে কাজ শুরু হয়ে যায়।
কিন্তু ব্যক্তি মালিকানাধীন লাইটার, কার্গো জাহাজের মালিকেরা জাহাজ পরিচালনা করা সম্ভব নয় বলে বেঁকে বসেন। তারা বলেন যে অস্বাভাবিক পরিমাণ বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে তা দিয়ে কোনোমতেই একটি জাহাজ চালানো সম্ভব নয়। বিশেষ করে ছোট জাহাজগুলো পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব। অথচ দেশের ৮০ শতাংশ লাইটারেজ জাহাজই ছোট জাহাজ। সেগুলোর ধারণক্ষমতা ১২শ’ মেট্রিক টনের কাছাকাছি। এভাবে শ্রমিকপক্ষের পর আবার মালিকপক্ষের অনীহা-আপত্তির কারণে লাইটার জাহাজ চলাচলে নতুন করে সংকট দেখা দিয়েছে। গতকাল পর্যন্ত এ সংকট নিরসনে নৌ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন