উৎক্ষেপণে ছয় মাসের মাথায় দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ এর মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে বুঝে পেয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল (শুক্রবার) রাজধানীর কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউয়ে বাংলাদেশ কমিউনেকশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটিড (বিসিএসসিএল) কার্যালয়ে ‘ট্রান্সফার অফ টাইটেল’ হস্তান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক স্যাটেলাইটের নিয়ন্ত্রণ আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝিয়ে দেয় স্যাটেলাইট সিস্টেম নির্মাণকারী ফরাসি কোম্পানি থ্যালেস অ্যালানিয়া স্পেস।
থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের প্রোগ্রাম ম্যানেজার জিল অবাদিয়া বিটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জহুরুল হকের কাছে ‘ট্রান্সফার অফ টাইটেল’ হস্তান্তর করেন। পরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তা হস্তান্তর করেন বিসিএসসিএলের চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদের কাছে। গত ১২ মে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর এর নিয়ন্ত্রণ ছিল উৎক্ষেপণকারী ফরাসি প্রতিষ্ঠান থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের কাছে। গত জুনে প্রাথমিকভাবে এটার নিয়ন্ত্রণ নেয় বাংলাদেশ। সবধরণের কারিগরি পরীক্ষা শেষে সম্পূর্ণভাবে এর নিয়ন্ত্রণ বুঝে পেল গতকাল। এই স্যাটেলাইট সিস্টেমের নকশা তৈরির জন্য ২০১২ সালের মার্চে মূল পরামর্শকের দায়িত্ব পায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল’। এরপর স্যাটেলাইট সিস্টেম কিনতে ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়ার সঙ্গে এক হাজার ৯৫১ কোটি ৭৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকার চুক্তি করে বিটিআরসি। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ‘ট্রান্সফার অফ টাইটেল’ হস্তান্তর অনুষ্ঠানে বলেন, আজকের দিন দেশের মানুষের জন্য স্মরণীয় দিন। তলাহীন ঝুড়ি হিসেবে যে দেশ আখ্যায়িত হয়েছিল সে দেশ এখন স্যাটেলাইটের মালিক, এটি সবার জন্য গর্ব করার বিষয়। মন্ত্রী বলেন, এ স্যাটেলাইট কতদিনে লাভজনক হবে বা কতোটা সেবা পাওয়া যাবে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল এটি বাংলাদেশের একটি অর্জন, একটি গর্বের বিষয়।
বিসিএসসিএল চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলেন, আজ থেকে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের প্রকৃত মালিক হল। ২০০৯ সাল থেকে দীর্ঘ এক যাত্রার শেষ হল এর মাধ্যমে। এ প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা ও দিক নির্দেশনা পেয়েছি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টার (সজীব ওয়াজেদ জয়) কাছ থেকে। তিনি জানান, স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২০টি দেশের মধ্যে ব্যবহার করে বাকি ২০টি ভাড়া দেওয়া হবে বিদেশে। আমাদের যে টাকা খরচ হয়েছে, খুব কম সময়ে তা উঠে আসবে, আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জে যাব বলে আশা করি। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদার, বাংলাদেশে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত ম্যারি আনিক রোর্ডিনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা।
দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙামাটির বেতবুনিয়ায়। গাজীপুরের নলজানি বিটিসিএল কার্যালয়ের পাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে।
বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে জলবায়ু, সম্প্রচার ও তথ্য-প্রযুক্তিতে: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে দেশের তথ্য-প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ফলে একদিকে যেমন বাংলাদেশ নিরবিচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদান করতে পারবে, তেমনি সম্প্রচার সেবা, টেলিমেডিসিন, ই-লার্নিং, ই-এডুকেশন, ডিটিএইচ সেবা প্রদান করতে পারবে। এছাড়া ট্রান্সপন্ডার লীজের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। স্যাটেলাইটে থাকা ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২০টি বাংলাদেশে নিজেদের ব্যাবহারের জন্য রাখা হবে। বাকী ২০টি ট্রান্সপন্ডার ভাড়া কিংবা বিক্রি করা হবে বিদেশের কাছে। ২০টি ট্রান্সপন্ডার থেকেই দেশের টেলিভিশন চ্যানেল থেকে শুরু করে ডিরেক্ট টু হোম (ডিটিএইচ) পরিচালনাকরী প্রতিষ্ঠানগুলো ভাড়া নিতে পারবেন।
‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ স্থাপনের লক্ষ্যে ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অরবিটাল ¯øটের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারস্পুটনিক ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব স্পেস কমিউনিকেশনসকে ১৫ বছরের জন্য দুই কোটি ৮০ লাখ ডলার দিতে হবে। বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বিদেশী স্যাটেলাইটের ফ্রিকোয়েন্সি ভাড়া নিয়ে টেলিভিশন চ্যানেল, টেলিফোন, রেডিওসহ অন্যান্য যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। এতে প্রতি বছর ভাড়া বাবদ বাংলাদেশকে ১৪ মিলিয়ন ডলার গুণতে হয়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ফলে দেশে শুধু বৈদেশিক মুদ্রারই সাশ্রয়ই হবে না, স্যাটেলাইটের অব্যবহৃত অংশ নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের মতো দেশে ভাড়া দিয়ে প্রতি বছর ৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থ আয় করা যাবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবে এ স্যাটেলাইট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন