সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বাংলাদেশে হামলার জন্য দায়ী চরমপন্থী সংগঠন বিএনপি নয়

প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নিউইয়র্ক থেকে এনা : বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার, বিদেশি এবং মুক্তচিন্তার মানুষকে হত্যায় যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। এসব হত্যাকা- নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করলেও জুলহাজ মান্নান হত্যাকে সিরিয়াসলি নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
জুলহাস মান্নান হত্যার পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরাসরি ফোন করেছেন। অন্যদিকে সার্বিক পরিস্থিতির অবনতিতে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল আগামী ৪ মে বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এসব হত্যাকা-ের জন্য বিএনপি এবং জামায়াতকে দোষারূপ করা হচ্ছে এবং বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব নেই বললেও যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক হামলাগুলোর পেছনে দায়ী চরমপীন্থ গ্রুপগুলো। উদারপন্থী বাংলাদেশে চরমপন্থীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মার্কিন ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার এসব হামলায় রাজনৈতিক বিরোধীদের দায়ী করলেও, প্রাপ্ত প্রমাণাদি নির্দেশ করে যে, হামলার জন্য চরমপন্থ’ী গ্রুপগুলোই দায়ী। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে বর্তমান বিশ্বের আলোচিত সন্ত্রাসী সংগঠন আইএসর শেকড় গেড়ে বসার সম্ভাবনা প্রকট এবং তা নিয়ে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র।
গত বৃহস্পতিবার হাউজ ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটিতে ‘এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি’ বিষয়ক এক শুনানিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এসব কথা বলেন ব্লিঙ্কেন। শুনানিতে বলা হয়, বাংলাদেশে ইউএসএইডের এক কর্মী হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত এ দেশটির ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ঐতিহ্য আছে। তবে বাংলাদেশ বর্তমানে চরমপন্থীদের হুমকিতে রয়েছে।
মুক্তমনা লেখক, ব্লগার, বিদেশি, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ধারাবাহিক প্রাণঘাতী হামলার পেছনে আন্তর্জাতিক জিহাদি গোষ্ঠীগুলো রয়েছে বলে স্বীকার করে না বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু ইউএসএইডর কর্মী ও সমকামী অধিকার কর্মী জুলহাজ মান্নানকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে আল-কায়েদা অন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের বাংলাদেশ শাখা। এ দায় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কিন্তু এসব ঘটনা ভীতি বাড়াচ্ছে যে, স্থানীয় চরমপন্থীরা বাংলাদেশে আল-কায়েদা বা আইএস’র মতো গোষ্ঠীগুলোকে অবস্থান পাকাপোক্ত করার সুযোগ করে দিতে পারে। যে দেশটি এমনিতেই শাসক ও বিরোধী দলের মধ্যকার তিক্ত বিভক্তির কারণে সৃষ্ট দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিধ্বস্ত।
শুনানিতে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করেন রিপাবলিকান দলের কংগ্রেসম্যান স্টিভ শ্যাবোট। তিনি তার প্রশ্নে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ওই নির্বাচনে শেখ হাসিনা পুনর্র্নিবাচিত হন। আর নির্বাচন বর্জন করেন খালেদা জিয়ার দল। ফলে আমার মনে হয় দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা অনিশ্চিত। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ উদার ও মধ্যপন্থী মুসলিম দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। কিন্তু সম্প্রতি সহিংস কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ সপ্তাহেই সমকামী অধিকার কর্মী এবং ইংরেজি বিষয়ের একজন অধ্যাপককে জনসমক্ষে হত্যা করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব হত্যাকা-ের সঙ্গে উগ্রপন্থী গ্রুপগুলো সংশ্লিষ্ট। এ বিষয়ে কি করা যেতে পারে তা নিয়ে ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনের মন্তব্য জানতে চান শ্যাবোট। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কূটনীতিক ব্লিঙ্কেন বলেন, যদিও সরকার এসব হামলার জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রমাণাদি নির্দেশ করছে যে, এসব হামলার জন্য চরমপšী’ গ্রুপগুলো দায়ী। এরা হতে পারে স্থানীয় কিংবা আইএস/আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। হাউজ ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটিকে ব্লিঙ্কেন আরও বলেন, ‘এসব ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশে আইএস’র শেকড় গেড়ে বসতে পারার সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন করে। কোনোভাবেই এটা আমরা চাই না।’
সংখ্যালঘু ও মধ্যপন্থীদের ওপর হামলা, যা সাধারণত চালিয়ে আসছে ছুরি বা চাপাতিধারী তরুণরা, তা শুরু হয় ২০১৩ সালে। এরপর থেকে এসবের বিস্তার কেবল বেড়েছে। হতাহতদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশি-আমেরিকান লেখক অভিজিৎ রায়। তাকে ঢাকার একটি সড়কে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে হত্যা করা হয়।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো আশঙ্কা করছে যে, অন্যরাও জঙ্গিদের হত্যার হুমকিতে আছে। কারণ, সরকার তাদের দুর্দশা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। কারণ, সরকার হয়তো কিছু ব্লগারের নাস্তিক্যবাদী লেখালেখিতে ক্ষুব্ধ মুসলিমদের সমর্থন হারাতে চায় না। কর্তৃপক্ষ কিছু মামলায় কয়েকজন সন্দেহভাজনকে আটক করেছে। কিন্তু এদের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়নি। কর্তৃপক্ষ এখনো মূলহোতাদের চিহ্নিত বা গ্রেফতার করতে পারেনি।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ঝুঁকিতে থাকা কয়েকজন ব্যক্তিকে আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে। তবে, এখনও স্পষ্ট নয় যে, এটি আদৌ করা হবে কিনা। মানবাধিকার সংগঠনগুলো গত ডিসেম্বর থেকে এ আহ্বান জানিয়ে আসছে। ওয়াশিংটনের জন্য আরও বড় উদ্বেগ হলো, ধর্মীয় চরমপন্থীদের জন্য বাংলাদেশ উর্বরক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তমতের ঐতিহ্য; খ্রিস্টান ও হিন্দু সংখ্যালঘুদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে দারিদ্র্য হ্রাস ও আয়ুষ্কাল বৃদ্ধিতে সফলতা রয়েছে। ওয়াশিংটন বিশ্বব্যাপী আইএস জঙ্গিদের মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে।
হেরিটেজ ফাউন্ডেশন নামে মার্কিন একটি থিঙ্কট্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ লিসা কার্টিস বলেন, ‘বাংলাদেশ সবসময় এমন একটি দেশ ছিল, যেটিকে আমরা একটি আদর্শ মুসলিম গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে তুলে ধরেছি। এখন মনে হচ্ছে, সে জায়গা থেকে ক্রমেই পিছু হটছে দেশটি।’ তিনি বর্তমান হত্যাযজ্ঞকে বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশি সমাজের স্বাভাবিক রূপকে পালটে দেয়া বা একে ইসলামীকরণ করার চেষ্টা হিসেবে।
ফেব্রুয়ারিতে কংগ্রেসের এক সাক্ষাতে মার্কিন ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্সের পরিচালক জেমস ক্ল্যাপার বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের হুমকি সম্পর্কে কথা বলেন। তখন তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে এক মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিরোধীদের দুর্বল করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টা আসলে ‘দেশটিতে নিজেদের উপস্থিতি বিস্তার করতে আন্তঃদেশীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর প্রবেশের দ্বার উন্মোচন করে দেবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের আধিপত্যবিস্তারকারী শক্তিতে পরিণত হয়েছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ক্রমেই কোণঠাসা করেছেন। এ দলটি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন বয়কট করেছিল। তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করেন। এতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৃশংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামী দলের কয়েকজন নেতার মৃত্যুদ- হয়। এ দলটি বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়।
বিরোধী দলগুলো সাম্প্রতিক এসব হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে আসছে। তারা বলছে, নিরাপত্তা ব্যর্থতা ঢাকতে তাদের বলির পাঁঠা বানাচ্ছে সরকার। মান্নান হত্যার জন্যও বিরোধীদের দায়ী করেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরই, আল-কায়েদা অন দ্য ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্টের সহযোগী আনসার-আল-ইসলাম জানায়, তারাই ওই অ্যাক্টিভিস্ট ও তার অভিনেতা বন্ধুকে হত্যা করেছে। কারণ হিসেবে এ গ্রুপটি বলেছে যে, তারা ছিল বাংলাদেশে সমকামিতার প্রচারণা ও চর্চার অগ্রদূত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন