অর্থনৈতিক রিপোর্টার : চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকারের প্রাক্কলিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশের দাতা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ক বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি আবারো ৬ দশমিক ৮০ ভাগ প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে জানায়। শনিবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিমত ব্যক্ত করে বিশ্বব্যাংক। ঢাকায় নিযুক্ত সংস্থাটির কান্ট্রি ডাইরেক্টর চিমিয়াও ফান সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন এবং আপডেট উপস্থাপন করেন প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্কলন অনুয়ায়ী, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ অর্জিত হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির সরকারি এ হিসাব মেলানো যাচ্ছে না, এমন দাবি করে বিশ্বব্যাংক বলেছে, এ বছর শুধু রফতানি ও ব্যক্তিখাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি ছাড়া অন্য কোন সূচকেই গত অর্থবছরের চেয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়েনি। তাহলে কীভাবে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এত হবে। সংবাদ সম্মেলেনে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কত হতে পারে এমন প্রশ্ন তোলা হলে এর জবাব এড়িয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, আগামী অর্থবছরে (২০১৬-১৭) বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে।
বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের ধারাবাহিক ৬ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রশংসা করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১১৮টি দেশের মধ্যে মাত্র ১২টি দেশ ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। তাই আন্তর্জাতিক বিবেচনায় যে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে বা হবে সেটি প্রশংসার।
প্রতিবেদনে ধারাবাহিকতা ধরে রাখার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলা হয়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যে প্রক্ষেপণ দিয়েছে, সেখানে দেখা গেছে- সেবা ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে কিছুটা প্রবৃদ্ধি হওয়ায় চলতি অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে। কিন্তু কৃষিতে প্রবৃদ্ধি কমেছে। কিন্তু প্রতিবছর তো বেতন বাড়বে না, তাহলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে কার হাত ধরে। এজন্য কৃষিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ার দিকে নজর দিতে হবে।
‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে অর্থনীতির জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- জ্বালানী সংকট, অবকাঠামো সংকট, প্রতিযোগিতার সক্ষমতা, আর্থিক খাতে অনিয়ম, সুশাসন এবং সু-ব্যবস্থাপনা।
বলা হয়েছে, এসব চ্যালেঞ্জ বা ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। এখানে আন্তর্জাতিকভাবে সমাধানের খুব বেশি সুযোগ নেই। জ্বালানী সমস্যা সমাধানে দেশি-বিদেশী প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে জ্বালানী মূল্য নির্ধারণী নীতিতে সংস্কার করতে হবে। জ্বালানী খাতে কর ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা যেতে পারে। এক্ষেত্রে পরিবেশ রক্ষায় কার্বন ট্যাক্স আরোপের বিষয়টি ভালভাবে ভেবে দেখা যেতে পারে। একদিকে যেমন মূল্য সংস্কার করতে হবে,অন্যদিকে তেমনি পরিবেশের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে এবং আর্ন্তজাতিক বাজারও সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বহি:বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ভাল। রিজার্ভ বাড়ছে। কিন্তু সেই সাথে দেখা দিয়েছে সমস্যাও। বিশেষ কওর রিজার্ভ নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিনিময় হার ভাল অবস্থানে রয়েছে। তবে রফতানি ও রেমিট্যান্স দ্রুত উঠা-নামা করছে। যা আগে কখনও এতটা হয়নি। গত নয় মাসে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ভাল ছিল না। ২ শতাংশ কমে গিয়েছিল। এর কারণ হচ্ছে, স্বাভাবিক শ্রমবাজার ভাল ছিল না। তৈরি পোশাক রফতানির উপর অধিক নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানী বহুমুখীকরণের দিয়ে নজর দিতে হবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ ভাল অবস্থায় নেই। এক্ষেত্রে বিনিয়োগে যেসব বাধা রয়েছে সেগুলো অপসারণে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
ব্যাংক সুদের হারের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, শত কোটি টাকা তারল্য থাকা সত্ত্বেও সুদের হার আরো কমানো সম্ভব। তবে কিছু ইতোমধ্যেই কমানো হয়েছে। তবে গত দশ বছরে দেখা গেছে ব্যাংক সুদের হার ১১ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যেই ছিল। এটি আর্ন্তজাতিক বাজারের তুলনায় একেবারেই কম বা উচ্চ -এটা বলার সুযোগ নেই। বরং বলা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় কম। তবে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার করে ব্যাংক সুদের হার আরো কমানোর সুযোগ রয়েছে।
বলা হয়েছে, সরকারি ব্যাংকে সুশাসন ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ছিল, সেটা এখনো আছে। শেয়ার বাজারের অবস্থা খারাপ, আস্থার সমস্যা ছিল -সেটা এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। মুদ্রানীতির ধারাববাহিকতা বজায় আছে। এর লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। রাজস্ব ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। বার্র্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) বাস্তবায়ন অত্যন্ত ধীর। এক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে -তা ব্যয় হচ্ছে না। আবার যা ব্যয় হচ্ছে, তার গুণগত ব্যয় হচ্ছে না। অর্থাৎ সম্পদ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে না।
‘২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে যেতে পারবে কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়ার পথে রয়েছে। কিন্তু সেটি অর্জন করতে হলে এখন থেকে প্রস্তুতিমূলক ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। দেশি-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন