আজিবুল হক পার্থ : আজ পয়লা মে, মহান মে দিবস। মেহনতি ও শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম আর অধিকার আদায়ের প্রতীকী দিন। দীর্ঘ বঞ্চনার শিকার রক্তঝরা শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে রক্তঝরা সংগ্রামের এক গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টির দিন। এ বছরের শ্লোগান, মে দিবসের মর্মবাণী-শ্রমিক মালিক ঐক্য জানি।
ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকলেও দিনটিতে আজও বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শেষ হয়নি। আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কর্তৃক প্রণীত শ্রম পরিবেশ, শ্রমিকের অধিকার বাস্তবায়ন হয়নি। একদিকে অধিকার বঞ্চিত শ্রমিকদের আন্দোলন অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের দেশ তথা বাংলাদেশের ৯০ ভাগ শ্রমিক জানে না তাদের অধিকার। জানেনা মে দিবসের পটভূমি, কর্মসূচী ও অধিকার।
এদিকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে পালিত হবে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মহান মে দিবস। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলো দিবসটি উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ও বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করছে। এছাড়া বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে র্যালি, আলোচনা সভা, প্রতিবাদ সমাবেশ, সভা, সেমিনার, শ্রমিক সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
দিবসটি উপলক্ষে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া।
বাংলাদেশের শ্রমিকরা মে দিবসের সেই আন্দোলনের ফল এখনো পায়নি। শ্রমিক দিবসের অধিকার আদায়ে রাজপেথ ১৮তম দিনে আমরণ অনশনে আছে বেকার নার্সরা। গার্মেন্টসে এখনো ন্যূনতম মজুরী বাস্তবায়ন হয়নি। বেসরকারি কারখানায় এখনো নিশ্চিত করা যায়নি ৮ ঘণ্টার শ্রম। দেশের প্রায় সকল পর্যায়ের শ্রম পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আন্তর্জাতিক মহলে।
ইতিহাসে মে দিবস : আজ থেকে ১৩০ বছর আগে ১৮৮৬ সালের মে মাসে শ্রমঘণ্টা ৮ ঘন্টা নির্ধারণের দাবিতে আমেরিকার শিকাগো শহরের ‘হে মার্কেটে’ নির্যাতিত শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ জনসভায় মালিক এবং সরকারপক্ষের বর্বরোচিত আক্রমণ, গুলিবর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে ‘মহান মে দিবস’-এর সূচনা হয়। সেই দিন মালিক ও সরকার শ্রেণীর নির্দেশে গুলি চালালে জীবন দেয় ১০ শ্রমিক। আর রক্ত ঝরে অসংখ্য শ্রমিকের। এতেও জনতার জোয়ার থামিয়ে দিতে পারেনি শোষকশ্রেণী। ১ মে শুরু হওয়া শ্রমিকদের এ আন্দোলন অব্যাহত ছিল আরও কয়েকদিন। অব্যাহত থাকে ধর্মঘটও। ৩ মে একটি ফসল কাটার কারখানার সামনে শ্রমিক সভায় পুলিশের নির্বিচার গুলিতে প্রাণ হারায় আরও ৬ শ্রমিক। হত্যার প্রতিবাদে ৪ মে হে মার্কেট স্কয়ারে স্মরণাতীতকালের বৃহত্তম শ্রমিক সমাবেশে আবারও বর্বরোচিত হামলা চালায় পুলিশ। প্রাণ হারায় আরও ৪ শ্রমিক। পরে ৬ অক্টোবর মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত চার শ্রমিক নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। গড়ে ওঠে শ্রমিক-জনতার বৃহত্তর ঐক্য। অবশেষে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। তিন বছরের মাথায় ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগো ট্র্যাজেডিকে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করার ঘোষণা দেয়া হয়। সেই থেকে আজ অবধি শ্রমিকের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের সংগ্রামী চেতনার অমিত তেজ সঞ্চারের দিন হিসেবে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হতে শুরু করে মে দিবস নামে।
মে দিবসের নানা কর্মসূচি : প্রতিবছরের ন্যায় এবারও ঐতিহাসিক ঘটনাসমৃদ্ধ মহান মে দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন উপলক্ষে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় দু’দিনব্যাপী (১ ও ৪ মে) কর্মসূচি গ্রহণ করছে। কর্মসূচীগুলোর মধ্যে রয়েছে মে দিবসের র্যালি, উদ্বোধন ও সাংস্কৃতিক অন্ষ্ঠুান ও সেমিনার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত মে দিবসের সকল কর্মসূচীর উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার সরাসরি সম্প্রচার করবে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হবে। এর আগে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক র্যালির নেতৃত্ব দিবেন।
জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত কর্মসূচীর আলোকে জেলা পর্যায়েও মহান মে দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে শ্রম ভবন, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র ও রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক দ্বীপ ব্যানার, ফেস্টুন ও প্লা-কার্ড দ্বারা সজ্জিত করা হবে। এছাড়া বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষে জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শ্রমিক সমাবেশ করবে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এতে বক্তব্য রাখবেন। এছাড়াও জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, বাংলাদেশ গার্মেন্টস মজদুর ইউনিয়ন, ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ, রিক্সা-ভ্যান শ্রমিক লীগ, গার্মেন্টস কর্মচারী লীগ, শ্রমিক ঐক্য, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি, শ্রমিক-কর্মচারী পরিষদ, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ, সিটিজেন এনভায়রনমেন্ট ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি, জাগো গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনসহ পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন পৃথকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে র্যালি, গণসঙ্গীত, মিছিল, আলোচনা সভা, প্রতিবাদ সমাবেশ, সভা, সেমিনার, শ্রমিক সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক মে দিবসের বিশেষ নিবন্ধ ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতার বাংলাদেশসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন ও বেতার বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে।
প্রেসিডেন্টের বাণী:
প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, বর্তমান সরকার শ্রমিকদের কল্যাণে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্ব পরিবর্তনশীল এবং তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পরিবর্তনশীল বিশ্বে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে উন্নত কর্মপরিবেশ, শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক, শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করণসহ বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদন করার কোন বিকল্প নেই। এ জন্য শ্রমিকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ন্যায্য মজুরি, শ্রমিকদের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করা খুবই জরুরি বলে তিনি বাণীতে উল্লেখ করেন। তিনি মে দিবসে বিশ্বের সকল মেহনতি মানুষকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।
প্রধানমন্ত্রীর বাণীঃ
মহান মে দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল মেহনতি মানুষের সাথে একাত্মতা ঘোষণা এবং তাঁদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। পাশপাশি দিবসটি উপলক্ষে গৃহীত সকল কর্মসূচির সার্বিক সাফল্য কামনা করেন।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে বন্ধ হয়ে যাওয়া কলকারখানা চালু করেছে। পোশাক শিল্পসহ ৩৮টি শিল্পখাতের শ্রমিকদের জন্য নিম্নতর মজুরি ঘোষণা করেছে। জাতীয় শিশু শ্রমনীতি ২০১০ এবং জাতীয় শ্রমনীতি ২০১২ প্রণয়ন করেছে।
বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বাণী:
বিএনপি’র চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, মহান মে দিবস ঐতিহাসিকভাবে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। শ্রমজীবী মানুষের রক্তঝরা ঘামেই বিশ্ব সভ্যতার বিকাশ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। শ্রমিকের ঐতিহাসিক অবদানের ফলেই বিশ্ব অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। অথচ গভীর পরিতাপের বিষয় আজও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নিপীড়িত শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোনো গণতন্ত্র নেই। দেশে গণতন্ত্র এখন নির্বাসিত, গণতান্ত্রিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। কাজেই কোনো শ্রেণী-পেশার মানুষের অধিকারই আজ আর নিশ্চিত নয়। এই অবস্থার অবসান করে সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অংশ নেয়ার জন্য মে দিবসে তিনি শ্রমজীবী ভাই-বোনদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন