স্টালিন সরকার : বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন নিয়ে ঘটে গেল মহাকা-। এ যেন নাটক-সিনেমার দৃশ্য। দেশে রাজা-বাদশা-ধনী-গরিব সবাই সমান। বৈশাখের দাবদাহ। তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রিতে উঠানামা করছে। গরমে জনজীবন ওষ্ঠাগত। প্রখর রোদে ফার্মগেটে শত শত মানুষের লাইনে দাঁড়ালেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। রোদে পুড়ে নিজের সিম নিবন্ধন করলেন! মিডিয়ায় সচিত্র সে খবর প্রচার করা হলো। নাটক-সিনেমার এ দৃশ্য বাস্তবেও ঘটে গেল। একসময়ের নাটকের নামকরা নায়িকা তারানা হালিম ঝানু অভিনেত্রীর মতোই টিভির নাটক ও সিনেমার দৃশ্যে পোজ দেয়ার মতোই ঘটনা ঘটালেন প্রতিমন্ত্রী হয়েই। তার কঠোর বার্তা Ñ ৩০ এপ্রিলের মধ্যেই নিবন্ধন না করা হলে সব সিম/রিম বন্ধ করে দেয়া হবে। প্রতিমন্ত্রীর হুঁশিয়ারিতে গ্রাহকরা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সিম রক্ষায় নিবন্ধনে হয়ে ওঠেন মরিয়া। এ সুযোগে মুঠোফোন অপারেটর গ্রাহক সেবা কেন্দ্রে ‘সেবার নামে’ গ্রাহকের পকেট কাটলেন; কোটি কোটি টাকা মুনাফা করলেন। প্রতিমন্ত্রী প্রথমে ঘোষণা দিলেন নির্ধারিত সময়ের পর কোনো ক্রমেই সিম নিবন্ধনে সময় বাড়ানো হবে না। নাটক-সিনেমায় নায়ক-নায়িকারা সব সময় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ান; সহায়তা করেন। প্রশ্ন হলো নাটক-সিনেমার সফল নায়িকার মতো প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম কি বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের নামে গ্রাহকের পকেট থেকে ‘খোয়া যাওয়া টাকা’ ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেবেন?
৩০ এপ্রিল রাজধানী ঢাকার চিত্র ছিল ভিন্ন রকম। যেখানে-সেখানে দীর্ঘ লাইন। মোবাইল ফোনের সার্ভিস সেন্টারগুলো ছাড়াও রাজধানীর রাজপথ, পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে হাজার হাজার সেবা কেন্দ্র খুলে বসে সিম নিবন্ধন সংশ্লিষ্টরা। প্রতিমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশ; প্রচ- রোদে হুমরি খেয়ে পড়তে বাধ্য হন মোবাইল গ্রাহকরা। নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ সবাই উপস্থিত আঙ্গুলের ছাপ দিতে। আঙ্গুলের ছাপ বাধ্যতামূলক হওয়ায় অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা হাঁটতে পারেন না এমন অসংখ্য রোগীকেও কেন্দ্রে আনা হয় সিম নিবন্ধনে। সর্বত্রই বিশাল লাইন। বন্ধ হওয়ার ভয়ে শত শত মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন সিম নিবন্ধনের জন্য। কখনো সার্ভার স্লো, কখনো সার্ভার নষ্ট, কখনো বিদ্যুৎ বিভ্রাট ইত্যাদি কারণে গ্রাহকের ভোগান্তি পোহাতে হয় দিনভর। প্রতিমন্ত্রীর এক বক্তব্য বার বার টিভিতে দেখানো হয়, ৩০ তারিখের মধ্যেই নিবন্ধন, নয়তো বন্ধ। বিকেলেও তিনি একই কথা বলেন। অথচ সন্ধ্যায় পাল্টে গেল দৃশ্যপট। ড্রামার সাসপেন্সের মতোই ঘোষণা এলো, নিবন্ধনের সময় এক মাস বৃদ্ধি করা হলো। এক মাস সময় যদি বৃদ্ধিই করা হবে, তাহলে লাখ লাখ গ্রাহককে প্রচ- রোদে এত কষ্ট দেয়ার মাজেজা কী? নাটক-সিনেমার দৃশ্যপট আর বাস্তব জীবনের দৃশ্য কি এক?
বায়োমেট্রিক শব্দের অর্থ কী? বায়ো শব্দের অর্থ জীবন, প্রাণ ইত্যাদি। মেট্রিক হলো একটি প্যারামিটার, যা দিয়ে বোঝানো হয় কোনো কিছুর কাজ করার যে বৈশিষ্ট্য দিয়ে সবার থেকে আলাদা বা কর্ম-বিন্যাস। অর্থাৎ বায়োমেট্রিক হলো কোন প্রাণীকে তার যে বৈশিষ্ট্যর জন্য আলাদা করা যায় সেটা। ১৮৯১ সালে আর্জেন্টিনাতে একজন বিজ্ঞানী সন্ত্রাসীদের আঙ্গুলের চাপ ধরে রাখার জন্য একটি যন্ত্র সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেন। তখন থেকেই বায়োমেট্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মানুষ এবং জীবের শরীরের কিছু অঙ্গ থাকে যেগুলো একজনের থেকে অন্যজনের সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন চোখ, ডিএনএ, আঙ্গুলের চাপ ইত্যাদি। নিউ এইজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবির এক টকশোতে জানালেন, পৃথিবীতে মাত্র ৪টি দেশে নাগরিকের বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। দেশগুলো হলো পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইরাক। বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে ওই চার দেশের অবস্থা কোন পর্যায়ে তা সবাই জানে। আমরা কি তাদের দলভুক্ত হতে যাচ্ছি?
সিম নিবন্ধনে গ্রাহক ভোগান্তির সীমা-পরিসীমা নেই। মূল সার্ভিস সেন্টারে বিনে পয়সায় গ্রাহকের সিম নিবন্ধন করেছে। কিন্তু খুচরা নিবন্ধনকারীরা এলাকা এবং গ্রাহক চাহিদার ওপর ভিত্তি করে ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন। সিম নিবন্ধনের নামে গ্রাহকের যে কোটি কোটি টাকা লুট করে নেয়া হলো সে ব্যাপারে প্রতিমন্ত্রী নীরব কেন? সিম নিবন্ধনের সময় শেষ পর্যন্ত এক মাস বাড়ানো হলো, কিন্তু নাগরিকদের এত ভোগান্তিতে ফেলে কষ্ট দেয়া হলো কেন? আগের যুগে স্বৈরাচারী রাজা ও রাজকর্মচারীরা ‘রাজার ক্ষমতা’ প্রজাদের বোঝাতে নানাভাবে নিষ্ঠুরতা করে মানুষকে কষ্ট দিতেন। নানা ফন্দিফিকিরে প্রজাদের দুর্গতিতে ফেলে তা উপভোগ করতেন। সিম নিবন্ধনের নামে ৩০ এপ্রিল সেরকম কি কিছু করা হলো? সিম নিবন্ধন নিয়ে গত কয়েকদিন মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের ম্যাসেজের মাধ্যমে একটি সতর্কবার্তা দেয়া হয় যা চরম বিরক্তিকর। বার্তাটি হলোÑ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আপনার সিম/রিম নিবন্ধন না করলে সংযোগটি বন্ধ হয়ে যাবে। ফ্রি নিবন্ধন সম্পন্ন করতে আজই আপনার সিম/রিম এবং এনআইডি নিয়ে রি-রেজিস্ট্রেশন পয়েন্টে আসুন। দিন-রাত একের পর এক দেয়া এই ভয়েস বা এসএমএস গ্রাহকদের কাছে অসহ্য বিরক্তিকর। বৈশাখের প্রখর রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে যারা সিম নিবন্ধন করতে পারেননি এবং যারা নিবন্ধন করেছেন, তাদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন এক মাস সময় বৃদ্ধি করা হলো অথচ তাদের এত কষ্ট দেয়া হলো কেন?
গুণী শিল্পী তারানা হালিম শো-বিজের মানুষ। টিভি নাটকের সফল নায়িকা। সিনেমায় অভিনয় শৈলীর মাধ্যমে সফলতা দেখিয়েছেন। বর্তমানে বেসরকারি একটি টিভিতে ‘মানুষের জীবনচিত্র’ নিয়ে তিনি যে অনুষ্ঠান করেন তা প্রশংসনীয়। যতদূর জানা যায় গুণী এই শিল্পী সংস্কৃতির অঙ্গনে সক্রিয়; রাজনীতিতে নয়। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতির জোটের নেত্রী হিসেবে তিনি নবম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির প্রার্থী-ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সংরক্ষিত আসনের এমপি করার পর তিনি প্রতিমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। নাটকের নায়িকা থেকে মন্ত্রিত্ব, এটা বিরাট সাফল্য। কিন্তু নাটকের সফল নায়িকার মন্ত্রিত্বের সিদ্ধান্তে কেন এই জনভোগান্তি? ৩০ এপ্রিল প্রখর রোদে ৭-৮ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে যারা সিম নিবন্ধন করতে বাধ্য হয়েছেন; এক মাস সময় বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের ঘোষণা সন্ধ্যায় শুনে তাদের অনেকেই এ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, ‘নাটকের থ্রিল কি বাস্তবে খাটে?’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন