মোবায়েদুর রহমান : সরকারি দলের রাজনীতির পথ যতটা কুসুমাস্তীর্ণ, ততটা পুষ্প বিছানো পথ বাংলাদেশ আমলে তো বটেই, পাকিস্তান আমলেও দেখা যায়নি। সরকারি দল বারবার বলে আসছিল, তারা চায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা। সেই শান্তি ঠিকই নেমে এসেছে। এমন শান্তি যে, সেটিকে কবরের শান্তি বললেও অত্যুক্তি হবে না। রাজনীতির ড্রাইভিং সিটে শাসক দল। সংসদেও তারা, রাজপথেও তারা। সংসদে নামকা ওয়াস্তে একটি বিরোধী দল রয়েছে, যেটিকে মৎস্যকন্যার সাথে তুলনা করা যেতে পারে Ñ ‘অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক মৎস্য।’ এইচ এম এরশাদ বা রওশন এরশাদের জাতীয় পার্টিকে কেউ গণনার মধ্যেই ধরে না। তারা না ঘরকা না ঘাটকা।
জামায়াত ছাড়া অন্যান্য ইসলামী দল
জামায়াতে ইসলামী ছাড়া অন্যান্য যেসব ইসলামী দল রয়েছে তারা সেই পাকিস্তান আমল থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের মধ্যে পড়ে না। তাদেরকে রাজনৈতিক দল না বলে পবিত্র ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত ধর্মীয় সংগঠন হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
বিএনপির হরতাল ও অবরোধ
২০১৫ সালের ৫ই জানুয়ারি থেকে বিএনপি যে হরতাল, অবরোধ ও ঘেরাও রাজনীতি শুরু করেছিল, সরকারের প্রচ- দমননীতির ফলে সেটি ব্যর্থ হয়। ৩ মাসের মাথায় সেই আন্দোলন সম্পূর্ণ মুখ থুবড়ে পড়ে। সেইসাথে কোণঠাসা হয়ে যায় দেশের অন্যতম বৃহৎ দল এবং বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি। বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয় এবং হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কিন্তু গত কয়েক মাস থেকে দেখা যাচ্ছে যে, আওয়ামী সরকার বিএনপির প্রতি তাদের দমননীতি বেশ কিছুটা শিথিল করেছে। বিএনপির সমস্ত বড় নেতা এবং অনেক কর্মীকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সভা করতে দেওয়া হচ্ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে যে, গত ১লা মে তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভাও করতে দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, সরকার জামায়াতে ইসলামী এবং নাগরিক ঐক্যের প্রতি এখনও ততখানি উদারতা দেখায়নি। জামায়াতে ইসলামী বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছিল। কিন্তু সরকারের সাঁড়াশি আক্রমণের ফলে তাদের মাজা ভেঙে গেছে। কবে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে সেটি নিয়ে গুরুতর সন্দেহ রয়েছে। নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না ১৪ মাস হলো বিনা বিচারে কারাগারে আটক রয়েছেন। তারও কারগার থেকে মুক্তির কোনো আলামত চোখে পড়ছে না।
হেফাজতে ইসলাম
ইতিপূর্বে হেফাজতে ইসলাম রাজধানীতে একটি গ্র্যান্ড শো দিয়েছিল। প্রদীপ যেমন দপ করে জ¦লে ওঠে, তেমনি দপ করেই নিভে যায়। কীভাবে হেফাজতে ইসলাম হঠাৎ করে জ¦লে উঠল এবং হঠাৎ করেই নিভে গেল, সেটি ঢাকাবাসী সকলেই দেখেছেন। কারণটি কী? সেটি সকলেই মোটামুটি জানেন। তবে বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থে বিষয়টি কেউ প্রকাশ্যে আলোচনা করেন না। এখন হেফাজতের রাজনীতি নিয়ে বাংলাদেশের বিদগ্ধ মহলে চলছে তুমুল জল্পনাকল্পনা।
আর রয়েছে কয়েকটি বাম দল। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট উভয় মিডিয়াই বামদেরকে নিয়ে যত মাতামাতি করে, বাস্তবে তার এক-চতুর্থাংশও তারা ডিজার্ভ করে না। তবুও বামদের প্রচুর পাবলিসিটি। যারা রাজনীতির সদর অন্দরের খবর রাখেন তারা জানেন যে, মিডিয়ায় বামদের রয়েছে হিউজ ইনফিলট্রেশন। তাই এত পাবলিসিটি। এতক্ষণ ধরে যা কিছু বলা হলো, তার সারসংক্ষেপ এই যে, বাংলাদেশের রাজনীতির এই মুহূর্তে একক চালিকাশক্তি হলো আওয়ামী লীগ এবং সমস্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্ত সমর্থনপুষ্ট আওয়ামী সরকার।
তারপরেও নতুন উদ্বেগ
রাজনীতির ওপর আওয়ামী সরকারের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও এক্সটারনাল ফ্রন্টে সরকারের অবস্থান কিছুটা নাজুক। আমরা যারা সাংবাদিক বা কলামিস্ট তাদের অবস্থান আদার ব্যাপারির চেয়ে কোনো অংশে বেশি নয়। জাহাজের খবর রাখা আর অসাধ্য সাধন করা প্রায় সমার্থক। কিন্তু তবুও দেখা যাচ্ছে যে, আওয়ামী সরকারের সাথে আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশে^র সম্পর্ক তেমন একটা ভালো যাচ্ছে না। বিশেষ করে আমেরিকার সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্কে বেশ কিছুটা টানাপড়েন লক্ষ করা যাচ্ছে। আইএস ইস্যু, জঙ্গি ইস্যু এবং দেশের অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারে এই ২ দেশের অবস্থানে বেশ কিছুটা দূরত্ব লক্ষ করা যাচ্ছে। সাদা চোখে মনে হচ্ছে, দূরত্বটা যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরো মনে হচ্ছে যে, বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন আগ্রহ যেন অতীতের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এদেশে একটা কিছু ঘটলেই মার্কিন সরকারের কিছু কিছু কর্তা ব্যক্তি এদেশে ছুটে আসেন। পর্যবেক্ষক মহল বাংলা-মার্কিন সম্পর্কের গতিধারা সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করছেন।
বাংলা-ভারত সম্পর্ক
নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক মহল আশঙ্কা করছিল যে, কংগ্রেস সরকার আওয়ামী লীগকে যে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিল, মোদি সরকার হয়তো ততখানি অকুণ্ঠ সমর্থন দেবে না। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই, বিশেষ করে সাম্প্রতিক দু-এক মাসে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আওয়ামী সরকারের ওপর বিজেপি সরকারের সমর্থন কংগ্রেসের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
হেফাজত ও জামায়াত
রাজনীতির এই গতিধারার মাঝে দু-একটি ঘটনা অতি সন্তর্পণে ঘটে গেছে। বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক যতখানি সুদৃঢ় এবং মজবুত ছিল, বর্তমানে মনে হচ্ছে ততখানি সুদৃঢ় এবং মজবুত নেই। দেশের প্রধান দুটি বিরোধী দলের মধ্যে ইতোমধ্যেই দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে এবং দিন দিন সেই দূরত্ব বাড়ছে। চিত্রের অপর পিঠ সম্পূর্ণ বিপরীত। বিএনপির সাথে জামায়াতের দূরত্ব যত বাড়ছে সরকারের সাথে হেফাজতের দূরত্ব তত কমছে।
আদর্শগত পরিবর্তনের ছোঁয়া
মনে হচ্ছে রাজনীতিতে খুব সন্তর্পণে আদর্শগত পরিবর্তন ঘটছে। বিএনপি এতদিন জামায়াতে ইসলামীর কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সম্পূর্ণ নীরবতা বজায় রেখেছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, তারা শুধু জামায়াতের ইস্যুতেই নয়, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ইস্যুতেও নীরবতা অবলম্বন করছে। পাঠ্যপুস্তকে মুসলমানী ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পর্যায়ক্রমিক অপসারণ এবং হিন্দু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পর্যায়ক্রমিক অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে বিএনপির নীরবতা সচেতন মানুষের চোখ এড়ায়নি।
আগামী কয়েক মাসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরো কিছু গুণগত ও আদর্শগত পরিবর্তন ঘটার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন সচেতন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকগণ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন