শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

আখের গুড়ের মিষ্টি গন্ধে বিমোহিত

মুন্সী কামাল আতাতুর্ক মিসেল, পাঁচথুবী (কুমিল্লা) থেকে ফিরে : | প্রকাশের সময় : ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

শীত এলেই শুরু হয় পিঠা-পুলির উৎসব। শুরু হয় আখের রস থেকে গুড় তৈরি। ইতোমধ্যেই গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন চাষিরা। গোমতীর তীরবর্তী পাঁচথুবী গ্রাম। আখের গুড় ও আধরসি তৈরির গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এ গ্রামের তৈরী গুড়-আধরসি গুণেমানে প্রসিদ্ধ।
শহুরে যান্ত্রিক কোলাহলের বাইরে এ গ্রামে ঢুকেই গুড় তৈরির মিষ্টি গন্ধ বিমোহিত করবে যে কাউকে। স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, পাঁচথুবী গ্রামের প্রায় ২২টি পরিবার আখের গুড় ও আধরসি তৈরি পেশায় জড়িত। এদের মধ্যে অন্যতম আব্দুল্লাহ মিয়ার ছেলে শাহজাহান (৫৫)। ১৫ বছর ধরে আখ চাষ ও গুড়-আধরসি তৈরি পেশায় নিয়োজিত। এখন সে স্বাবলম্বী। গ্রামের অন্যান্য লোকরাও এ পেশায় আসছেন।
শাহজাহান জানান, ২০০৬ সালে ৩ কানি জমিতে প্রতি চারা ১ টাকা দরে ক্রয় করে ২০ হাজার চারা রোপন করি। খরচ হয় ৪০ হাজার টাকা। এই আখ চাষ মূলত শীতকালে করলে ভালো হয়। ফলনের প্রথম ২/৩ বছর উৎপাদিত আখের রস থেকে ১২০ থেকে ১৫০ মণ করে আখের গুড় পাওয়া যায়। পরের বছরগুলো থেকে ৮০ থেকে ৯০ মণ করে গুড় পাওয়া যায়। তাছাড়া রস থেকে প্রত্যেক বছর প্রায় ১০০ মণ আধরসি পাওয়া যায়। ফলনের প্রথম ২/৩ বছর ভালো ফলন হয়। পরবর্তী ৩/৪ বছর ফলন একটু কমে আসে। তবে আয় ভালো হয়। কারণ একবার ফলন করলেই হয়, প্রতিবছরতো আর চারা রোপন করা লাগেনা। একবছর রোপন করলে ৬/৭ বছর ফসল পাওয়া যায়।
আখচাষিরা জানান, প্রথম বছর ফসল কাটার পর পুরো জমিতে আগুন লাগিয়ে আর্বজনাগুলো পুড়ে ফেলা হয়। তারপর পুরো জমিতে গোবর, পটাশ, ফসফেট ছিটিয়ে দিয়ে আঁখ কাটার পর অবশিষ্ট যে গোড়া অর্থাৎ মূল থাকে সেখান থেকে এক থেকে দেড় সপ্তাহের মধ্যে চাঁরা গজাবে। তারপর চারার গোড়াগুলো পরিষ্কার করে সেখানে মাটি দিতে হবে। তারপর এক বছরের মধ্যে ফসল কাটার উপযুক্ত হয়।
পরিণত আখ কাটার পর তা কেটে পুলিতে (চাঁকা) ঢুকিয়ে রস বের করা হয়। তারপর রস কাসার ট্রেতে করে সাড়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পর্যন্ত আগুনের বড় চুলাতে জাল দেয়া হয়। চুলা থেকে নামিয়ে ১০ মিনিট রাখার পর শক্ত হয়ে যায়, তখন মাটির পাতিলে রাখা হয়। এভাবে তৈরি করা গুড়। আর আখের রস কাসার ট্রেতে বা কড়াইতে করে আগুনের বড় চুলাতে জাল দেয়ার ১/২ ঘণ্টা পরে বাদামি রংয়ের এক ধরণের ফেনা বের হয়, একে নোনা বলে। এটা খেতে দারুণ সুস্বাদু। আধরসিও তৈরি করা হয় প্রায় একই নিয়মে।
প্রত্যেক বছর শীতে আখ কাটার সময় নাটোর থেকে শ্রমিক (কারিগর) আনা হয় পাঁচথুবীতে। যারা ফসল কাটা থেকে শুরু করে আখের গুড়, আধরসি ও নোনা তৈরি করা পর্যন্ত প্রায় ১ মাস কুমিল্লায় থাকে। পাঁচথুবী গ্রামের আখের ক্ষেতে কথা হয় নাটোরের শ্রমিকদের সাথে। নাটোরের বাগাতিপাড়া থানার গৌরিপুর গ্রামের কারিগর মো. জাকারিয়া হোসেন জানালেন, ফসল কাটা থেকে শুরু করে গুড় ও আধরসি তৈরি পর্যন্ত প্রায় ২০/২৫ দিন এখানে থাকতে হয়। প্রতিদিন পারিশ্রমিক হিসেবে ২৫০- ৩০০ টাকা করে পান তারা। প্রতি বছরের মতো এবারও এসেছেন এখানে।
কুমিল্লার বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা এই এলাকা থেকে এসে পাইকারি দরে গুড় ও আধরসি ক্রয় করে নিয়ে যায়। পাঁচথুবী গ্রামের গুড় ও আধরসি তৈরি কারখানার মালিক শাহজাহান বলেন, ১ কেজি গুড় ৮০ টাকা, ১ কেজি আধরসি ৮০ টাকা এবং নোনা ৩০০ টাকা কেজি পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রয় করা হয়। এখানকার তৈরি গুড় ও আধরসি কুমিল্লা মহানগরের চকবাজার, রাজগঞ্জ, বাদশাহমিয়ার বাজার, রাণীরবাজার, বুড়িচংয়ের শিবেরবাজার, সদরের সুর্বণপুর বাজারে বিক্রি হয়। পাঁচথুবী গ্রামের শাহ ইমরান বলেন, এ গ্রামটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় এখানকার গুড় ও আধরসি ভারতেও চোরাইপথে নিয়ে যায় ব্যবসায়ীরা। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ শীতকালে এ গ্রামে আসেন গুড় ও আধরসির জন্য।
এলাকাবাসীরা জানান, এখানকার চাষীরা ৩/৪ কানিতে আখ চাষ করে। এতে খরচ হয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা। প্রতিবছর প্রায় আখের রস থেকে সর্বনিম্ন ২০০ মণ গুড় ও আধরসি তৈরি হয়। এগুলো পাইকারি দরে বিক্রি করে প্রায় ৬ লাখ টাকা পাওয়া যায়। শ্রমিক ও যন্ত্রপাতিতে খরচ হয় সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা। ফলে প্রতিবছরে লাভ হয় সাড়ে ৫ লাখ টাকা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন