মহান আল্লাহ একমাত্র মানুষকেই স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের স্বাধীন বিচরণ ক্ষেত্রে হিসেবে সৃষ্টি করেছেন বিশাল পৃথিবী। আর পরাধীনতা মানব জীবনের সবচেয়ে বড় বঞ্চনার নাম। স্বাধীনতা ছাড়া ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও পালন কোনটাই যথার্তভাবে সম্ভব নয়। সকল নবীদের প্রধান দায়িত্ব ও মিশন ছিল আল্লাহর দীনের বিজয় অর্জন করে স্বাধীনভাবে আল্লাহর ইবাদাত করার পরিবেশ সৃষ্টি করা। কোরআনের ভাষায়, ‘মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য ধর্ম ইসলামসহ পাঠিয়েছেন। যাতে এই দীন ইসলামকে অন্য সব ধর্মের ওপর বিজয়ী করতে পারেন। (সূরা ফাতাহ : ২৮)।
দীন ইসলামকে বিজয়ী করার সংগ্রামে নবীগণ জীবন বাজি রেখেছেন। হজরত মূসা (আ.) কেও ফেরাউনের কবল থেকে বনি ইসরাইলকে মুক্ত করে স্বাধীন ভুখন্ডে স্বাধীনভাবে আল্লাহর দাসত্ব করার দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। কোরআনের ভায়ায়, ‘মূসা বলল, হে ফেরাউন! আমি বিশ্ব পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত রাসূল। অল্লাহর পক্ষ থেকে যে সত্য এসেছে, তার ব্যতিক্রম কিছু না বলার ব্যাপারে আমি সুদৃঢ়। আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমান নিয়ে এসেছি। সুতরাং তুমি বনি ইসরাইলকে মুক্ত করে আমার সাথে পাঠিয়ে দাও। (সূরা আরাফ : ১০৪-১০৫) সে কারণেই হজরত মুসা (আ.) জন্মভূমি মিশর ছেড়ে একটি স্বাধীন ভূখন্ডের সন্ধানে লহিত সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন। মূসা (আ.)-এর বিজয়ের ইতিহাস প্রসংগে কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘যখন মূসা (আ.) স্বজাতিকে বললেনঃ তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর যখন তিনি তোমাদেরকে ফেরাউনের সম্প্রদায়ের কবল থেকে স্বাধীন করেছেন। তারা তোমাদেরকে অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধরনের শাস্তি দিত, তোমাদের ছেলেদেরকে হত্যা করত এবং তোমাদের মেয়েদেরকে জীবিত রাখত। এবং এতে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে বিরাট পরীক্ষা হয়েছিল। যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর।’ (স‚রা ইবরাহিম : ৬-৭) এখানে মুক্তি ও বিজয় লাভের পর হযরত মূসা (আ.) স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এ বিজয় বা মুক্তি মহান আল্লাহর দান এবং এর জন্য উচিৎ তার প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করা। আর এ জন্য হজরত মূসা (আ.) বিজয় দিবসে (১০ মুহাররাম) কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রোজা পালন করেছিলেন।
সঠিকভাবে এবং স্বাধীনভাবে আল্লাহর গোলামী করতে হলে মানুষের জন্য দরকার একটি স্বাধীন ভূখন্ডের। এজন্য বিশ্ব নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় গিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
মক্কা বিজয়ের ঐতিহাসিক ভাষণে তার অভিব্যক্তি ছিল এমন- ‘সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর যিনি তাঁর প্রতিশ্রুতিকে (বিজয়) সত্যে পরিণত করেছেন এবং আপন বান্দাকে বিজয়ী করেছেন। এবং শত্রু পক্ষকে করেছেন পরাজিত।’ (বুখারী : ১৭০৩)। এখানে নিজেদের পরিকল্পনা ও বাহিনীকে কৃতিত্ব না দিয়ে বিজয়ের পুরো কৃতিত্ব দেয়া হয়েছে আল্লাহ তায়ালাকে। তাই মহানবী (সা.) মক্কা বিজয়ের শুকরিয়া আদায় করেছেন ৮ রাকাত নামায আদায়ের মাধ্যমে।
একটি বিজয়ী ও স্বাধীন জাতির দায়িত্ব কি হবে সে সম্পর্কে কোরআনে রয়েছে স্পষ্ট নির্দেশনা। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে।’ (সূরা হাজ : ৪১) এখানে আল্লাহ তায়ালা স্বাধীনতা অর্জনকারী একটি বিজয়ী মুসলিম জনগোষ্ঠির দায়িত¦ ও কর্তব্যের কথা তুলে ধরেছেন। মুসলমাদের স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জিত হলে তারা সামাজিক জীবনে দুর্নিতি-দুস্কৃৃতি, নাশকতা ও অরাজকতা সৃষ্টির পরিবর্তে নামায কায়েম করবে। তারা ক্ষুধা দারিদ্র মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় যাকাত প্রদান করবে। প্রশাসনিক ক্ষমতার মাধ্যমে সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সৎকাজের নির্দেশ প্রদান করার পাশাপাশি অসৎকাজের মূলৎপাটন করবে। স্বাধীনতা ও বিজয়ের জন্য বেশি বেশি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা সকল মোমিনের ঈমানি দায়িত্ব। কোরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরাটি বিজয় লাভের পর করণীয় ও বিজয় উদযাপনের পন্থা ও পদ্ধতি সম্পর্কে নাজিল হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে দেখবেন, তখন আপনার পালনকর্তার পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাকারী (সূরা নাসর : ১-৩) সুতরাং বিজয় লাভের পর বেশি করে আল্লাহর শুকরিয়া এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা কোরআনের বিধান। বিজয়ের দিনে ইসলামের শিক্ষা হল বিনীত হওয়া, উদ্ধত না হওয়া, অহংকারী না হওয়া, জালিম না হওয়া এবং আচারণে সীমালংঘনকারী না হওয়া। বিজয়ের দিনে ক্ষমতা থাকা সত্তে¡ও প্রতিশোধ না নেওয়া এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা। মক্কা বিজয়ের পর রাস‚ল (সা.) তাই করেছিলেন। মক্কা বিজয়ের দিন রাস‚ল (সা.) এর সামনে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে ছিল মক্কার অপরাধীরা। আর রাস‚ল (সা.) এর যে কোন নির্দেশ পালনের অপেক্ষায় ছিল ১০ হাজার সশস্ত্র মুসলিম যোদ্ধরা। যদি রাস‚ল (স.) বলতেন; ‘যে হাত মুমলমানদের উপর নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে, সে হাত গুলো কেটে ফেলো! যারা মুসলমানদের হত্যা করেছে তাদের মস্তক উড়িয়ে দাও!’ তাহলে মক্কাবাসীরা অবাক হতনা। কিন্তু রাসূল (সা.) এমন কোন কিছুই বললেন না। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘হে কুরাইশগণ! তোমরা আমার কাছ থেকে আজ কেমন ব্যবহার আশ কর?’ তারা বলল, সম্মানিত ভাই ভ্রাতুষ্পুত্রের মত! তিনি বললেন, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই, তোমরা সবাই মুক্ত!’ এভাবে বিজয়ের দিন অপরাধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন