বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ইসলাম মানুষকে বিনয়ী বানায়

প্রকাশের সময় : ৮ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ আলতাফ হোসেন হৃদয় খান

ছোটবেলা থেকে মুরব্বি ও গুণি মানুষদের বিনয় ও ভদ্রতার উপদেশ অনুযায়ী চলছি আমরা। রাস্তাঘাটে চলার পথে লেখা থাকে- ব্যবহারে বংশের পরিচয়। তবুও অশান্ত এই পৃথিবী। চারদিকে মানুষে মানুষে হানাহানিতে পাল্টে যাচ্ছে ব্যবহারের পরিচয়। প্রযুক্তির বদৌলতে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। সেই সঙ্গে হারিয়েছিও অনেক মূল্যবান কিছু। যান্ত্রিক জীবনে আমাদের মধ্য থেকে দিন দিন বিনয় ও হাসি মুখের সরল সম্ভাষণ হারিয়ে যাচ্ছে। নিতান্ত পরিচিত কিংবা বন্ধুবান্ধব ছাড়া আমরা কারো সাথে হাসি মুখে কথা বলতে নারাজ। নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে বিনয় ও সরলতা দুর্লভ হয়ে উঠেছে। আত্ম অহমিকা আর অহঙ্কারের সঙ্কীর্ণতায় আবদ্ধ আমরা। অন্যের কাছ থেকে সত্য মেনে নেয়াকে পরাজয় ধরা হয়। যার গলা যত উঁচু সে তত প্রকৃত বীর। ভুলে বসেছি মুসলমান হিসেবে আমাদের এ রকম আচরণ হতে পারে না।
স্বার্থবিহীন উদার ও লৌকিকতামুক্ত অকৃত্রিম বিনয় এবং সবার সঙ্গে মার্জিত ব্যবহার ইসলামের প্রথম শিক্ষা। কারণ এমন গুণাবলী দিয়েই তো আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন প্রথমে তাঁর পাঠানো নবীদের সুশোভিত করেছেন। তারপর দায়িত্ব দিয়েছেন নবুওয়াতের। তারপর মানুষকে ধর্মের প্রতি কাছে টানার জন্য নবীদের হতে বলেছেন সরল ও সহজ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আল্লাহ্পাক বলেছেন, আপনি আপনার অনুসারী মুমিনদের জন্য নিজেকে কোমল করে রাখুন (সূরা : শুয়ারা-২১৫)। আরেক আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, ‘আপনি যদি কঠোর হতেন তবে মানুষ আপনার কাছ থেকে দূরে সরে থাকত। আপনি তাদের ক্ষমা করতে থাকুন, তাদের জন্য মাগফিরাত প্রার্থনা করুন এবং তাদের নিয়ে পরামর্শ করুন (সূরা আলে ইমরান-১৫৯)। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার প্রিয় মানুষটিকে শেখাচ্ছেন কীভাবে সমাজে সবার সঙ্গে তিনি মেলামেশা করবেন। সর্বময় গুণের অধিকারী ও সর্বশেষ প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে শেখানোর মাধ্যমে বরং তিনি আমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন। বিনয়ের আসল অর্থ সত্যকে দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেয়া, হোক তা যে কারও কাছ থেকে। এর আর একটি অর্থ নিজেকে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে না করা।
প্রখ্যাত মনীষী হাসান বসরী বলেছেন, নিজের ঘর থেকে বের হওয়ার পর যে কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে তাকে নিজের চেয়ে ভালো মনে করার নাম বিনয়। মুসলিম শরীফে ইয়ায (রা.) বর্ণনা করেছেন, একদিন রাসূল আমাদের বললেন, আল্লাহপাক আমাদের কাছে নির্দেশনা পাঠিয়েছেন যাতে আমরা বিনয়ী হই। একে অন্যের ওপর গর্ব করবে না এবং রাগও হবে না। হযরত ঈসা (আঃ) বলতেন পৃথিবীতে যারা বিনয়ী থাকবে কিয়ামতের দিন তাদের আনন্দ! তারা সে দিন আসনে বসে থাকবেন। যারা আজ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলিয়ে মিলিয়ে দেয়, তারাই তো সর্বোচ্চ জান্নাত ফিরদাউসের প্রকৃত অধিকারী।
এ পৃথিবীতে আমরা কি নিয়ে বড়াই করি? সামান্য বিত্তবৈভবে আমরা অন্যকে তুচ্ছ করি। আমরা ভুলে থাকি আমাদের ওপর রয়েছে এক মহান স্রষ্টা। তিনি সব কিছ দেখছেন হিসাবের খাতায় লিখে রাখা হচ্ছে। পরম শক্তিমান আল্লাহর বড়ত্ব এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব যার হৃদয়ে থাকে সে জন নিজেকে লুকিয়ে রাখতে বেশি ভালোবাসে। মানুষের সঙ্গে তার আচরণ বিনয় নম্রতায় মিশে থাকে। মুসনাদে আহমদে এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ্ পাকের জন্য যে বেশি নিচু হবে (এই বলে রাসূল নিজের হাতকে মাটির দিকে নামিয়ে দেখালেন), নিজেকে বিনয়ী করে রাখবে, আল্লাহ্পাক তাকে উঁচু করবেন (রাসূল তা হাতের ওপরের দিকে উঠিয়ে দেখালেন)। অর্থাৎ আল্লাহ্ তাকে মানুষের কাছে সম্মানিত করবেন।
মুসলিম শরীফের আর একটি হাদিসে রাসূল (সা.) দান-সদকায় কখনও সম্পদ কমে না। ক্ষমা ও করুণায় ওই লোকটির সম্মান বাড়িয়ে দেন এবং যে আল্লাহর জন্য বিনয় দেখায় আল্লাহ্ তাকে উঁচুতে অবস্থান করে দেন। এমন বান্দার প্রশংসা করতে যেয়ে নিজের বান্দা বলে পরিচয় দিয়েছেন। আর বিশ্বাসী বান্দারাতো নম্র হয়ে হাঁটাচলা করে এবং কোন মূর্খের সাথে দেখা হলে সালাম দিয়ে চলে যায় (সূরা : ফুরকান-৬৩) এখানে বাগি¦ত-া কিংবা কারও সঙ্গে রেগে যাওয়া তাদের স্বভাব নয়। অন্যত্র তিনি বলেছেন, এই পরকাল তাদের জন্য তৈরি করে রেখেছি যারা পৃথিবীতে সম্মানের প্রার্থী হত না। তারা সেখানে হাঙ্গামায় লিপ্ত হতো না। মুত্তাকিদের জন্য তো শুভ পরিণাম (সূরা কাসাস-৮৩)।
ইবনে মাজা শরীফ থেকে বর্ণিত হাদিসে দেখা যায়, রাসূল (সা.)-এর সামনে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছিল এক গ্রাম্য বেদুঈন। সে ভাবছিল কত বড় রাসূল এবং কত প্রতাপশালী শাসক তিনি।
প্রিয়তম নবী তাকে অভয় দান করে বললেন, তুমি শান্ত হও। আমি কুরাইশ বংশের এক সাধারণ মহিলার সন্তান, যে মহিলা রোদে শুকানো গোশ্ত খেয়ে জীবন কাটাতেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে রাসূল (সা.) আরো বলেছেন, আমি কি তোমাদের জানিয়ে দিব কারা জান্নাতের অধিবাসী? যারা দুর্বল এবং যাদের দুর্বল ভাবা হতো।
অথচ তারা যদি আল্লাহর নামে শপথ করে, অবশ্যই তিনি তা পূরণ করে দেন। তিরমিজি শরীফে বর্ণিত আছে রাসূল (সা.) সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, মৃত্যুকালে যে মুসলমান অহঙ্কার, উগ্রতা, বাড়াবাড়ি ও ঋণ থেকে মুক্ত সে জান্নাতে যাবে। ধরাধামের বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন আমাদের নবী। এমন সম্মানিত মানুষ হয়েও কি অসাধারণ বিনয় ও ঔদার্যের মায়াজালে তিনি পথ ভোলা মানুষকে কাছে টেনেছেন। কোন মহিলা ভরা মজলিসে তাকে ডাকলে তিনি চলে যেতেন। তার প্রয়োজনের কথা শুনতেন। মদিনায় কারো অসুস্থতা কিংবা মৃত্যুর সংবাদ শুনলে ছুটে যেতেন। সান্ত¡না দিতেন। নিজের হাতে ঘরের কাজকর্ম করতেন। স্ত্রীদের সংসারে সাহায্য করতেন। তার কোমলতার কথা লিখে শেষ করা যাবে না। আমাদের সমাজে বাড়ছে অস্থিরতা। কারও জন্য আমরা ধৈর্য ধরতে রাজি নই। আমরা অনেক কিছু হতে শিখেছি কিন্তু মানুষ হওয়ার দীক্ষা নেইনি আজও। মদিনার নবী মুহাম্মদ (সা.) ছাড়া আর কে পেরেছে নিজেকে বিলিয়ে মানুষকে ভালোবাসা শেখাতে? তিনিতো প্রথম বলেছিলেন আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের প্রথম সোপান এ বিনয় ও নম্রতা। আর অহঙ্কার ও উগ্রতায় তিনি রাগান্বিত হন। আমাদের জীবন তখন হয়ে উঠে অস্থির।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এমন কোন বিষয় নেই যা ইসলাম ধর্মে আলোচিত হয়নি। সমাজে নিয়ম-শৃঙ্খলা, প্রেম-প্রীতি ও শ্রদ্ধা সম্মানের মহত গুণে শান্তি নেমে আসে। এ ক্ষেত্রে সমাজ জীবনে চরিত্র গঠনের জন্য ইসলাম যে ভূমিকা পালন করে, তা দিয়ে কোনো জাতি বা কওম নিজেদের আত্মশুদ্ধি করতে পারে। কেননা, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন ও সামাজিক বন্ধন বজায় রাখার নীতি ইসলামের মৌলিক বৈশিষ্ট্য এবং পবিত্র কোরআন-হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, ইসলাম ব্যক্তি চরিত্রের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে তা হলো আখলাক বা চারিত্রিক আদর্শ। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের উৎকর্ষের জন্য নৈতিক আদর্শবোধ হলো নির্মল চরিত্রের মূল উৎস।
কোনো জাতি বা সমাজ যতক্ষণ পর্যন্ত এ নৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে নিজেদের সামাজিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলবে, তারা কখনো ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে না। আমরা সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করি। সমাজই আমাদের জীবনের প্রথম বিচরণ ক্ষেত্র। ইসলামী সমাজ গঠনে ব্যক্তি সৎ আচরণ, সৎ চরিত্র, সৎস্বভাব এবং নম্রতা, কোমলতা ও সৌজন্যবোধের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। জীবনের প্রকৃত বিকাশ সমাজ সংগঠনের মাধ্যমে প্রথম প্রকাশিত হয়। ব্যক্তির সামাজিক সম্পর্ক ও আচরণ যত উন্নত হবে, সামাজিক। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (সা.) মদিনায় হিযরত করে ইহুদি নাসারাদের সাথে যে চুক্তি করলেন, তা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান। ‘মদিনা সনদ’ নামে খ্যাত এ সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ‘প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। ধর্মীয় ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ করা যাবে না।
অপরাধের জন্য ব্যক্তি দায়ী হবে, সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন