মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
॥ এক ॥
জন্মের পর প্রত্যেক মানব শিশুরই নামকরণ করা হয়। প্রত্যেক পিতা-মাতাই চান তার সন্তানের সুন্দর নাম হোক, সবাই তার সন্তানকে ভাল নামে ডাকুক। এমনকি ব্যক্তি নিজেরও তার নাম সুন্দর হোক তা চান। একজন মুসলিমের সর্বোত্তম নাম কি হবে, কোন ধরনের নাম প্রশংসনীয়, কোন ধরনের নাম বৈধ বা অপছন্দনীয়, ইসলাম এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের পর থেকে মুসলিমদের মধ্যে নামকরণের ইসলামী নীতি অনূসৃত হয়ে আসছে। মুসলিম সংস্কারক, আলিম-ওলামা এ ব্যাপারে মুসলিমদের সংস্কার করে আসছেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় মুসলিমদের মধ্যে যা অনুশীলিত হয়ে আসছিল, বর্তমানে ইসলামী রীতিনীতি সম্পর্কে অজ্ঞতা, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব, আধুনিকতার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক বা অতি বাঙালি সাজার প্রবণতার কারণে অনেকাংশে এর অনুশীলনের ব্যাপারে শিথিলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আলোচ্য প্রবন্ধে এ বিষয়টির অনুশীলনের ধারা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়ার মাধ্যমে এর কারণ ও উত্তরণের উপায় অনুসন্ধান করার চেষ্টা করা হয়েছে। যার মাধ্যমে একজন মুসলিম তার নামকরণ, নামের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্বোধনের ইসলামী রীতি সম্পর্কে অবগত হবেন এবং স্বীয় সমাজে এ সংক্রান্ত ভুল, বিকৃত অনুশীলনের ধারা থেকে নিজেদের সংশোধনে উদ্যোগী হবেন। এমনকি নিজের আত্মপরিচয় উপলব্ধির মাধ্যমে স্বীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ বজায় রাখতে সচেষ্ট হবেন।
ব্যক্তি বা বস্তুর পরিচয়ের ক্ষেত্রে নাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য যারা বলেন, নাম নয়; বৃক্ষ তার ফলে পরিচয়, তারাও কিন্তু নামহীন মানুষ নন। তাছাড়া ফল দেখার জন্য বৃক্ষের পাশে অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করাও কঠিন। তাই আগে তার নাম জানা দরকার। নাম ছাড়া কোন ব্যক্তি বা বস্তুর পরিচয় দেয়া সম্ভব নয়। তাই মানব সমাজে সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর তার নাম রাখা একটি সর্বজনীন রীতি। এ পৃথিবীতে নামহীন একজন ব্যক্তিও পাওয়া যাবে না। ইসলামের নামের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তার নামের মাধ্যমেই সৃষ্টিজগতের নিজের পরিচয় দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রতি নাযিলকৃত সর্বপ্রথম ওহীতেও তাঁর নামে পড়ার নির্দেশ রয়েছে। ‘আল কোরআন, ৯৬ :১’ অমুসলিম প-িতগণও বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাহিত্যিক ও দার্শনিক ডরষষরধস ঐধুষরঃঃ বলেন, অ হধসব রং ধহপযড়ৎবফ রহ ঃযব ফববঢ় ধনুংং ড়ভ ঃরসব, ধং ষরশব ধ ংঃধৎ ঃরিহশষরহম রহ ঃযব ভরৎসধসবহঃ পড়ষফ, ফরংঃধহঃ, ংরষবহঃ, নঁঃ বঃবৎহধষ ধহফ ংঁনষরসব. ‘‘ডরষষরধস ঐধংষরঃষষ, (১০ অঢ়ৎরষ ১৭৭৮ -১২ ঝবঢ়ঃবসনবৎ ১৮৩০) ঊংংধুং ড়ভ ডরষষরধস ঐধুষরঃঃ: ঝবষবপঃবফ ধহফ ঊফরঃবফ নু ঋৎধহশ ঈধৎৎ, খড়হফড়হ: ঋড়ৎমড়ঃবহ ইড়ড়শং, ১৯৮৯, ঢ়. ১১৮"
এভাবে শিশুসন্তান জন্মগ্রহণের পর তার নামকরণের ক্ষেত্রেও ইসলাম অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলাম সুস্পষ্টভাবে এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিধানাবলী প্রণয়ন করেছে। রাসূল (সা.) নিজেই অনেক সাহাবীর নাম পরিবর্তন করে দিয়েছেন। আবার কোন নাম রাখা যাবে, কিরূপ নাম রাখা যাবে না তা সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। এদেশের মুসলিমগণ ইসলামী নিয়মানুসারে নামকরণের এ বিষয়টি নিজেদের মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে অনুসরণ করে আসছেন। কিন্তু বর্তমানে মুসলিমদের একটি অংশ অজ্ঞতাবশত অথবা বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে ইসলামী রীতি ভুলে বিভিন্ন বিকৃত পদ্ধতির অনুসরণে এ বিষয়টি নিজেদের মধ্যে চর্চা করছে। এ থেকে উত্তরণ প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য।
নামকরণ ঃ নামকরণ শব্দটি বাংলা। শব্দটি ‘নাম’ ধাতু থেকে উদ্ভূত। নাম বলতে বাংলায় আখ্যা, অভিধা, সংজ্ঞা, যে শব্দ দ্বারা কোন বস্তু বা ব্যক্তিকে নির্ধারণ করা যায় ইত্যাদিকে বুঝায়। ‘‘শিবপ্রসন লাহিড়ী সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, ঢাক : বাংলা একাডেমী, ২০১১, পৃ. ৬৭৫’’ ইংরেজীতে শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবে ঘধসব, ধঢ়ঢ়বষষধঃরড়হ, ঢ়বৎংড়হধষ হধসব, ঃরঃষব, ফবংরমহধঃরড়হ, রফবহঃরঃু ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। ‘‘গড়যধসসধফ অষর ধহফ ড়ঃযবৎং, ইধহমষধ অপধফবসু ইধহমধষর-ঊহমষরংয উরপঃরড়হধৎু, উযধশধ:ইধহমষধ, ১৯৯৪, ঢ়. ৩৫৫.’’
আরবীতে শব্দটির প্রতিশব্দ হচ্ছে ইসম। এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে- যা দ্বারা বস্তুকে চেনা যায় অথবা যা দ্বারা বস্তুর ব্যাপারে প্রমাণ পেশ করা হয়। অবশ্য আরবী ব্যাকরণে (নাহু শাস্ত্রে) এর ভিন্ন অর্থও রয়েছে। ‘‘ড. ইব্রাহীম মাদকুর, আল মু’জামুল ওয়াসীত, নয়াদিল্লী : দারুন লি-ইশআ’তে ইসলামিয়া, তা.বি., পৃ. ৪৫২’’ আর নামকরণ বলতে অভিধানে রাখা, সন্তানের নাম রাখা, নবজাত শিশুর একাদশ বা দ্বাদশ দিনে নাম রাখার সংস্কার বিশেষ ইত্যাদি অর্থ করা হয়েছে। শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৭৫-৬৭৬.’’ বিষয়টি দ্বারা একাদশ দিনে নবজাতকের নাম রাখার অনুষ্ঠানের বুঝানো সম্ভবত হিন্দু ধর্মীয় একটি রীতি থেকে প্রচলিত হয়েছে। নামকরণ বলতে হিন্দুদের একটি ধর্মীয় সংস্কারকে বুঝায় অর্থাৎ হিন্দু ধর্মে নবজাতকের নামকরণের অনুষ্ঠান। জন্মের দিন অথবা জন্মের দশম, একাদশ বা দ্বাদশ দিনে পালিত হয়। দশম বা দ্বাদশ দিন হচ্ছে এ কাজের জন্য প্রশস্ত সময়। ‘‘সিরাজুল ইসলাম ও অন্যান্য সম্পাদিত, বাংলাপিডিয়া, ঢাকা : বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১১, খ. ৬, পৃ. ৪১৯’’ ইংরেজীতে এর প্রতিশব্দ ঘধসরহম, ঘধসব মরারহম, ঘড়সবহপষধঃঁৎব ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। ‘‘অপধফবসু গড়যধসসধফ অষর ধহফ ড়ঃযবৎং, রনরফ, ঢ়. ৩৫৫’’ আর আরবীতে তাসমিয়া এর প্রতিশব্দ। এর অর্থ নবজাতক বা কোন বস্তুর চিহ্নসূচক নামকরণ করা। ‘‘ড. ইব্রাহীম মাদকুর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫২’’ যেমন আরবীতে বলা হয় ‘ছাম্মাহু কুন্না’ অর্থাৎ সে তার এরূপ নামকরণ করল। এর সাথে সংশ্লিষ্ট শব্দ তাকনিয়াহ্- উপনাম নির্ধারণ, তালক্বীব- উপাধি প্রদান ইত্যাদিও ব্যবহৃত হয়। আর নবজাতক বলতে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তান বা সদ্যজাত শিশুকে (ঘবনিড়ৎহ নধনু) বুঝায়। ‘‘শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৬১’’ অতএব নবজাতকের নামকরণ বলতে সদ্যজাত শিশুর নাম রাখাকে বুঝায়। ইসলামের নামের গুরুত্ব ঃ ইসলাম ব্যক্তির নামকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। যথার্থ নামকরণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির পরিচয় তুলে ধরার ব্যাপারে ইসলামের দিক নির্দেশনা সুস্পষ্ট। নিম্নে এর কয়েকটি দিক উল্লেখ করা হল-
আল্লাহর নিজের নামকরণ ঃ মহান আল্লাহ তাঁর নিজের পরিচয় দেয়ার জন্য নিজেকে নিজেই নামকরণ করেছেন। তিনি তাঁর অসংখ্য নাম রেখেছেন। আমরা উম্মতে মুহাম্মাদীর নিকট তাঁর নিরানব্বইটি নাম প্রকাশ করা হয়েছে। রাসূল (সা.) তাঁর একটি দু‘আয় এভাবে উল্লেখ করেছেনে যে, ‘হে আল্লাহ... আমি তোমার সকল নামের উসিলায় তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, যে নামে তুমি তোমাকে নামকরণ করেছ...’। ‘‘ইবনু হিব্বান, সহীহ ইবনু হিব্বান, বৈরুত: মুআস্সাসাতুর রিসালাহ, ১৯৯৭, খ. ৩, পৃ.২৫৩; আহমাদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনাদ, কায়রো: দারুল মাআরিফ, ১৯৫৮, খ. ১, পৃ. ৩৯১; মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীছিস সহীহাহ, রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, তা.বি., হাদীস নং -১৯৯’’ অন্য হাদীসে তাঁর নিরানব্বইটি নামের কথাও রাসূল (সা.) বলেছেন। ‘‘ মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল আল-বুখারী, আস্ সহীহ, দেওবন্দ : মাকতাবা আশরাফিয়্যাহ, তা.বি., অধ্যায়: আদ্ দাওয়াত, পরিচ্ছেদ : লিল্লাহি তাআ‘লা মিআতু ইসমিন গাইরু ওয়াহিদিন, খ. ২, হাদীস নং ৬১৬৩;।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন