শফিউল আলম : বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও ভোগ্য পণ্যসামগ্রীর দাম আকাশছোঁয়া। পবিত্র রমজানের আর বাকি আছে এক মাস। রোজার আগে প্রতিদিন অথবা সপ্তাহেই কোন না কোন নিত্যপণ্যের দাম কমবেশি বেড়েই চলেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে হরেক পণ্যের আমদানি ও মজুদ বর্তমানে পর্যাপ্ত। অথচ অসৎ ব্যবসায়ী-মজুদদার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে এখন অনেক নিত্যপণ্যের দর নিম্নমুখী কিংবা স্থিতিশীল এবং আমদানির পর্যায়ে শুল্ককর হ্রাস, ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস করা হলেও ক্রেতা সাধারণ এর সুফল থেকে বঞ্চিত। রোজাকে পুঁজি করে ক্রেতাসাধারণের পকেট কেটে শত শত কোটি টাকা নির্ঘাত হাতিয়ে নেয়ার টার্গেট নিয়ে সমগ্র বাজারব্যবস্থা কব্জা করতে উঠেপড়ে লেগেছে অতি মুনাফালোভী চক্রটি। রোজার মাসে যেসব নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেশিই হয়ে থাকেÑ চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ-রসুন, আদা, ডালের মতো অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমাগতভাবেই। সম্প্রতি ১০ দিনের নৌযান শ্রমিক-মালিক ধর্মঘটের অজুহাতেও চিনি, ডালসহ কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। পাইকারি বাজারের সাথে পাল্লা দিয়ে খুচরা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধি আরও লাগামহীন। এ অবস্থায় বিশেষত সীমিত আয়ের মধ্য ও নিম্নবিত্তের ক্রেতারা বাজার সিন্ডিকেটের জিম্মিদশায় এবং অগ্নিমূল্যের কারণে নেহায়েৎ অসহায় হয়ে পড়েছেন। কিন্তু অগ্নিমূল্যের লাগাম টেনে ধরার ক্ষেত্রে প্রশাসনযন্ত্র নির্বিকার।
বন্দর-শিপিং সূত্রে জানা গেছে, চাহিদার তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী পর্যাপ্ত হারে আমদানি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ও বহির্নোঙ্গরে গতকাল (শনিবার) পর্যন্তও ছিল নিত্যপণ্য বোঝাই ৮টি জাহাজ। বন্দরের জেটি-বার্থ, ইয়ার্ড-শেডে পণ্য খালাসের ব্যস্ততা। এ সপ্তাহে বহির্নোঙ্গরে আসার কথা আরও ১২টি নিত্যপণ্যবাহী জাহাজ। অনুরূপভাবে দেশের প্রধান পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং ব্যবসায়কেন্দ্র ‘সওদাগরী পাড়া’ চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, মাঝিরঘাট, রেয়াজুদ্দিন বাজারে রয়েছে লেনদেনের কর্মব্যস্ততা, ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের জটলা ও পণ্য লোডিং-আনলোডিংয়ের তাড়া। সমানতালে ব্যাংক-বীমায়ও রয়েছে ব্যবসায়ীদের তোড়জোড়। কোথাও নিত্যপণ্য ঘাটতির আলামত চোখে পড়ে না। তা সত্ত্বেও অত্যাবশ্যকীয় নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কাছে এখন ক্রেতারা হার মানতে বাধ্য হচ্ছেন। ন্যূনতম চাহিদার বিপরীতে কিছু কিনে আর অনেক কিছু না কিনে হতাশ হয়ে ঘরে ফিরছেন। অধিকাংশ পরিবার এখন জরুরি খাদ্যপণ্য কিনতে গিয়েই সর্বস্বান্ত। পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, বস্ত্র ও শিক্ষার জরুরি উপকরণগুলো যোগাড়ের জন্য টাকার সংস্থান করা সাধারণ মানুষের অসাধ্য হয়ে পড়েছে।
বাজার পরিস্থিতির খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাহে রমজানে সারাদেশে সবচেয়ে বেশি চাহিদার ইফতারি দ্রব্য ছোলার (চানাবুট) দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ছোলার বর্তমান দর মানভেদে প্রতিকেজি ৭৫ থেকে ৯০ টাকা। এক মাস আগে ছোলা বিক্রি হয় ৬৫ থেকে ৮০ টাকায়। আর গত বছর (২০১৫ইং) একই সময়ে ছোলার দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ছোলার দাম বৃদ্ধির হার ৪২ শতাংশ। অসৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট রোজার আগেভাগে ছোলার দাম আরও বাড়ানোর ফন্দি আঁটছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। অথচ অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানিকৃত ছোলা বন্দর থেকে খালাস ও ডেলিভারী পরিবহন খরচ মিলিয়ে বাজারজাতের পূর্ব পর্যন্ত দাম পড়ে কেজিতে গড়ে ৩৫-৪০ টাকা। রমজান মাসে মোট চাহিদা ৬৫ হাজার মেট্রিক টন হলেও আমদানি তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে ছোলা মজুদ থাকার কথা প্রায় ৭৫ হাজার টন।
রোজায় আরেকটি অপরিহার্য পণ্য চিনির দাম ইতোমধ্যে কেজিতে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। চিনির বর্তমান মূল্য ৫২ থেকে ৫৬ টাকা। এক মাস আগেও চিনি বিক্রি হয় ৫০ টাকা দরে। এক বছর আগে চিনির দর ছিল কেজি ৩৮ থেকে ৪২ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে চিনির মূল্য বৃদ্ধির হার ৩২ শতাংশ। রমজান মাসের বাড়তি ৩ লাখ মেট্রিক টন চাহিদা যোগ করে দেশে পুরো বছরে চিনির চাহিদা সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টন। বর্তমানে র-সুগার ও পরিশোধিত চিনি মিলিয়ে মজুদ রয়েছে প্রায় ৫ লাখ টন। আন্তর্জাতিক বাজার দর হিসাব করলে খালাসসহ সবকিছু খরচ মিলিয়ে চিনির মূল্য পড়ে গড়ে প্রতিকেজি ৩৬ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত। অথচ আন্তর্জাতিক দরের সুফল চিনির দেশীয় দরে নেই।
বাজারে পেঁয়াজের দাম এক মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বর্তমানে আমদানিকৃত পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজি ২৫ থেকে ৩৫ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৫০ টাকা। রমজান মাসের বাড়তি চাহিদাকে সামনে রেখে পেঁয়াজের দাম আরও বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে।
বাজারে এখন রসুনের দামে আগুন। দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। গত সপ্তাহে দাম ছিল ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এক মাস আগে এ রসুন বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৮০ টাকায়। আর গত বছর দাম ছিল ৫০ থেকে ৭০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে দেশি রসুনের দাম বেড়ে গেছে ৬২ শতাংশ। অন্যদিকে আমদানি রসুন এখন বিক্রি হচ্ছে কেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকায়। গত সপ্তাহে মূল্য ছিল ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। আর গতবছর এই সময়ে আমদানি রসুন বিক্রি হয় কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। বছরান্তে রসুনের মূল্যবৃদ্ধির হার ১৩৪ শতাংশ।
বাজারে মসুরসহ সবধরনের ডালের দাম আকাশছোঁয়া। মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে মানভেদে কেজি ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়। গত এক সপ্তাহে দেশি ও নেপালী মসুর ডালের দাম কেজিপ্রতি ৫-১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। গতবছর এ সময় মসুর ডাল বিক্রি হয় কেজি ৮৫ থেকে ১২০ টাকা দরে। এক বছরের ব্যবধানে মসুর ডালের দাম বেড়েছে ২২ শতাংশ। মসুর ছাড়াও ছোলার ডালের দাম গত এক মাসে কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়ে গেছে। একবছরে বৃদ্ধির হার ১৫ শতাংশ। ছোলার ডাল বিক্রি হচ্ছে মানভেদে কেজি ৭৫ থেকে ৯০ টাকা দরে। মুগ ডাল বিক্রি হচ্ছে কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকায়।
আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দর নিম্নমুখী হলেও দেশের পাইকারি বা খুচরা বাজারে তার কোন প্রভাব দেখা যাচ্ছে না দীর্ঘদিন ধরে। ভোজ্যতেলের দাম আকাশচুম্বি। সেই দর আর যৌক্তিকভাবে স্থিতিশীল হয় না। সয়াবিন তেল (লুজ) বিক্রি হচ্ছে প্রতিলিটার ১১৫ থেকে ১২০ টাকা, কন্টেইনারজাত ৫ লিটারের প্যাক ৫৭৫ টাকা থেকে ৫৯০ টাকা। পামঅয়েলের দাম গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পামঅয়েল (লুজ) বিক্রি হচ্ছে লিটার ৬৫-৭০ টাকায়, সুপার পামঅয়েল ৭০-৮০ টাকায়। জানা যায়, বর্তমানে পাম, সয়াবিনসহ ভোজ্যতেল মজুদ রয়েছে সোয়া ৩ লাখ মেট্রিক টনের মতো। সাধারণত প্রতিমাসে দেশে ৮৫ হাজার মেট্রিক টন ভোজ্যতেলের চাহিদা হলেও রমজান মাসে প্রয়োজন ১ লাখ ৬০ হাজার টন। ভোজ্যতেলের পর্যাপ্ত যোগান সত্ত্বেও দাম কমছে না। বরং রমজান সামনে রেখে সয়াবিন ও পামতেলের দাম আরও বাড়ানোর কারসাজি চলছে। পবিত্র রমজানের প্রাক্কালে নিত্য বা ভোগ্যপণ্যের আমদানি, খালাস, মজুদ ও সরবরাহ ব্যবস্থার আনুপূর্বিক অনুসন্ধানের লক্ষ্যে সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভুক্তভোগী ক্রেতাসাধারণ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন