শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

যুদ্ধাপরাধী ও দলীয় নেতা হত্যা মামলার আসামি নিয়ে খুলনা আ’লীগে তুলকালাম

প্রকাশের সময় : ২৭ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আশরাফুল ইসলাম নূর, খুলনা থেকে : চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী এবং নিজ দলীয় নেতাদের একাধিক হত্যা মামলার আসামিরা এখন খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের নেতা। চাকরি বিধি লঙ্ঘন করে কমিটিতে রয়েছেন দু’জন সরকারি কর্মকর্তাও। এ নিয়ে খুলনা আওয়ামী লীগের ভিতরে-বাইরে চলছে তুলকালাম। সম্প্রতি পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের নিরাপরাধ দাবি করছেন অভিযুক্তরা। আবার রাজাকার চিহ্নিত মৃত শেখ আব্দুল গফুরের ছেলে শেখ মারুফুল ইসলাম হয়েছেন খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের শ্রম-বিষয়ক সম্পাদক। এসব বিষয়ে খুলনা জেলার শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতারা চরম বিব্রত এবং তৃণমূলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট।
খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের এই কমিটি পাশ করতে দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীকে ‘মিসগাইড’ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করলেন সাবেক হুইপ এসএম মোস্তফা রশিদী সুজা এমপি। তিনি বলেন, এ কমিটিতে যুদ্ধাপরাধী, দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা মামলার চার্জসিটভুক্ত আসামি, সরকারি চাকরিজীবী ও অপরিচিত ব্যক্তিরা স্থান পেয়েছে। আমি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অথচ এমন লোকজনও কমিটিতে স্থান পেয়েছেন যাদের আমি চিনি না। এ কমিটি পাশ করতে প্রধানমন্ত্রীকে ‘মিসগাইড’ করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে মহানগরীর খুলনা আবাহনী ক্লাবে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে প্রশ্নোত্তর পর্বে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মোস্তফা রশিদী সুজা এমপি উপরোক্ত কথা বলেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ২৫ অক্টোবর দাকোপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী আতিয়ুর রহমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্ত প্রতিবেদন এবং প্রসিডিংস মামলা প্রস্তুতির জন্য সরবরাহকৃত তালিকায় ১৪ নম্বরে নাম রয়েছে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির (১৮নং) সদস্য ও দাকোপ উপজেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুনসুর আলী খান। দাকোপ থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের করা ১নং পানখালি ইউনিয়নের রাজাকারের একটি তালিকায়ও মুনসুর খানের নাম রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে দাকোপ উপজেলার পানখালি এলাকার ইয়াছিন স্কুলের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়ার অভিযোগে যুদ্ধাপরাধী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গত ১৬ জানুয়ারি খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে নিজেকে নিরাপরাধী দাবি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত তালিকায় যুদ্ধাপরাধী হিসেবে নাম আসা মুনছুর আলী খান। তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সাল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। জনপ্রিয়তায় ইর্ষায়িন্বত হয়েছে একটি পক্ষ চক্রান্ত করে ওই তালিকায় আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করিয়েছে। আমি কখনোই রাজাকার (যুদ্ধাপরাধী) ছিলাম না। বরং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের দেখভালের দায়িত্ব পালন করেছেন বলে দাবি করেন তিনি।’
সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে তৎকালীন দৌলতপুর থানায় আব্দুল গফুর শেখসহ ২১ জন চিহ্নিত রাজাকারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। ওই মামলায় (যার নং-৪২, ১৯-৮-৭২ ইং) মারুফুল ইসলামের সহোদর শেখ জাফরের নামও ছিল। মামলার আরজিতে উল্লেখ, দিঘলিয়া এলাকায় মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকবাহিনী যতগুলো অপারেশন করেছিল তাদের সাহায্যকারী রাজাকার কমান্ডার ছিলেন আ. গফুর শেখ। যুদ্ধাপরাধী ইস্যু সামনে আসলে ২০০৯ সালের ৩০ জুন আ. গফুর শেখসহ ওই ২১ জনের বিরুদ্ধে দিঘলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আবজাল হোসেন বাদী হয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেছিলেন। আদালতের নির্দেশে মামলাটি আমলে নিয়ে দিঘলিয়া থানায় নথিভুক্ত হয় (যার নং-০২, ০৮-৯-২০০৯ ইং)।
হত্যা মামলার দু’জন আসামি : ২০১১ সালে ১৭ মার্চ তেরখাদা ঈদগাহ মাঠে সংঘর্ষে নিহত হয়েছিলেন উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান ফকির। ওই হত্যা মামলার মূল আসামি জেলা আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক শেখ শহিদুল ইসলামকে। এর আগে ২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তেরখাদার কাটেংগা এলাকায় রবিউল মোল্লাকে হত্যা করা হয়। এ হত্যা মামলার আসামি হলেন জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান (কালু মোলা)। অবশ্য গত ১৩ জানুয়ারি খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের বিরুদ্ধে করা মামলাটি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বলে আখ্যায়িত করে নিজেরা নিরাপরাধ দাবি করেন। অপরদিকে, নিহতদের স্বজনরা পরদিন ১৫ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ শহিদুল ইসলাম বলেছেন, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।’ মোস্তাফিজুর রহমান (কালু মোল্লা) বলেন, ‘আমি ষড়যন্ত্রের শিকার। অন্যায়ভাবে আমাকে হত্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
সরকারি দু’জন কর্মকর্তা : খুলনা সদর হাসপাতালের দায়িত্বরত অবস্থায় ডা. তারিৎ কান্তি ঘোষ জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. শেখ শহিদুল ইসলাম জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা-বিষয়ক সম্পাদক। ডা. শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘রাজনীতি করবেন বলেই তিনি সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। যদিও সেটা এখনো কার্যকর হয়নি; তবে হবে।’
২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে জেলা পরিষদ প্রশাসক শেখ হারুনুর রশিদ সভাপতি এবং এসএম মোস্তফা রশিদী সুজা এমপি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সম্মেলনের অন্তত ১১ মাস পর গত ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাক্ষর করে জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেন। ওই কমিটিতেই তালিকাভুক্ত যুদ্ধাপরাধী মুনছুর খান, রাজাকার পুত্র শেখ মারুফুল ইসলাম, হত্যা মামলার আসামি শেখ শহিদুল ইসলাম ও মোস্তাফিজুর রহমান (কালু মোল্যা) এবং সরকারি কর্মকর্তা (খুলনা মাদকদ্রব্য নিরাময় কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার) ডা. তারিৎ কান্তি ঘোষ এবং ডা. শেখ শহিদুল ইসলামের স্থান হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন